নতুন মায়েদের স্বাস্থ্য নিয়ে কয়জন ভাবে!

সাবরিনা স. সেঁজুতি:

ভেবেছিলাম মা হওয়া বিশেষ কোনো অনুভূতি। কিন্তু পেট কেটে বাচ্চাটা বের করার পর শারীরিক যন্ত্রণা ছাড়া বিশেষ কোনো অনুভূতি অনুভব করিনি সেদিন। ধীরে ধীরে শারীরিক সুস্থতা ফিরে এলেও মানসিক সুস্থতা ফিরে আসেনি। হরমোন তার খেলা দেখিয়েছে। সদ্যোজাত শিশুটির প্রতি ভালোবাসা কম বরং নিরাপত্তা নিয়ে দুশ্চিন্তা হয়েছে বেশি। দুশ্চিন্তা থেকে জন্ম নিয়েছে ভয়।

বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে গর্ভবতী বা নতুন মায়েদের মানসিক সুস্থতা তো দূরে থাক বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তার শারীরিক সুস্থতা নিয়েও আশেপাশের লোকজন তেমন একটা ভাবেন বলে মনে হয় না। তাই মায়েদের সুস্থ হয়ে উঠতে সময় লাগে অনেক বেশি। কেউ কেউ বছরের পর বছর মানসিক ও শারীরিক অসুস্থতায় ভোগেন। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পরিবার বা তার আশেপাশের লোকজন সেটা বুঝেও বুঝে উঠতে পারেন না। কারণ নিজের তাগিদে জ্ঞানার্জন করা ছাড়া অন্য কোন মাধ্যম এখনো বাংলাদেশে প্রতিষ্ঠিত নয়।

এ বিষয়ক বেশ কয়েকটি সুন্দর তথ্যমূলক লেখা পড়ার সুযোগ আমার হয়েছিল, কিন্তু বাংলাদেশে নারী জীবনে এই লেখাগুলো আসলে কতটুকু প্রভাব ফেলেছে বা পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয়েছে, তা আমার অজানা। আমার ধারণা অল্পকিছু ভুক্তভোগীরা ছাড়া বেশিরভাগ পাঠকই এ বিষয়ক লেখা এড়িয়ে যান।

আমার মনে আছে, ডেলিভারির পর সেই ভয়ংকর সময়ে চেনা-অচেনা অনেক মানুষ ভীড় জমিয়েছিল হাসপাতালে-বাড়িতে। কিন্তু মানসিকভাবে পাশে ছিল না কেউ। সদ্যোজাত শিশুটির পাশে থাকা যেমন জরুরি, শিশুর মায়ের পাশে থাকাটাও যে জরুরি, সেটা আমাদের সংস্কৃতিতে বোধ হয় নেই বা কখনোই ছিল না। আমার অসম্ভব ভালো জীবনসঙ্গী মানে আমার মেয়ের বাবাকেও সেই সময়ে আমি মানসিকভাবে পাশে পাইনি।

প্রথমবার বাবা হওয়ার অনুভূতি তাকে যতো না আনন্দ দিয়েছিল, তার থেকে অনেক বেশি আতংকিত করেছিল বলেই আমার ধারণা। তার অবস্থা ছিল অনেকটা অন্ধের মতো ঢাকার ব্যস্ত রাস্তায় খালি পায়ে নেমে পড়ার মতো। তাই পোস্ট অপারেটিভ রুমে আমার ক্লান্ত মুখশ্রী দেখে সে যারপরনাই হতবাক। নাটক-সিনেমায় সে দেখেছে নায়িকা নতুন বাচ্চা কোলে নিয়ে ঠোঁটে লিপস্টিক দিয়ে হাসপাতালের বিছানায় অধীর আগ্রহে নায়কের জন্য অপেক্ষা করেন। সেখানে আমি কিনা চোখ মেলেই তাকাতে পারছিলাম না।

কী একটা বিব্রতকর অবস্থা, ভেবে দেখুন! শুধু তার হাতটা ধরে বলেছিলাম-দেখোতো কে এসেছে? আনন্দ অগ্নি নাকি শাশ্বত সত্য?

অনেক ভেবে অনেকদিন আগে নাম দুটো ঠিক করা হয়েছিল। মেয়ে হলে নাম রাখবো আনন্দ অগ্নি আর ছেলে হলে শাশ্বত সত্য। ডেলিভারির আগেই আমরা জানতাম আনন্দ অগ্নি আসছে। তবু ডেলিভারির পর বাচ্চার মুখ দেখার আবেগটা থেকে যায়। কিন্তু আমি দেখতে পারিনি। কারণ ইমার্জেন্সি ভিত্তিতে আরেকটা অপারেশনের মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছিল আমাকে। বাচ্চার মুখ আমি দেখেছি অনেক পরে। আমি শুধু তার কান্নার শব্দ শুনেছিলাম।

তবে সকলেই যে আমার মতো অসুস্থ থাকেন তা কিন্তু নয়। প্রতিটা নারী যেমন ভিন্ন তেমনি তাদের গর্ভকালীন ও গর্ভ-পরবর্তী অভিজ্ঞতাও ভিন্ন ভিন্ন হয়ে থাকে। অজ্ঞতা আর অনুমান দিয়ে তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করা সম্ভব নয়। সেজন্য প্রয়োজন সু-পরিকল্পিত শিক্ষাব্যবস্থা।

বাংলাদেশের প্রাতিষ্ঠানিক ও সামাজিক শিক্ষা ব্যবস্থা আমাদের কচি বয়সে যতো দ্রুত যোগ-বিয়োগ, গুণ-ভাগ, বাংলা-ইংরেজি শেখাতে ব্যস্ত হয়, তার অর্ধেক চেষ্টায় হয়তো আমরা শিশু-কিশোর-কিশোরীদের জীবনমুখী শিক্ষা দিতে সক্ষম হবো। যে শিক্ষা তাকে যোগ-বিয়োগ শেখানোর পাশাপাশি বেঁচে থাকার কায়দা কানুনগুলোও শেখাবে। তাহলে হয়তো সুদূর ভবিষ্যতে বাবা-মা হবার মতো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে না।

অনেকেই হয়তো মনে করেন- আরে বাবা! সে আবার শেখার কী আছে, সময় হলেই একাই শিখে যাবে। কিন্তু কীভাবে? সেটা কি ভেবে দেখেছেন? শুধু আশপাশ দেখে শেখার সুযোগ আজকাল কতটুকু? আমি অস্বীকার করছি না যে একটা সময় ছিল যখন শিশুরা যৌথ পরিবারে বেড়ে উঠতো। বড় ভাই-বোন, সমবয়সী খালা-ফুপুদের দেখে জীবন সম্পর্কে জ্ঞানলাভের সামান্য সুযোগ থাকলেও সে শিক্ষা অসম্পূর্ণ ছিল বলেই আমার ধারণা। সম্পূর্ণ হলে সে শিক্ষা আজ হারিয়ে যেতো না। বিশেষ করে সন্তান পালন, গর্ভকালীন সেবা শুশ্রুষার মতো গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা।

অন্যদিকে নগর জীবন মানেই ছোট পরিবার। সেই ব্যস্ত নগর জীবনের ছোট পরিবারগুলোতে পারিপার্শিক শিক্ষা লাভের সুযোগ খুবই কম। সেখানে বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই বাবা-মায়ের সাথে সন্তানের সম্পর্ক চাহিদার বেশি, ভালোবাসার কম। এমনটাই উন্নয়নশীল দেশের নগর জীবনের স্বাভাবিক বৈশিষ্ট্য যা আমরা অস্বীকার করতে পারি না।

রাষ্ট্রের স্বার্থেই মানুষ গড়ে তুলেছে ছোট পরিবার। তাহলে অসম্পূর্ণ শিক্ষা পূর্ণ করার দায়িত্ব কার? রাষ্ট্রের নয় কি? শুধু কি সাক্ষরতার হার বৃদ্ধি নিশ্চিত করার পথে হাঁটলেই চলবে আমাদের? নাকি নর-নারী সকলের জন্য জীবনমুখী শিক্ষা নিশ্চিত করার পথেও হাঁটতে হবে?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.