নারীজন্ম যাপন!

অনসূয়া যূথিকা:

শুনতে খারাপ লাগে বটে কিন্তু বাংলাদেশ, তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। গালভরা উন্নয়নশীল দেশ বলতেই বেশি স্বচ্ছন্দ বোধ করি আমরা। দেশের জনসংখ্যার বড় অংশ নারী কিন্তু আলাদা মন্ত্রণালয় নানান রকম প্রজেক্ট বহু রকমের আইন তবু এদেশের নারীরা খুব কি ভালো আছেন?

মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বলে বাংলাদেশ অসাম্প্রদায়িক দেশ, আর বাস্তবতা হলো বাংলাদেশ নব্বই শতাংশ মুসলমানের দেশ। আইনের পরে আইন করেও বাল্যবিবাহ রোধ করা গেলো না আজও পুরোপুরিভাবে। বরং বাল্য বিবাহ নিরোধ আইনটির ধারাগুলো বড়বেশি খটোখটো। ধারা ঊনিশ নিয়ে বিতর্ক বা বিতন্ডারও অবধি নেই। কারও কারও মতে ধর্ষকের শাস্তি না বরং ধর্ষকের সাথে বিয়ে দিয়ে বাপমা যেন দিনগত পাপক্ষয় করতে পারে আইনের এই ধারাটি তারই রক্ষাকবচ!

একবিংশ শতাব্দীতে এসেও, বাংলাদেশের এক প্রান্তিক নারীর জীবনে বিয়ে একটা বড় বিষয়। দারিদ্র্য সীমার কাছাকাছি বা তারচেয়ে দরিদ্র পরিবারে কন্যাদায় বড় দায়। গরীবস্য গরীব বাবার তদস্য গরীব কন্যার জন্য সারাজীবনে ঐ একবারই সামান্য কিছু সখ নামের বিলাসিতা এসে ধরা দেয়। দুটো সস্তার শাড়ি ব্লাউজ, অল্প কিছু সাজগোজের সরঞ্জাম আর বেলোয়ারি নয় সস্তা কাঁচের চুরির সখ পূরণ করে নারীজন্ম সার্থক করার নাম বিবাহ।

অনসূয়া যূথিকা

কন্যা তো বটেই, তার পরিবারও জানে না বিয়ে নামক জাঁতাকলে কতোটা পিষ্ট হতে হবে তাকে। জানে না কী কী আর কীসের বিনিময়ে কতোশত অপমান হজম করে দিন গুজরান করতে হবে তাকে! বলি দিতে হবে কতো শত সহস্র সখের, মূল্যবোধের! জানে না বিবাহের মন্ত্রে কী শপথ করে এলো! জানে না কলেমার নামে কী পড়ে এলো, আর কাবিনেইবা কী লেখা আছে যা সে না পড়েই সই বা টিপসই দিয়ে এলো! নিজের জীবনের লাগাম তুলে দিলো পুরুষ নামের প্রভুর হাতে! সংস্কৃত ‘স্বামী’ শব্দের অর্থ তো নাথ, প্রভুই হয়। যেমন বলা হয় পতি পরমেশ্বর মানে স্বামীই ঈশ্বর। বাস্তবতা দেখলেও তাই হয় বটে, স্বামীই নারীর সমগ্র জীবনের নিয়ন্তা!

বিবাহিত জীবনে স্বামীর সঙ্গে একই ছাদের নিচে বসবাস করতে গিয়ে প্রায় অধিকাংশ নারী তিক্ত অভিজ্ঞতার মধ্যে পড়ে। বিয়ের পরে বাপেরবাড়ির চৌকাঠ কমবেশি সব নারীর জন্য উঁচু হয়ে যায়। তাই বনিবনা না হোক, স্বামীর পরকীয়া হোক চাই মারধোর বা নির্যাতন মেনে নেয়া আর মানিয়ে নেয়াই নারীর নিয়তি। স্বামীর শাসনের নামে মারধোর, চড় থাপ্পড় কিল ঘুষি কী লাথি এদেশের নারীরা বিবাহিত জীবনের লড়াইয়ের অঙ্গ হিসেবেই জানে। বড় হতে হতে নিজের মাকে নির্যাতিত হতে দেখে আর একেই স্বাভাবিক ভাবতে শেখে। প্রতিবাদ করে না কারণ প্রতিবাদ করার শিক্ষাই তো তারা তাদের পরিবার থেকে পায় না। কচিৎ কদাচিত কোন নারী যখন স্বামীর নির্যাতনের প্রতিবাদ করে তখন প্রথম প্রতিরোধ আসে তার নিজের পরিবার থেকে। তাই ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের ঘটনা রোজ রোজ ঘটে আর প্লাস্টিক হাসির নিচে চাপা পড়ে।

খুব খুব কাছের বান্ধবীটিকেও বিশ্বাস করে নিজের কষ্টের কথা বলা চলে না। কোথাও এতোটুকুও শ্বাস ফেলার জায়গা থাকে না অধিকাংশ নারীর জীবনে। কাকে বলবে, কি বলবে আর কিকরে বলবে! কষ্টের কথা জেনে কাছের বান্ধবীটিও মুখ টিপে হাসবে আর কিটি পার্টিতে গিয়ে ততোধিক কাছের বন্ধুদের কাছে উগড়ে দিয়ে আসবে এই ঘটনা সবিস্তারে মনের মাধুরি মিশিয়ে। তারচেয়ে মনের গহীনে নীরবে নিভৃতে থাকুক যতনে গোপন কথাটি! গালে বসে যাওয়া পাঁচ আঙুলের দাগ ঢাকতে সিসি বিবি ক্রিম আছে তো। ঠোঁটের কালশিটে ঢাকা পড়ে যায় শাইনারে। বউকে ফুটবল ভেবে প্রাক্তন গলির ফুটবলারের লাথির জোরে কনকনে কোমর!? ও কিছু না, হাইহিলের বদলে ফ্লাট কোলাপুরি কি স্টাইলিশ স্নিকার চলবে। দামি কাঞ্জিভরমে মনের সব কষ্ট ঢেকে পার্টি আর রেস্তোরা রিসোর্টে চেক ইন চলবে। ফের নাহয় ফেবুতে এসে বিউটি মিথ আর হাইহিল নিয়ে বড় সড় তর্ক করা হবে। নারীবাদের তত্ত্বকথা, ওয়েব নিয়ে তুখোড় তর্ক যতোই হোক এদেশের নারীদের তো বটেই নামকরা এলিট নারীবাদীদের জীবনের গল্পও সেই প্রান্তিক নারীদের মতো থোড়বড়িখাড়া!
পশ্চিমা দেশগুলোর কথা বলে, বা তুলনা করে লাভ নাই।

এদেশের একজন স্বনির্ভর নারী একজন স্বাবলম্বী নারী হতে হলে, নিজের মতে নিজের আত্মসম্মানবোধ বজায় রেখে চলতে গেলে পদে পদে নারীকে পরীক্ষা দিতে হয়। আজো তাই একজন সাংসদ সংসদ অধিবেশনে যোগ দিয়ে তাঁর বক্তব্যে বলেন, আমার স্বামীর জন্য আজ আমি এই পর্যায়ে আসতে পেরেছি। উন্নয়ন কর্মী বলেন, স্বামীর সাহায্য না পেলে আমি আজকের আমি হতাম না। কখনো কোন প্রতিষ্ঠিত নারীর স্বামীটি আরো এককাঠি সরেস! কোন জমায়েতে বলে বসেন আমিই তো আমার বউকে ম্যাজিস্ট্রেট বানিয়েছি! সে নিজে হয়তো উচ্চ মাধ্যমিক ফেল! যে একজন নারীকে ম্যাজিস্ট্রেট বা ডাক্তার বানাতে পারলো সে নিজেই নিজেকে একই উচ্চতায় আনতে পারলো না কী ভীষণ রকম অদ্ভুত কৌতুক! ফের একজন বিসিএস ক্যাডার নিয়োগ পাবার পরই তদ্বির শুরু করেন স্বামীর সঙ্গে একই এলাকায় যেনো থাকতে পারেন। এমনও অনেক নারী আছেন যারা ক্যাডার তো হয়েছেন কিন্তু কখনো চাকরিটাই করলেন না। কোথাও পোস্টিং নিয়ে স্বামী পরিবারের আপত্তি তো কখনো প্রবাসী বাংলাদেশি স্বামীর সঙ্গে সংসারের মোহে দেশ ছেড়ে প্রবাসে গেছেন তারা।
ব্যতিক্রম আছে নিশ্চয়ই কিন্তু তা আদতে সমাজের বাস্তবতাকেই প্রতিফলিত করে।

এই তো সপ্তাহ খানেক আগে মিডিয়া তোলপাড় হলো সেই খবরে যখন জেলাপ্রশনের তত্ত্বাবধানে এক কর্মশালায় বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বললেন নারী সাংবাদিকদের বাড়তি সুরক্ষা দিতে কি কি করা দরকার। যেখানে ছিল বিবাহের চিহ্ন ধারণ করার কথা, বলা হয়েছিল ভেজা চুলে স্পটে না যেতে। তর্ক হতে পারে অনেকই কিন্তু সমাজ আজো কী চোখে দেখে একজন সংবাদ কর্মী হিসেবে নারীকে তা বোঝা যায় অনেকটাই। শব্দটা খেয়াল করুন, নারী সাংবাদিক! পুরুষ সাংবাদিক বলা হয় না কিন্তু কখনোই বা কখনো কেউ বলে না পুরুষ ক্রিকেটার! নারী ক্রিকেটার, নারী খেলোয়াড়, শিক্ষিকা, সেবিকা, নারী কর্মী এমনকি বলতে শুনবেন নারী বস! এবং আরো আশ্চর্যের কথা হলো, কর্মক্ষেত্রে নারী যখন কর্ত্রী তখন বহু বহু পুরুষ সেখানে কাজ করতে অস্বস্তি বোধ করেন। অস্বীকার করার ঘটনাও বিরল না।

উপমহাদেশের সমাজ বাস্তবতার বিচারে নারী নেহাত দ্বিতীয় লিঙ্গ!তা সে যে ধর্মের আর যে গোত্রেরই হোক না কেন! বিয়ের আগে বাপভাইয়ের আর বিয়ের পরে স্বামীর পরিচয়েই একজন নারী পরিচিত হন। এই সেদিন মুক্তি পেলো ভারতীয় বাংলা সিনেমা মুখার্জীদার বউ, যেখানে শাশুড়ি ও পুত্রবধূকে লোকে মুখার্জীদার বউ বলে জানে। দুজনের কারো নাম বা ভিন্ন কোন পরিচয় নাই। একমাত্র স্বামীর নাম আর পদবী নিয়ে বেঁচে থাকা!

বাংলাদেশ নামের অর্ধ শতাব্দীর দেশ বা উপমহাদেশের নারী জাগরণের পথিকৃৎ বেগম রোকেয়াও তাঁর নিজের নামের সঙ্গে স্বামীর নামটি জুড়ে লিখতেন রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। যেমন আজও লেখেন বেগম খালেদা জিয়া, যিনি এখন আর জিয়ার স্ত্রী নন, তার বিধবা পত্নীও নন৷ কিন্তু জেনারেল জিয়াউর রহমানের প্রাক্তন স্ত্রী এই পরিচয় ছাপিয়ে তার আর নতুন পরিচয় তৈরি হলো না! যেমন লিখতেন ঘাতক দালাল নির্মুল কমিটির প্রধান, সকল শহীদ সন্তানের আম্মা বেগম জাহানারা ইমাম!

বাদ যান না এমনকি কবি সুফিয়া কামালও! যদিও এদেশের নারী আন্দোলনের এই সময়ে এসে বাবা বা স্বামীর পরিচয়ে না বরং আমরা আমাদের নিজের পরিচয় তৈরি করতে চাই, নিজের নামে পরিচিত হতে চাই। জানা কথা পথটা কঠিন, পথচলা সহজ না, কিন্তু অসম্ভবও না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.