সুমু হক:
সম্প্রতি বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা মহামারীর আকার ধারণ করেছে এটা যেমন ভয়ংকর সত্য, তার চেয়েও ভয়ংকর সত্য এই ঘটনাগুলো দেখে আমাদের অভ্যস্ত এবং নিস্পৃহ হয়ে যাওয়া। যেন জন্ম-মৃত্যুর মতোই ধর্ষণ এবং যৌন নির্যাতনও আমাদের জন্যে জীবনের আরেকটা অবশ্যম্ভাবী অধ্যায় মাত্র।
ধর্ষকেরা ধর্ষণ করে বলে যতখানি অন্যায় করছে, ঠিক ততটাই অন্যায় করছি আমরা সমাজের এই ধর্ষকামিতার সংস্কৃতিটিকে জিইয়ে রেখে।
ধর্ষণ এবং যৌন সন্ত্রাসের সাথে যতখানি সম্পর্ক যৌনতার, তারচেয়ে অনেক বেশি সম্পর্ক ক্ষমতার। আমাদের দেশে নারী, শিশু-কিশোর-কিশোরী এবং অনেক সময় সমাজের নিম্নবিত্ত শ্রেণীর অনেক পুরুষেরও ব্যক্তিগত অধিকার, ব্যক্তিগত স্পেসের ধারণাটিকে স্বীকার করা হয় না।
মানুষ হিসেবে অন্য কারো ব্যক্তিস্বাধীনতা কিংবা নিজের দেহ ও সম্পদের ওপর তার অধিকারের ধারণাটিকেই যদি আমরা স্বীকারই করতে না পারি, তাদের ব্যক্তিগত ইচ্ছে -অনিচ্ছে চাহিদা কিংবা যৌনতার ক্ষেত্রে তাদের সম্মতির বিষয়টিকে কি করে স্বীকার করা সম্ভব?

ব্যক্তিস্বাধীনতার ধারণাটিকে অস্বীকার করে আমরা তাই সম্পর্ক বলতেই বুঝি একজন মানুষের ওপর অন্য আরেকজনের আধিপত্যকে। বিয়ের ক্ষেত্রে তাই মানসিক সংযোগের চাইতে জরুরি হয়ে ওঠে একটি কাগজ, যা কিনা আমাকে অন্য একটি রক্ত-মাংসের শরীরের ওপর দখলদারিত্বের স্বীকৃত অধিকার দেবে। বাবা-মায়ের সাথে সন্তানদের সম্পর্কের ক্ষেত্রে পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার চাইতেও জরুরি হয়ে ওঠে বিনা প্রশ্নে বাবা-মার সবরকম ইচ্ছেকে অন্ধভাবে সন্তানের ওপর চাপিয়ে দেয়া। আর সে সন্তান অপ্রাপ্তবয়স্ক হলে তো কোথায় নেই! তার আবার অধিকার বলে কিছু থাকতে আছে নাকি? অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানেরা নিছক বাবা-মা এবং পরিবারতন্ত্রের প্রজামাত্র। তাদের শরীর-মন নিয়ে তাই যাচ্ছেতাই খেলার অধিকারটা আমাদের সমাজে রীতিমতো প্রাতিষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত।
সেই আমাদের সমাজে নারী-পুরুষ শিশু এবং কিশোর কিশোরীরা তাদের চাইতে অপেক্ষাকৃত ক্ষমতাশালী যে কারো হাতে যৌন সন্ত্রাসের শিকার হবে, এতে আর আশ্চর্য কী!
# MeToo নিয়ে লেখালেখি করতে গিয়ে আর সেসব নিয়ে বাঙালির প্রতিক্রিয়া দেখে সত্যিই খুব করুণা হয়েছিলো।
আমরা সুস্থ সম্পর্কের সংজ্ঞা কী জানি না , “consent” শব্দটার অর্থ কী, অর্থাৎ ওটা কি খায়, না মাথায় লাগায় , নাকি দেয়ালের ফ্রেমে বাঁধিয়ে রাখতে হয়, তার কোনটাই জানি না। কনসেনচুয়াল সম্পর্কের সংজ্ঞাই জানি না, তো নন-কনসেনচুয়াল সম্পর্ক তো অনেক দূরের কথা। আরো আছে!
ধর্ষণ কিংবা সেক্সচুয়াল ভায়োলেন্সের সংজ্ঞা জানি না। ধর্ষণ কিংবা যৌন সন্ত্রাসের শিকার যে নারী-পুরুষ নির্বিশেষে যে কেউ হতে পারেন, সেই তথ্যটুকুও জানি না। পরিবারের সদস্যদের হাতে যৌন নির্যাতনের শিকার কেউ হতে পারে, একথা শুনলে তো রীতিমত আকাশ থেকে পড়ি! আমাদের ভাই, পুত্র, বাবা-কাকা, শ্বশুর, স্বামী, দেবর, ভাশুর প্রত্যেকেই একেকজন ঈশ্বরের অবতারবিশেষ, তারা কি কখনও ভুলেও এমন অশ্লীল কাজ করতে পারেন! বৈবাহিক সম্পর্কের ভেতরেও যে নিয়মিতভাবে ধর্ষণের শিকার হয়ে মৃতপ্রায় হয়ে বেঁচে থাকেন অনেক নারী, সেই বৈবাহিক ধর্ষণের কথা শুনলে আমরা হেসেই বাঁচি না! এও কি সম্ভব! এতো পুরোই কাঁঠালের আমস্বত্ত্ব হয়ে গেলো! এ আমি শুধু পড়ালেখা না জানা মানুষের কথা বলছি না। প্রাতিষ্ঠানিক বিদ্যার একেকজন মহা দিগগজের কাছেও এই রকমের ন্যাকা-ন্যাকা, বোকা- বোকা অনেক প্রশ্ন শুনেছি। এই বঙ্গসন্তানদের কাছে আমি আর এখন কোন প্রত্যাশাই রাখি না।
ধর্ষণ নির্ভর করে ধর্ষক এবং ধর্ষণের শিকার ব্যক্তির সম্পর্কের পাওয়ার ডাইনামিকের ওপর। এর সাথে তাদের পারস্পরিক সম্পর্ক, রক্ত কিংবা সমাজের নির্ধারণ করে দেয়া, কোন ফ্যাক্টরই নয়। একই ধরনের আলাদা আলাদা সম্পর্কের ভেতর কখনো ধর্ষণ ঘটে আর কখনো বা ঘটে না, একে জেনারালাইজ করে ইতিবাচক কিংবা নেতিবাচক কোনদিকেই নিয়ে যাওয়া উচিত নয়। পিতা-মাতা মাত্রই যেমন তাঁরা ঈশ্বরের অবতার নন, তেমন সব পুরুষ মন্দ, কিংবা মা মাত্রই দেবীতুল্য, এমনটা ঢালাওভাবে ভেবে নেওয়াও ভীষণ অন্যায়। দিল্লির ধর্ষণের ঘটনাটির পর একজন রাজনীতিবিদ (নারী) বলেছিলেন, “মেয়েটা ধর্ষকদেরকে ভাই ডাকলো না কেন, তাহলেই তো ওরা ওকে রেহাই দিতো!” একথা শুনে আমার এক ভারতীয় বন্ধু বলেছিলো, “তাহলে এখন থেকে পেপার স্প্রের বদলে ব্যাগে ডজনখানেক রাখি নিয়ে ঘুরবো, কী বলো!”
যৌন সন্ত্রাসের ক্ষেত্রে বায়োলজিকাল কিংবা সামাজিক সম্পর্ক কোন বাধা হয়ে উঠতে পারে না। পারলে তা আমাদের সামাজিক হিসেব-নিকেশগুলোর পক্ষে সুবিধেজনক হতো নিঃসন্দেহে। কিন্তু বাস্তবে হিসেবটা অত সহজ নয়। আর তা নয় বলেই আমার জানা এমন অনেক নারী-পুরুষ আছেন যারা রক্তসম্পর্কিত আত্মীয় এমনকি নিজের জন্মদাতার কাছেও যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েছেন। আর তেমনিভাবে সুযোগ থাকার পরও রক্তের সম্পর্ক না থাকা সত্ত্বেও নিজের থেকে দুর্বলতর ব্যক্তির ওপর নিজের যৌন-লালসাকে চাপিয়ে দেননি, এমন মানুষও আছেন বিস্তর।
দেহে স্পার্ম তৈরি করার এবং সেই স্পার্মকে একজন নারীর গর্ভাধারে প্রবেশ করাবার মতো শারীরিক ক্ষমতাটুকু থাকলে যেকোনো দুপেয়ে জীবই সন্তানের জনক হতে পারে। সেই বায়োলজিক্যাল কন্ট্রিবিউশনটুকু করেছে বলেই সে পিতা হয়ে যায় না। সন্তানের সাথে পিতা হিসেবে সে সম্পর্ক তাকে সমস্ত জীবন দিয়ে একটু একটু করে তৈরী করতে হয়। সেই সম্পর্কই নির্ধারণ করে পিতা হিসেবে সংজ্ঞায়িত হবার সে যোগ্য কিনা।
আমাদের দেশে মানুষের স্বাভাবিক যৌনতার কোন স্বীকৃতি নেই বলেই সমাজের প্রতিটি কোনায় কোনায় যৌন-বিকৃতির রাজত্ব। এদেশে প্রকাশ্যে একটি মেয়ে ধর্ষিত হলে কিংবা এমনকি খুন পর্যন্ত হয়ে গেলেও তাতে কারো কোন আপত্তি নেই, অথচ প্রেমিক-প্রেমিকা প্রকাশ্যে হাত ধরে হাঁটলে, কী একে অন্যকে চুমু খেলে সেটা রীতিমতো পত্রিকার খবর হয়ে দাঁড়ায়। চারদিকে গেল গেল রব ওঠে।
অথচ প্রতি রাতে যেই মেয়েটা তার স্বামীর হাতে ধর্ষিত হয়, তার জন্যে সেটাই স্বাভাবিকত্বের প্রেসক্রিপশন পায়। বিয়ে করা বৌ, তার আবার ইচ্ছে অনিচ্ছে কী ! ধর্ম থেকে নিয়ে রাষ্ট্র এবং সমাজ রীতিমত আইন করেই স্বামীর কাছে স্ত্রীর দাসত্বকে বৈধ করে দিয়েছে যখন, তখন সেই দাসীর আবার ইচ্ছে অনিচ্ছের প্রশ্ন আসে কোত্থেকে? আমাদের মগজে মগজে এই সামাজিক দাসত্বের বিষয়টি এতখানি গভীর হয়ে গেঁথে আছে যে ম্যারিটাল রেপ নিয়ে আলোচনা উঠলে বছরের পর বছর স্বামীর হাতে ধর্ষিত হওয়া নারীটিই সবার আগে ছি ছি করে উঠবে।
আমরা মেয়েদেরকে বড় করে তুলি তাদের শরীরকে একটি অত্যন্ত নোংরা জিনিস হিসেবে দেখতে শিখিয়ে, যৌনতা নিয়ে স্বাভাবিক আলোচনা তো দূরের কথা, যৌনতা মানেই একটি বিভিষীকা অথবা ভয়ংকর নোংরা বিষয়, এই ধারণা নিয়েই তারা ছেলেবেলা থেকে বড় হয়ে ওঠে। যেহেতু পরিবারের বাইরে এই নিয়ে আলোচনার অবকাশ খুব কম, তাই যৌনতা বিষয়ে একটি মেয়ের ধারণা এইটুকুতেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
তবে কি সেদিক থেকে বিবেচনা করলে ছেলেরা তুলনামূলকভাবে সৌভাগ্যবান? মোটেও নয়।
নিজেদের শরীর নিয়ে এতসব কিম্ভুতকিমাকার ধারণা নিয়ে বড় না হলেও, সে বিষয়ে তেমন কোন সুষ্ঠু ধারণা তৈরি করবার মতো সুযোগ তাদের থাকে না। আরেকটু বড় হয়ে উঠলে পরিবারের নজরদারির বাইরে এসে যৌনতা বিষয়ক কৌতূহল মেটাতে গিয়ে একমাত্র পর্ন ছাড়া অন্য কোন মাধ্যম তাদের হাতের কাছে থাকে না। সুতরাং যৌনতা বিষয়ে তাদের সব জ্ঞান, সবরকম কৌতূহল, প্রত্যাশা ইত্যাদি গড়ে ওঠে পর্ন সংস্কৃতির ওপর ভিত্তি করেই।
অন্যদিকে সমাজ এবং পরিবার আজন্ম তাদের শিখিয়েছে যে যৌনতা মানেই পাপ, আর যে মেয়ে বিছানায় স্বতঃস্ফূর্ত হয়, তার স্বভাব-চরিত্র কোনভাবেই তাকে ঘরের বৌ করে আনবার যোগ্য করে তোলে না। তাই ঘরের বৌ মানেই সতীসাধ্বী, অনাঘ্রাতা ফুল, ইত্যাদি, ইত্যাদি। আবার সেই অনাঘ্রাতা ফুলটি যে কোনোভাবেই তার পর্নলব্ধ আকাঙ্খা পূরণে সক্ষম হবে না এটাই স্বাভাবিক, হলে তখন আবার সেই স্বামীটিই প্রশ্ন তুলবে, “এসব কোথায় শিখেছো? নিশ্চয়ই অনেকের সাথে শুয়ে বেড়ানোর অভ্যেস আছে তোমার!” অর্থাৎ মেয়েটি এদিকেও যেতে পারবে না, ওদিকেও নয়।
পুরুষটিও তার পরিবার এবং সমাজ থেকে তার জন্যে নির্ধারণ করা রাখা ভার্জিন মেরি আর তার কল্পনার মেরিম্যাগডেলিনের ভেতরকার অভিজ্ঞ আকাঙ্খা পূরণের দোলাচলে ব্যর্থ হয়ে এই দুইয়ের অলীক সমন্বয় খুঁজে না পেয়ে তার যৌনতার বিকার পরিতৃপ্ত করতে ঝাঁপিয়ে পড়ে বাড়ির কাজের মেয়ে, কাজের ছেলেটা কিংবা বাড়ির কিশোরী মেয়েটার ওপর।
খুঁজে দেখলে হয়তো দেখা যাবে, তাদের অতীতেও রয়েছে এমন কোন বিভীষিকাময় যৌন সন্ত্রাসের অভিজ্ঞতা।
কারও ইচ্ছের বিরুদ্ধে নিজের যৌন লালসা চরিতার্থ করতে তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়া যে অন্যায়, অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই শিক্ষা সমাজ তাকে দেয় না। আজকের যৌন সন্ত্রাসের শিকার ছেলেটি কিংবা মেয়েটিই তাই একেই জীবনের স্বাভাবিক যৌনতার অংশ ধরে নিয়ে আগামীকাল ঝাঁপিয়ে পরবে তারচেয়ে দুর্বল কারো ওপর।
আজকে যে ছেলেটি কোন মুরুব্বির হাতে যৌন সন্ত্রাসের মুখোমুখি হয়ে বেড়ে উঠছে, আগামীকাল সেই ছেলেটিই হয়তো তার স্ত্রীর ইচ্ছের বিরুদ্ধে গিয়ে রাতের পর রাত জোর করে তার ইচ্ছে পূরণ করাটাকেই স্বাভাবিক বলে মেনে নেবে। যৌন সন্ত্রাসের অভিশপ্ত চক্রটি এভাবেই চলতে থাকবে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে। স্বাভাবিক যৌনতার স্বতস্ফূর্ততা আর আনন্দ এই জীবনে আর তাদের পক্ষে জেনে ওঠা সম্ভব হবে না।
আমাকে অনেকেই জিজ্ঞাসা করছেন, এখন ছেলেবেলায় যৌন সন্ত্রাসের শিকার হওয়ার অভিজ্ঞতাটাকে আমি কীভাবে দেখি? কতখানি ঘৃণা করি আমি সেই শ্বাপদটাকে? সত্যিকার অর্থে তার জন্যে আমার এখন করুণা ছাড়া কিছুই হয় না। কিচ্ছু না। আমাদের সমাজে অসুস্থ, অস্বাভাবিক যৌনতার যে মহামারী ছড়িয়ে আছে, সে তার একটিমাত্র বিস্ফোটক মাত্র। এর বেশি কোন গুরুত্ব তার নেই। আমার ঘৃণা আমি জমিয়ে রেখেছি সেই (অ)মানুষগুলোর জন্যে, প্রজন্মের পর প্রজন্ম জুড়ে চলে আসা এই যৌন সন্ত্রাসকে যারা স্বাভাবিক বলে ধরে নেন, পরিবারের সম্মানের নামে যুগের পর যুগ ধরে অসহায় এবং অপেক্ষাকৃত দুর্বলের ওপর ঘটে চলা এই অন্যায়কে যারা জাস্টিফাই করে চলেন তাদের প্রতি।
আমার ঘৃণা আমি জমিয়ে রেখেছি সেইসব অভিভাবকের প্রতি, সন্তানের পাশে দাঁড়ানোর চাইতে, সন্তানের নিরাপত্তার চাইতেও লোকের কথার মূল্য যাদের কাছে অনেক বেশি। যদিও চোখ খুললে হয়তো তারা দেখতে পেতেন যে এমনকি সমাজটাও আর তাদের বদ্ধ পাঁকের নোংরা চৌহদ্দিতে আটকে নেই, সময়ের গতিতে সেই সমাজ তাদেরকে পিছনে ফেলে চলে গেছে অনেকদূর।