কথা হলো – “মেয়ে হয়ে”!

তানবীরা তালুকদার:

বাংলাদেশের একটা মেয়ে সবচেয়ে বেশি যে বাক্যটা শুনে বড় হয়, তা সম্ভবত, মেয়ে হয়ে এটা করা কিংবা ওটা করা শোভা পায় না। যেমন, মেয়েদের এভাবে পা ছড়িয়ে বসতে নেই, আগে খেয়ে নিতে নেই, জোরে কথা বলতে নেই, আগে কোন কিছু ধরতে নেই, চোখ তুলে হাঁটতে নেই, হাঁটার সময় চোখ থাকবে নিচের দিকে, কারণে-অকারণে হাসতে নেই, ইত্যাদি ইত্যাদি ইত্যাদি অনেক কিছু।

অনেক আগে একবার নিউমার্কেটের দুবাই মার্কেটে কিছু কেনাকাটা করছিলাম। এক দোকানে একটা সুন্দর ফ্রেমের ওপর গ্লাসটপ টেবল এডভান্স করে অন্য দোকান ঘুরছিলাম। অন্য দোকানে অন্য জিনিসের সাথে গ্লাসটপের আর একটা ফ্রেম খুব পছন্দ হয়ে যায়। আমি আম্মিকে বললাম, ওটা ক্যান্সেল করে এটা নেই?
আম্মি বললো, কখনও এডভান্স ফেরত দেবে না, এটা বাংলাদেশ।
আমি বললাম, জিজ্ঞেস করে দেখি, অন্য জিনিস তো নিয়েছি ওদের কাছ থেকে।
জিজ্ঞেস করলাম এবং অবিশ্বাস্যভাবে, দোকানদার রাজি হয়ে গেলো। আমি বার বার বললাম, আপনি শিওর? তিনি বললেন, অবশ্যই আপা, ঠিকাছে। বাকি জানিস বার্নিশ হচ্ছে, আপনি কাজ শেষ করে আসেন।

আমি কাজ শেষ করে এসেছি পরে, বাকি জিনিস দেবে, কিন্তু ব্যালেন্সের টাকাটা দেবে না। আমি হতবাক হয়ে বললাম, আপনি না বললেন, ফেরত দেবেন?
দোকানদার অম্লান বদনে বলে, মাগরেবের আজানের আগে হইলে দিতাম, এখন দেবো না, আজানের পর বনি হয় নাই, দোকান বন্ধের টাইম।
আমি বললাম, কখন দেবেন তাহলে?
তিনি অপারগ, দেবেনই না।
অবস্থা বেগতিক দেখে আম্মি বলছে, থাক, ছাড়, ক’টা টাকাই আর।
আমি রাগ সামলাতে না পেরে বললাম, অসম্ভব, ছাড়বো মানে? দরকার হলে দোকানের পাঁচটা জিনিস ভেঙে আমি পয়সা উসুল করে যাবো।
আমার কথা শুনে এবার দোকানদার অবাক মুখে আমার দিকে তাকিয়ে রইলো।

এ সমস্ত সময়ে, “রঙ চাওয়ার” জন্যে বাংলাদেশের সমস্ত জায়গায় কিছু মানুষ জড়ো হয়, তার মধ্যে দু’ একজন থাকে পরোপকারী, স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে দুই দলের মধ্যে সমঝোতা করিয়ে দিতে চায়।
তো আমি সেই সমঝোতা পার্টিকে পাত্তা না দিয়ে বলে চলছি, টাকা ফেরত দেবেন না জিনিস ভাঙবো, শিগগির জানান।

একজন দাড়িওয়ালা আঙ্কেল পাত্তা না পেয়ে বিরক্ত হয়ে আমাকে ধমকে উঠলেন, চুপ করো, মেয়ে হয়ে এসব কি মাস্তানের মতো কথা? মেয়ে না তুমি? মেয়েদের মুখে এসব কী কথা? মেয়ে হয়ে মাস্তানী করো?
বলাবাহুল্য, টাকা ফেরত নিয়েই সেই সন্ধ্যেই আমি বাড়ি ফিরেছি। ছেলে বা মেয়ে হওয়া নিয়ে মাথা ঘামাইনি, টাকা ফেরত না দিলে কিছু না কিছু আমি ভাঙতাম তাতেও কোন সন্দেহ নেই।

নানা প্রয়োজনের খাতিরে আমাকে বাসে, ট্রেনে, প্লেনে একা একা যাতায়াত করতে হয়েছে। প্লেনে এক মহাদেশ থেকে অন্য মহাদেশও পাড়ি দিয়েছি। কিন্তু আটকে গেছি যখন কলকাতা থেকে ঢাকায় এলাম। ঢাকা কাস্টমস আমার স্যুটকেস আটকেছে। আমি গেলাম, স্যুটকেস আনতে। কাস্টমসের ভাই, আমার স্যুটকেস হাতে ধরে রেখে আমাকে বলেন, স্যুটকেস খুলতে হবে, কথা আছে।
আমি বললাম, কী কথা, বলেন আর স্যুটকেস কেন খুলতে হবে? অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের গলায় তিনি বললেন, মেয়েমানুষ আপনি, আপনার সাথে কী কথা বলবো, আপনার সাথের পুরুষলোক কই, তাকে ডাকেন। অবিশ্বাস্য চোখে আমি তাকিয়ে রইলাম কিছুক্ষণ, বাংলা ভাষা বুঝতে পারছিলাম না। কাস্টমস আমার সেই দৃষ্টিকে উপেক্ষা করে অন্যদিকে ব্যস্ত হয়ে গেলো। সবসময় আমার সাথে পুরুষ থাকে না, দৈবাৎ সেবার ছিলো তাই আমি স্যুটকেস ফেরত পেয়েছিলাম, বলাবাহুল্য সেটাও নানা বাকবিতণ্ডার পর।

কোন ধরনের পড়াশোনা করার পর শুল্ক কর্মকর্তা হয় সে আলোচনা অবান্তর। পড়াশোনার আলোকে মানসিকতার পরিবর্তনের আশা আকাশ কুসুম চয়ন মাত্র। যে দেশে প্রায় নিরক্ষর সাংসদ থেকে বিসিএস করা ক্যাডার পুলিশ পর্যন্ত পার্কে প্রেম করাকে অপরাধ ভাবে, ছেলেমেয়েদের পুলিশের হাতে তুলে দেয়, মানুষের মৌলিক অধিকার সম্বন্ধে এতোটুকু জ্ঞান না থাকলেও যেখানে সংসদ আলোকিত করা যায়, সেখানে শুল্ক কর্মকর্তার পড়াশোনা, মানসিকতার চুলচেরা বিশ্লেষণে আর কী যায় আসে!

মেয়ের অসুখ তাকে নিয়ে ডাক্তারের কাছে গিয়েছি। তাকে নানারকম পরীক্ষা করা হচ্ছে, আমি আছি তার সাথে সাথে। হঠাৎ করে ডাক্তারের প্রশ্ন, আপনি একা কেন? আপনার সাথে লোক কই?
মেয়ের কী হয়েছে কী হয়নি তার নিয়ে নানা প্রশ্নের জবার দিচ্ছি আমি, পাশে পাশে আছি আমি, ফর্ম ফিলাপ করছি আমি, কিন্তু না এতেও হবে না। সাথে একজন লোক থাকতে হবে।

এখানেই কি শেষ হয়? না হয় না, এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে গিয়েছি, এক বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের জ্যষ্ঠ কর্মকর্তা যিনি ঐ সাংস্কৃতিক দলের একজন কর্ণধারও বটে, তার সাথে কোনো ব্যাপারে একটু তর্ক হয়ে যেতেই যুক্তিতে হেরে উনি ফট করে বলে উঠলেন, আমি মহিলাদের সাথে কথা বলি না।

বেড়াতে যাবো সবাই মিলে দল বেঁধে। যথারীতি টিকেট কাটা হয়েছে, বাস কাউন্টারে বসে আছি, বাস এলে মাল জমা করে দিয়ে উঠে পরবো। বাস এলে সবাই দল বেঁধে যেই না উঠতে গেছি ওমনি বাসের ম্যানেজার জিজ্ঞেস করলো, আপনাদের গার্জেন কোথায়? আমরা সবাই চাকুরি করা মেয়ে, বাচ্চাকাচ্চার মা, সাথে বাচ্চারাও আছে। অবাক হয়ে জানতে চাইলাম, গার্জেন মানে? বাসের ম্যানেজার আবার রিকনফার্ম করলো, পুরুষলোক গার্জেন।

জীবনের বিভিন্ন অভিজ্ঞতার টুকরোগুলোকে একসাথে করলাম। আর এই অভিজ্ঞতা হয়নি বাংলাদেশে এমন মেয়ে পাওয়া দুর্লভ। বিভিন্ন শ্রেণী, পেশা, শিক্ষা দীক্ষার মানুষের কাছ থেকে পাওয়া প্রতিক্রিয়া গুলোকে বিশ্লেষণ করলে যে চিত্র পাওয়া যায়, তাহলো, একটা মেয়ে তার বয়স, শিক্ষা, পেশা যাই হোক না কেন, যেকোনো পরিস্থিতিতে, পরিবেশে তাকে একজন পুরুষের সাথে চলাফেরা করতে হবে, সেটা হলো সমাজের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। আর কোন কারণে নিজের মত কিংবা স্বাবলম্বী নারী আজও ভারতীয় উপমহাদেশে একটি অস্বাভাবিক প্রক্রিয়া।

একজন স্বাবলম্বী নারী কখন বিয়ে করবে, কাকে বিয়ে করবে, কেন বিয়ে করবে তা নিয়ে প্রায় গোটা জাতি আজ দ্বিধাবিভক্ত। আগের দিনের একটা গান মনে পড়লো, “গাছে বেল পাকিলে তাতে কাকের কী?”
আচ্ছা, গুলতেকিন খান কত বিনিদ্র রাত কাটিয়েছে, কতখানি চোখের জলে ভেসেছে, আজকে যারা তাদের বিদগ্ধ রায় দিতে ব্যস্ত তারা জানে কি? কত ঘুমের ওষুধ কিংবা সাইক্রিয়াটিস্টের সাহায্য? এই এতোদিনে গিয়েছিলেন কেউ তার কাছে? খোঁজ নিয়েছিলেন কেউ, জিজ্ঞেস করেছিলেন, কেমন আছো, কেমন কাটে দিন, কেমন চলছে জীবন? রেলমন্ত্রী বিয়ে করেছেন, করেছিলেন প্রয়াত আব্দুস সামাদ আজাদও। তাদের বেলায় প্রথম দ্বিতীয় তৃতীয় কথাটি আসেনি, আসেনি ছাপ্পান্নো কিংবা ছেষট্টির প্রশ্নও। এসবই গুলতেকিন মেয়ে বলেই কি? সাদা শাড়িতে জীবন পার? আমাদের এই অভ্যস্ত চোখে কপালে রঙিন টিপ বড্ড বেমানান লাগে বুঝি?

মেয়ে বলেই বান ডাকা জোস্ন্যায় চাঁদ দেখতে নেই, গুনগুন বাতাসে গান গাইতে নেই, টিপটিপ বৃষ্টিতে মন ভেজাতে নেই, হৃদয় রাঙিয়ে কবিতা লিখতে নেই, প্রেমের উথাল-পাথাল জোয়ারে ভাসতে নেই, নেই বুঝি?

১৪।১১.২০১৯

শেয়ার করুন: