শুভ প্রসাদ নন্দী মজুমদার:
যাচ্ছি শিলচর। আসামে আমার শেকড়। এটা এ জন্যে নয় যে দেশভাগের বলি হয়ে আমার পিতৃ প্রজন্মের মানুষেরা আসামে এসেছিলেন। দেশভাগ না হলেও আমার শেকড় আসামই থাকতো। কারণ আমাদের জেলা সিলেট তখন আসামেরই অংশ ছিল। আমার জন্মও আসামেই। বিভাজিত ভারতের আসামেই। কিন্তু সেটা এখন আর আসাম নয়। শিলং, মেঘালয় নামের স্বতন্ত্র প্রদেশের রাজধানী। আমার বড় হওয়া শিলচরে। সেটা এখনও আসামে, তবে আসাম রাজ্যে তার মনস্তাত্ত্বিক অন্তর্ভুক্তি আজো ঘটেনি। এমন বিচিত্র ভাঙাগড়া, এমন বিচিত্র সাংস্কৃতিক সংঘর্ষ ও সমন্বয়ে গড়ে উঠেছে আজকের আসাম। এই আসামের সাথে ব্রিটিশের তৈরি আসাম প্রদেশের অনেক তফাৎ। আবার ব্রিটিশ আসার আগেকার আসামের সাথেও তার তফাৎ অনেক। এটা আসাম রাজ্যের ভেতরের মানুষই বুঝে ওঠেন না। অবশিষ্ট ভারতের মানুষের বোঝা আরো মুশকিল।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের বিরুদ্ধে আসামসহ উত্তর পূর্বে ছড়িয়ে পড়া আন্দোলন নিয়ে কলকাতার বন্ধুরা আমাকে জিজ্ঞেস করেন, এটা কি বাঙালি বিরোধী আন্দোলন? এটাকে ষাট সত্তর আশির বাঙালি বিরোধী আন্দোলনের সাথে একাকার করে দেখলেও ভুল। আবার এই বিক্ষোভ প্রতিবাদে অনুমাত্র বাঙালি বিদ্বেষ নেই বললে সত্যের অপলাপ হবে।
নাগরিকত্ব সংশোধনী আইনের দু’টি দিক আছে। এটা শুধু ধর্মনিরপেক্ষতার মূলে আঘাত নয়। এই আইনে উত্তর পূর্বের স্থানীয় জনগোষ্ঠী বলে পরিচিত সমাজ নিজেদের অস্তিত্বের বিপদ দেখে। উপমহাদেশের একটি অংশের বিস্থাপিত মানুষকে ঘর দেওয়ার উদ্যোগে ওরা নিজেদের ঘর হারাবার বিপদ দেখতে পায়। ব্রিটিশ ভারতেই ঔপনিবেশিক শাসকদের নানা সিদ্ধান্তে অসমীয়া বাঙালির মধ্যে অবিশ্বাস ও বিদ্বেষের বাতাবরণ তৈরি হয়েছিল। বাঙালি জনগোষ্ঠীর জীবিকার প্রয়োজনে হওয়া ব্যাপক হারে আগমন এখানকার স্থানীয় মানুষের মধ্যে বিপন্নতা ছড়িয়েছে। এই বিপন্নতাকে উপজীব্য করে শাসক শ্রেণি ৭০ বছর ধরে বিভেদের রাজনীতি করেছে।
১৯৮৫ সালের পর ৩৪ বছরে সাধারণ মানুষের মধ্যে যখন বিনিময় ও সহযোগিতার একটা স্বাভাবিক বাতাবরণ তৈরি হচ্ছিল, তখন এই নাগরিক সংশোধনী আইন খুঁচিয়ে পুরোনো ঘা’কে নতুন জীবন দিয়েছে। ওরা ভেবেছিলেন হিন্দু মুসলমান করে অসমীয়া-বাঙালি বিরোধ ভুলিয়ে দেবেন। আরেকদল ভেবেছেন পুরোনো জাতীয়তাবাদকে চাগিয়ে বিজেপির সাম্প্রদায়িকতা রুখবেন। সবই ব্যর্থ হয়েছে।
এখন সব বিভাজন পুরোমাত্রায় দেখা দিয়েছে। আসামের এবারের বিক্ষোভের তেমন কোনো স্পষ্ট নেতৃত্ব নেই, ফলে একটা বাঙালি বিরোধী হিংসার দিকে যাওয়ার ভয় আছে। তবে যে সংগঠনগুলি সাংগঠনিক ভাবে আন্দোলন করতে চাইছেন, তারা বারবারই বলছেন, এই আন্দোলন কোন জনগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে নয়। হিংসা পরিহার করে গণতান্ত্রিক পথে সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করতে হবে। কিছুটা সাড়া হয়তো পাওয়াও যাচ্ছে। অসমীয়া সমাজের শুভবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরা বারবার বলছেন, এই আন্দোলনকে শুধু জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের সংকটের সংগ্রাম হিসেবে দেখলে হবে না। দেখতে হবে ভারতীয় রাষ্ট্রব্যবস্থার ধ্বংস রুখে দেওয়ার সংগ্রাম হিসেবে।
সারা দেশের নাগরিকত্ব সংশোধনী বিরোধী আন্দোলনকেও শুধু ধর্মনিরপেক্ষতার কথা বললে হবে না। উত্তর পূর্বের মানুষের মনে জন্ম হওয়া আতঙ্কের প্রশ্নকেও বিবেচনায় আনতে হবে। উপমহাদেশের নানা অংশ থেকে আসা নির্যাতিত মানুষকে নাগরিকত্ব দেওয়ার জন্য বিদ্যমান আইনেই যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। ইহুদীদের বাসস্থানের ব্যবস্থা করতে গিয়ে যেমন প্যালেস্টাইন সমস্যার সৃষ্টি হয়েছিল, তেমন ঘটনার পুনরাবৃত্তি করা উচিত নয়।
পশ্চিমবঙ্গে যে হিংসাত্মক প্রতিবাদ হচ্ছে, তাকে পুরোপুরি স্বতঃস্ফূর্ত মনে হচ্ছে না আমার। এই হিংসায় যাদের রাজনৈতিক অবস্থান মজবুত হয়, তারা গোপনে কলকাঠি নাড়ছেন কিনা সে খবর নেওয়া জরুরি। কারণ হিংসা যত ছড়িয়েছে, তার চেয়ে বহুগুণ দ্রুততায় ছড়াচ্ছে ফেক ভিডিও ও ফেক ছবি। সন্দেহটা এখানেই।