ওরা নির্যাতন ও ধর্ষণের শিকার নারী শ্রমিক, ‘যৌনদাসী’ নয়!

অনুপম সৈকত শান্ত:

সৌদি আরবে নানাবিধ শারীরিক-মানসিক নির্যাতন-নিপীড়ন, যৌন নিপীড়ন বা ধর্ষণের শিকার হওয়া প্রবাসী নারী শ্রমিকদেরকে অনেকেই ‘যৌনদাসী’ হিসেবে উল্লেখ করছেন দেখলাম! সৌদি আরবকে ‘পতিতালয়’ হিসেবে উল্লেখ করে বাংলাদেশ সরকার কেন আমাদের নারীদের ক’টা টাকার লোভে পতিতাবৃত্তিতে নামিয়ে দিচ্ছেন- এই রকম আলাপও দেখছি! অনেক প্রগতিশীল, সুস্থ-স্বাভাবিক, মানবিক ব্যক্তিও যখন এসব বলেন তখন আসলে হতভম্ব হওয়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না!

এইসব নারীরা নিজেরা স্ব-প্রণোদিত হয়ে দুটো পয়সার উদ্দেশ্যে দূর প্রবাসে পাড়ি জমান, তাদের পরিবার-পরিজন এইসব নারীকে দূর প্রবাসে পাঠাচ্ছেন একটু স্বচ্ছলতার মুখ দেখবে বলে- সেকি পতিতাবৃত্তি করার জন্যে, যৌনদাসী হওয়ার জন্যে? নাকি তারা যাচ্ছেন কাজ করে উপার্জন করার জন্যে?

পরিশ্রম করে, কাজ করে উপার্জনের জন্যে যে নারী প্রবাসে বা যেখানেই যান, সেখানে যদি তার উপরে যৌন নির্যাতন – নিপীড়ন হয়, এক কাজের কথা বলে সেই নারীকে যদি প্রতারিত করা হয়, এর জন্যে কিভাবে সেই নারীকে যৌনদাসী, পতিতাবৃত্তিতে যুক্ত- এসব বলা যায়, সম্ভব?

সৌদি আরবে এরকম শারীরিক-মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়ে আসা নারীদের নিজ দেশেও একরকম চরম লাঞ্ছনা- গঞ্জনার শিকার হতে হবে? স্বদেশেও মানসিক নির্যাতনের শেষ হবে না? যৌনদাসী, পতিতার অপমান মাথায় নিয়ে বেড়াতে হবে? এরই মধ্যে সৌদি ফেরত অসংখ্য নারী শ্রমিক তাদের পরিবারের কাছে ফিরতে পারেননি, কাউকে কাউকে তার পরিবার, তার স্বামী- সন্তানরা ত্যাগ করেছে, আবার কেউ কেউ লজ্জায়, অপমানে তো নিজের দেশে ফেরার কথাই পরিবার-পরিজনের কাছে গোপন রেখেছেন! কেউ কেউ তো মানসিকভাবেই বিকল হয়ে এসব মান-অপমানের ঊর্ধ্বেই চলে গিয়েছেন! আমাদের প্রগতিশীল, সুস্থ – মানবিক বন্ধুরাও কি এইসব নিপীড়িত, অসহায় নারীদের সামান্য শ্রদ্ধাটুকু দিতে পারেন না?

আরেকটা কথা, যারা ভাবছেন এই সব নারীদের যৌনদাসী, সৌদি আরবকে পতিতালয় বললে সৌদি আরবের প্রতি ঘৃণা বাড়বে, তারা কি বুঝছেন না- সেই ঘৃণার ইমিডিয়েট ও সরাসরি লক্ষ্যবস্তু কারা হচ্ছেন? তাছাড়া বস্তুত এরকম বলার মধ্য দিয়ে সৌদি আরবের অপরাধকে লঘুই করা হয়!

বাংলাদেশের সাথে সৌদি আরবের যে চুক্তি- সেখানে বাংলাদেশ থেকে নারী শ্রমিক নিচ্ছে তারা, যৌনদাসী বা যৌনপল্লীর জন্যে যৌনকর্মী না! ফলে যেসব নারী শ্রমিক সৌদি আরবে গিয়ে যৌনদাসী বা পতিতালয়ে বিক্রিত হয়ে যৌনকর্মীর ভাগ্যবরণ করতে বাধ্য হয়েছেন, হচ্ছেন- তারা ভয়ানক মাত্রার ঘৃণ্য অপরাধের শিকার, সৌদি আরব সেই অপরাধে অপরাধী! সাধারণ পতিতাবৃত্তি বা যৌনদাসত্বের চাইতেও এরকম প্রতারণা, নির্যাতন, নিপীড়ন বড় ও ঘৃণ্য অপরাধ!

আমাদের একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধে যেসব নারীদের পাক হানাদাররা মাসের পর মাস আটক রেখে যৌন নিপীড়ন করে গেছে- তাদেরকে পাক হানাদারদের যৌনদাসী কিংবা পতিতা কিছুই বলি না, পাক হানাদার আর তাদের দোসর রাজাকার- আলবদররা আমাদের নারীদের ধর্ষণ করেছে, যৌননিপীড়ন করেছে- পাক হানাদাররা, রাজাকার-আলবদররা সব ধর্ষক – খুনী; এতোটুকু বলেও তো ধর্ষক-খুনীদের প্রতি ঘৃণা আনা সম্ভব!
তবে আজ কেন- আমাদের প্রবাসী নারীশ্রমিকদের যৌনদাসী, পতিতা বলা প্রয়োজন হয়ে পড়ছে? মানসিক-শারীরিক নির্যাতন- নিপীড়ন, যৌন নিপীড়ন- ধর্ষণের শিকার এতোটুকু বললে কেন চলছে না?

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.