ডেইজী বিশ্বাস:
আমার ছেলে অষ্ট্রেলিয়াতে জন্মেছে। এই জন্মানোর কাহিনীটি বা অভিজ্ঞতাটা অন্য দশটা মায়ের মতো না আমার। প্রায় ১৮ মাস চেষ্টার পর যখন আমরা জানতে পারি আমরা বাবা-মা হতে যাচ্ছি, সেই আনন্দ রাখার জায়গা ছিল না আমাদের। সবকিছু বইয়ের নিয়মে করেও শেষ রক্ষা হলো না। অষ্ট্রেলিয়াতে যদিও সব চিকিৎসা ফ্রি এবং উন্নতমানের, তবুও আমরা প্রাইভেটে গেলাম আরও বেশি করে সবকিছু নিশ্চিত করতে, অনেক টাকা খরচ করে। কিন্তু ২৮ সপ্তাহ থেকে আমার কিছু কমপ্লিকেশন আর মাত্র ৩১ সপ্তাহে আমার ছেলে জন্মালো কোটিতে একটা হয় এমন এক দুর্ভাগ্যজনক সমস্যা নিয়ে। জন্মানোর তিন ঘন্টার মধ্যে ওর বাউওল সার্জারি হয়। দুই সপ্তাহ কোন রকমে ওষুধ দিয়ে আমার বুকের দুধ সামান্য পাওয়া গেলেও এরপর আর কোনভাবেই কিছু হয় না। মাত্র দিনে ১২ মিল দিয়ে শুরু করেছিল। তাই শুরুতে সমস্যা হয়নি। দুই সপ্তাহ পর দিনে যখন ১৮০ মিল দুধ দিচ্ছে আইভি লাইন দিয়ে এবং সে সময় কোনভাবেই ফরমুলা দেয়া যাবে না, কারণ ওর অপারেটেড গাট নিতে পারবে না, তখন আর কোনভাবেই আমার দুধ আসে না। যদি মিল্কব্যাংক না থাকতো জানি না আমার বাচ্চা সুস্থ হতে কতদিন লাগতো বা আদৌ হতো কিনা! কোন এক হয়তো অভাগা মায়ের দুধ বাঁচিয়ে দিয়েছিল আমার ছেলেকে।
বলছিলাম মিল্কব্যাংক নিয়ে। অনেক প্রিমি এমনকি ফুলটার্ম বাচ্চার জন্মের পর পর নিজের মায়ের বুকের দুধ আসতে যে কয়দিন লাগে সে কয়দিনে মিল্কব্যাংকের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। ডি-হাইড্রেটেড হয়ে মারা যাওয়ার ঘটনা কিন্তু কমন। আবার অনেক প্রিমি বাচ্চা দুর্বল গাট নিয়ে জন্মানোর কারণে ফরমুলা নিতে পারে না। এছাড়াও আমরা জানি না এমন হাজারটা কারণ আছে। যেমন সার্জারি হওয়া নিউবর্ন।
আমি ১৯ দিন আমার ছেলে নিয়ে সার্জিক্যাল নিকিউ (Surgical Neonatal Intensive Care Unit) তে ছিলাম। পরে আরও ২১ দিন জেনারেল নিকিউতে। ব্রেস্টমিল্ক পাম্প করার জন্য খুব আরামদায়ক রুম ছিল। কিন্তু সেই আরাম আমরা সব অসহায় মায়েদের তেমন আরাম দিতো না। সবার মুখেই ছিল কষ্ট। কারণ সার্জারি হওয়া নিউবর্ন বাচ্চাগুলোকে বাঁচাতে মায়েদের বুকের দুধ জরুরি। বাচ্চাগুলো এখনও মায়েদের বুকের গন্ধ নেয়নি। মায়েরা এখনো বুকে জড়িয়ে তাদের সদ্য জন্ম নেয়া বাচ্চাগুলোকে আদর করেনি। এইভাবে বাচ্চার একটা ছবি নিয়ে (বুকের দুধের সাথে ইমোশন এবং হরমোন জড়িত, তাই বাচ্চার ছবি এক্সপ্রেস করার জন্য সাহায্য করে) এক্সপ্রেসের চেষ্টার চেয়ে নিজের বুকের রক্ত দিতে বললে তখন বেশি সহজ হতো। তবুও কী অদম্য চেষ্টা!
কেন এসব বলছি? যে বাবা-মার সন্তানরা বিভিন্ন কারণে জন্মের পর শুধু বুকের দুধের জন্য মারা যাচ্ছে সে বাবা-মাই জানে এর কষ্ট। ধর্মের পশ্চাতদেশে এতো চুলকানি কোথা থেকে আসে আমি বুঝি না! এসব বলতে আর ভালো লাগে না। কিন্তু না বলতে চেয়েও না বলা কঠিন। সবকিছুতে বান্দরের কাঠি পশ্চাতদেশে লাগিয়ে লাফাতেই হবে? আধুনিক চিকিৎসার কতটুকু কোন ধর্মের বইতে লিখা আছে? হাজার বছরের পুরানো কয়েকটা বইতে কি কাভার হয়ে গেছে সবকিছু? আমার বাচ্চাকে কি ধর্ম বাঁচিয়েছিল নাকি ডাক্তার? মুসলিম বিশ্ব যতোই লাফালাফি করুক শুধু বছর বছর পয়দা করেই তারা লালা ঝরানো উন্নত দেশের মতো হতে পারবে না, শুধু লালাই ঝরতে থাকবে। বাংলাদেশের ধর্মগরুরা মিল্কব্যাংকের বিপক্ষে দাঁড়িয়ে গেল, আর ছাগলদের পাতা খাওয়াতে সরকার বন্ধ করে দিল মিল্কব্যাংক!!
সমস্যা হচ্ছে সুশীলরা এখন চুপ। তারা কিছু বলবে না। শুধু তখন লাফাবে যখন নিজের সন্তানের জীবন সংশয় হবে। আর কাল যদি এই মিল্ক ব্যাংকের সুবিধা চালু হয়, তাহলে কি মোল্লারা তাদের নিজেদের সন্তানের জীবন বাঁচাতে সেই দুধ ব্যবহার করবে না? আর একটা দেশে চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নতিতে কী কী সংযোজন হবে, সেটা কেন সবাইকে জানাতে হবে? প্রথমে নিয়ম আর আইন প্রণয়ন হবে, পরে সেটা জানতে পারবে মানুষ। সেটাই কি হবার কথা না? কেন মরার ওই দেশে জন্মেছিলাম কে জানে এতো দেশ থাকতে! না জন্মাতাম, দেখতামও না এসব!