শাহরিয়া দিনা:
একলা মেয়েকে নিয়ে অনেক কথা হয় সমাজে। একলা মেয়েরও থাকে অনেক কথা নীরবে। যে মেয়েটা একা হয়ে যায় তার পাশে কাউকে পাওয়া না গেলেও পেছনে কিংবা সামনে অনেককেই দেখা কিংবা শোনা যায়। পুরুষ সঙ্গী; সোজা কথায় স্বামী না থাকলেই মেয়েটা একা বলা হয়। একা মেয়ের কথা অনেক লেখা হলেও খুব বেশী বদলায়নি তার প্রতি অন্যদের দৃষ্টিভঙ্গি৷
একটা মেয়ে একা বা শুধুমাত্র বাচ্চাদের নিয়ে এ শহরে বাসা ভাড়া নিতে পারেনা। দেয়া হয়না। পুরুষ ছাড়া এ কেমন পরিবার! আশেপাশে আত্মীয়-অনাত্মীয় সবার বাঁকা চোখের স্বীকার। আবার বিয়ে করো উপদেশ আর বিয়ে করছো না কেন? প্রশ্ন সবার। পরিবারেরও একই কথা, একটা আশ্রয় তো দরকার! আর অফিস? সেখানের পরিবেশও কি একা মেয়ের প্রতি বন্ধুবৎসল?
নাহ এটা ভাববার কোন অবকাশ নেই যে, একা মেয়ের কোন দরদী বা শুভাকাঙ্ক্ষী নেই। তারও আছে অনেক শুভাকাঙ্ক্ষী যারা দরদী গলায় শুধায়, কিভাবে থাকো একা? শরীরেরও তো একটা ব্যাপার আছে না! শুভাকাঙ্ক্ষী পুরুষটি সুযোগ পেলে এই কষ্টের ভার লাঘবে তিনি আগ্রহী ইনিয়েবিনিয়ে বুঝানো যথাসাধ্য চেষ্টা-তদবির করেন। এদের মধ্যে যারা নারী তারাও কম যান না, শার্লক হোমসের মতো খেয়াল রাখেন তারা কাছে কে আসল-গেল। কার সাথে তাকে কোথায় দেখা গেল। অনেকে আবার এককাঠি সরেস! যেহেতু তার স্বামী নেই সেহেতু সে আমার স্বামী নিয়ে যেতে পারে ভেবে তটস্থ থাকে।
একলা মেয়ের শত্রু কি শুধু চরিত্রহীন পুরুষ? মোটেই না। বরং প্রশ্ন করুন কে নেই এই তালিকায়? ডিভোর্সের পর বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই প্রথম ধাক্কাটা আসে পরিবার থেকে। মেনে নাও, মানিয়ে নাও। একান্তই যদি না-ই পারো তো আবার অন্য কোথাও বিয়ে করো। একা কিভাবে থাকবে? লোকে কি বলবে? অথচ লোকে তাদের মেয়েকে খাইয়ে-পড়িয়ে মানুষ করেনি তারা ভুলে যায়। সবার চেহারা, কথার ধরন পাল্টে যায়। বুঝিয়ে দেয়া হয়, তুমি একটা বোঝা।
‘আপনার স্বামী কী করেন’? পরিচয়ের পর অবধারিত প্রশ্ন যেকোনো মেয়ের প্রতি, অথচ ছেলেদের বেলায় উল্টো। ‘আপনার বউ কী করে’ এ প্রশ্ন তাদের কালেভদ্রে শোনা হয় হয়তো। পুরুষ ছাড়া নারী যদি অসম্পূর্ণ হয়, তবে নারী ছাড়াও পুরুষ পূর্ণ নয়। পুরুষ একা থাকলে অতটা সমস্যা নেই সমাজের, যতটা মাথাব্যথার কারণ ওই একলা নারী হয়।
একটা একলা মেয়ে কী দুর্গম পথ পাড়ি দেয় তা তথাকথিত সুখী এবং সৌভাগ্যবানরা কল্পনাও করতে পারবে না। এই সমাজব্যবস্থা তার প্রতিটা পদক্ষেপে বুঝিয়ে দেয় তুমি আমাদের মতো নও। হ্যাঁ, একা মেয়েটা তাদের মতো নয়, সে প্রচণ্ডরকম মানসিক শক্তির অধিকারী। তাইতো সব রক্তচক্ষু আর টিটকারি উপেক্ষা করে নিজে নিজের দায়িত্ব নিতে শিখেছে। সন্তানের দায়িত্বও নিতে শিখেছে। এ সমাজ একা নারীর প্রতি সহনশীল হতে বহু দেরী আছে জেনেই সে ধীরে ধীরে সামাজিক প্রতিকূলতা মোকাবিলা করে টিকে থাকার কৌশল আবিষ্কার করেছে। পথে বাঁধা এলে নিজেই নতুন পথ তৈরী করতে পেরেছে।
জীবন একটাই। সেই জীবনে একটা অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক একটা দুর্ঘটনা। দুর্ঘটনায় কেউ নিহত হয়, কেউ পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে জীবন্মৃতের মতো বেঁচে থাকে কেউবা ক্ষতচিহ্ন নিয়ে সুস্থ হয়ে উঠে। ক্ষতচিহ্ন থাকে তাই বলে জীবন থেমে থাকেনা। একটা অস্বাস্থ্যকর সম্পর্ক থেকে বেড়িয়ে আসাটা আর যাই হোক খুব একটা মন্দ না। একজীবন শুধু দুর্ঘটনার ভয়াবহ স্মৃতির না এখানে যোগ হয় কিছু সুন্দর স্বর্গীয় সুখের অনুভবও। কোন স্মৃতিটা ধরে রাখবেন কোন স্মৃতিটা ফেলে দিবেন সেটা আপনার সিদ্বান্ত। তেমনি একলা থাকবেন কি সঙ্গীর সাথে সেটাও আপনার সিদ্বান্ত।
একজন খারাপ মানুষের সাথে আপনার সম্পর্ক হয়েছিল বলে পৃথিবীর সব মানুষ তো খারাপ নয়। এখনো পৃথিবীতে ভালো মানুষের সংখ্যাই বেশী। সাড়ে সাতশো কোটি মানুষের পৃথিবীতে অনেক চমৎকার মনের মানুষ আছে। মনের মতো কেউ যদি আসে তবে সঙ্গী হিসাবে তাকে কেন নিব না? অল্প সময়ের পৃথিবীতে কিছু চমৎকার মুহূর্ত কাটানোর অধিকার সবারই আছে। কোন প্রেশারে অথবা অন্যের মন রক্ষার্থে নয়, নিজের মনের স্বার্থে সঙ্গী হবে। মানব-মানবীর প্রেমের মতো সুন্দর এবং আকর্ষণীয় ব্যাপারকে উপেক্ষা করার ক্ষমতা প্রকৃতিও হয়তো দেয়নি মানুষকে।
একা মানেই নিঃসঙ্গতা নয়। কেউ কেউ হাজার মানুষের মধ্যে থেকেও একা, কেউ একা থেকেও একা না। লোনলিনেস ডিপ্রেশনের অন্যতম কারণ, কিন্তু লোনলিনেসকে যদি সলিটিউডে রুপান্তরিত করা যায় সেটা চমৎকার নিঃসন্দেহে। একলা থাকাটা অযোগ্যতা না, বরং অনেক বড় যোগ্যতা। মানুষ জন্মে একা, মরেও একা, কিন্তু জন্মের পর থেকেই মানুষের কাছে থাকে, কাছে যাওয়ার চেষ্টা করে। মানুষ মূলতঃ ভয় পায় একাকিত্বকে। একাকিত্বের ভয় মৃত্যু ভয়ের সমান, কিংবা একলা হয়ে যেতে হবে বলে মৃত্যুকে এতো ভয় পায় মানুষ। যারা এই ভয়কে জয় করতে পারে তার অনন্য।