নাহিদ দীপা:
আরাধ্য বীর যেদিন কোল জুড়ে এলো, সেদিন থেকেই এক নতুন যুদ্ধ শুরু হলো। তাকে শাল দুধ খাওয়ানো হয়েছে, কিন্তু ওর নি:শ্বাস নিতে সমস্যা হওয়ায় নিয়ে যাওয়া হলো এনআইসিইউতে। সকাল হলো, সে এলো এনআআইসিইউ থেকে আমার কাছে। কিন্তু কিছুতেই তাকে বুকের দুধ খাওয়াতে পারছি না। না ঠিকমতো নিজে বসতে পারছি, না ওকে ঠিকমতো ধরতে পারছি, না ওকে দুধ খাওয়াতে পারছি। দুচোখ ফেটে কান্না আসছে। কত কত প্রস্তুতি ওকে বুকের দুধ খাওয়ানোর, সবই যেন বৃথা যেতে বসলো।
বাচ্চাটাকে একফোঁটা দুধ দিতে পারছি না। দুধ খেতে পারছে না বলে, হিসুও করছে না। না খেতে পেয়ে আরাধ্য কান্না শুরু করলো। ডাক্তার বললো, আরেকটু অপেক্ষা করতে। বাচ্চা যখন ঠিকঠাক এসেছে দুনিয়ায়, সে তার রিজিক নিয়েই এসেছে। বাইরের দুধের দরকার নাই।
এদিকে আমার মা অস্থির হয়ে গেছে। আমার বর ডাক্তারের কথামতো কিছুতেই বাইরের দুধ দিতে দিবে না। সন্ধ্যায় ত্রাতার মতো হাজির হলো আমার মামাতো ভাইয়ের বউ। ওর বাচ্চা তখনও দুধ খায়। সে এসে দুধ খাওয়াতেই যেন জানে পানি পেলাম সবাই।
আমার ভাইয়ের বউ দুধমা আমার আরাধ্যর। দুদিন পরে বাসায় ফিরলাম ঠিকই, কিন্তু তখনও বুকের দুধে পেট ভরে না ছেলের। কী না করছি আমি! ওষুধ খাই, লাউ খাই, কালো জিরা খাই। ঝোল দেয়া মুরগি, শিং মাছ…কিছুই বাদ নাই। যে যা বলে, খাচ্ছি। পাঁচ দিন পরে ছেলের জন্ডিস ধরা পড়লো। দুধ কম খাওয়ানো আর মেঘলা আবহাওয়ায় সূর্যের দেখা না পেয়ে তাকে আবার ভর্তি করানো হলো এনআইসিইউতে। টেনশনেই কিনা কে জানে, তাকে এনাআইসিইউতে রাখার পর আমার বুকে যাও বা দুধ এসেছিল, নাই হয়ে গেল। নাই তো নাই, একেবারেই। কী করবো!! উপরওয়ালার নাম নিতে নিতে, ওষুধ আর দুধ হয় এমন খাবার খেতে খেতে একদিনে সে অবস্থার উন্নতি হলো। ছেলে সুস্থ হলে বাড়ি ফিরলাম। এরপর আর সমস্যা হয়নি ছেলেকে দুধ খাওয়াতে। জন্মের সময় একদম মেপে মেপে আড়াই কেজি ওজন, পরপর দুবার এনআইসিইউ ঘুরে আরাধ্যর ওজন কমে গেল ২১শ গ্রামে। ডাক্তার বললো, ভয়ের কিছু নাই। নির্দিষ্ট বিরতিতে বুকের দুধ দাও, এই ওজন ফিরে পেতে তোমার বীরপুত্রের এক সপ্তাহও লাগবে না। সেই থেকে শুরু করে আর সমস্যা হয়নি। একমাস বাদে নিউমোনিয়ার প্রাথমিক ধাপে পৌঁছেও সে তাকে টেক্কা দিতে পেরেছে কেবল ওই বুকের দুধ খাওয়ানোর জোরেই। নবজাতকের জীবন বাঁচাতে আর অপুষ্টি রোধে মায়ের দুধের বিকল্প কিছু নেই, কিছুই নেই।
এই লম্বা ইতিহাস কেন বলছি? এবার আসি সেই কথায়।
কেন বুকে দুধ আসছে না, কী করা যায়, এই নিয়ে যতবারই গুগলের সাহায্য নিয়েছি, ততবারই তারা প্রথম সাজেশন দিয়েছে অন্য কোনো মায়ের দুধ খাওয়াতে। না পেলে মিল্ক ব্যাংক থেকে সংগ্রহ করতে। তখনই প্রথম জানলাম, ব্লাড ব্যাংক, স্পার্ম ব্যাংক, এগ ব্যাংকের মতো, হিউম্যান মিল্কেরও ব্যাংক হয়।
আসলেই? কিন্তু বাংলাদেশে কোথাও নেই। তখনই মাথায় ঢুকছিল, কেন নেই? মায়ের বুকের দুধ যেখানে নবজাতকের সর্বরোগের দাওয়াই, প্রাণরক্ষাকারী, সেই দুধের কেন ব্যাংক নেই? কেন কেউ এর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করে না? আমার ছেলেকে যতবারই দুধ খাওয়াতাম, ততবারই ভাবতাম কী করা যায়? কীভাবে শুরু করা যায়? কতোটাই বা সামর্থ? আমাদের রাসুল (সা:) এরও তো দুধ মাতা ছিলেন হালিমা। তাহলে কেন কেউ কোন উদ্যোগ নেয় না? তখন আমাকে দুই একজন বললেন, দুধ মাতা হবার নির্দিষ্ট কিছু নিয়ম আছে। কিন্তু সেটাই কি একমাত্র অন্তরায়?
দুদিন আগেই সংবাদ মাধ্যমে দেখলাম বেসরকারি আর্থিক সহায়তায় ঢাকা জেলার মাতুয়াইলের শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের (আইসিএমএইচ) নবজাতক পরিচর্যা কেন্দ্র (স্ক্যানো) এবং নবজাতক আইসিইউ (এনআইসিইউ)-এর নিজস্ব উদ্যোগে স্থাপিত হয়েছে দেশের প্রথম মাতৃদুগ্ধ ব্যাংক। দারুণ আনন্দ নিয়ে খবরটা পড়ছিলাম আর ভাবছিলাম, এই দেশে কোনো ভালো উদ্যোগই তো ভাত পায় না। এই উদ্যোগের বাঁশ দিতে না জানি কোন কোন বাঁশঝাড়ের বাঁশ কাটা হচ্ছে! বেশিক্ষণ না, একদিনের মধ্যেই শুরু হয়ে গেল এর বিরুদ্ধে প্রচারণা। ফেসবুকে খুবই পপুলার একটি গ্রুপে এর বিরুদ্ধে প্রথম একজনের পোস্ট দেখি আমি। আর তা ভাইরাল হতে থাকে বিভিন্ন গ্রুপে। যেখানে হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ বলেছে, ইসলামী নীতি মেনেই পরিচালিত হবে এই উদ্যোগ। বিশ্বের বিভিন্ন মুসলিম দেশে সফলভাবে পরিচালিত হচ্ছে এই মিল্কব্যাংক। মানুষ চাইলে অসম্ভব কিছু না। আমি এটা বিশ্বাস করি।
নবীজির জীবন দিয়ে যে শিক্ষা আমরা নিতে পারি না বরং একটার পর একটা বাধা দাঁড় করাই, মিল্ক ব্যাংকের বিরুদ্ধে প্রচারণা এর অনন্য উদাহরণ। দুধ মাতা যে হবে, তার বাচ্চাদের সাথে বিয়ে হবে না। যারা এর বিপক্ষে তারা আছেন এক ওই বিয়ে নিয়ে। আরে বাচ্চাটা বাঁচলে তবেই না তার বিয়ে হবে!
মাতুয়াইল শিশু-মাতৃস্বাস্থ্য ইনস্টিটিউট যে উদ্যোগ নিয়েছে, তা ছড়িয়ে পড়ুক সারা দেশে। দেশের ৬৪টা জেলায়, সরকারি উদ্যোগে সরকারী হাসপাতালেই তৈরি হতে পারে এই মিল্ক ব্যাংক। ব্রাজিলে সবচেয়ে বেশি (২১৬ টি) হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক রয়েছে, যার মাধ্যমে ২৮ শতাংশ নবজাতকের মৃত্যু রোধ এবং ৭৩ শতাংশ শিশুর অপুষ্টি রোধ করা সম্ভব হয়েছে। এমনকি ভারতেও ব্যাংক স্থাপনের পর নবজাতকের মৃত্যু রোধ করা সম্ভব হয়েছে।
মুসলিম দেশের মধ্যে কুয়েতে প্রথম হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক স্থাপন করা হয়। এ ছাড়া ইরান, ইরাক, আরব আমিরাত, মালয়েশিয়া ও পাকিস্তানসহ অনেক মুসলিম দেশ হিউম্যান মিল্ক ব্যাংক প্রতিষ্ঠা করেছে। (তথ্য, প্রথম আলো) আর যেখানে নবীজির জীবনের সাথে ওতোপ্রতোভাবে জড়িয়ে আছে মা হালিমার নাম, সেখানে যারা ধর্মের ধুয়ো তুলছেন, তাদেরই বা কী স্বার্থ?
সবশেষে এটাই বলি, শুভ বুদ্ধির উদয় হোক আমাদের।