ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখি

Hritu Mirঋতু মীর: মিশুক! তোমাকেই লিখছি। শৈশবে আমার একটা স্বপ্ন ছিল একদিন চিলেকোঠায় থাকবো । মাটির পৃথিবী থেকে অনেক উঁচুতে যেন সাত আসমানের কাছাকাছি মহাশুন্যের অতলান্তে ভাসমান হবে আমার সেই চিলেকোঠা । ঘোরলাগা নেশায় সমুদ্র নীল আকাশে ছড়িয়ে থাকা রূপালী তারা ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখবো, গুনবো রাতভর । মেঘের সাথে চাঁদের লুকোচুরি খেলার রহস্যময়তায় আমার মনটা উড়ে উড়ে চলে যাবে অনেক উপরে-কত যে ইচ্ছে হতো চাঁদ থেকে এই পৃথিবীটাকে কেমন দেখা যায তা দেখার । এসবই ছিল কৈশোরের অপাপবিদ্ধ মনের অলীক কল্পনা । তোমারও নিশ্চয়ই চিলেকোঠায় থাকার এমন একটা লুকানো স্বপ্ন ছিল- আর তাইতো হঠাৎ কেমন না বলে কয়ে চলে গেলে ।

 উঁচুতে এখন আমার ভীষণ ভয় মিশুক। মাটির এই পৃথিবীটা কি ভীষণ মায়াময় লাগে আমার, এখন আর একবারও ইচ্ছে হয় না এসব ছেড়ে স্বপ্নের সেই চিলেকোঠায় থাকতে। এমন অথৈ জল সমুদ্র, মৌন ধ্যানমগ্ন পাহাড়, সবুজে সবুজে ছাওয়া বনভুমি, লতায় পাতায় জড়ানো নাম না জানা বুনো গাছপালার এমন সোঁদা গন্ধ-কি নেই বলতো? আর আছে মানুষ আর মানুষ! তুমি না কত মানুষ ভালবাসতে-মানুষের প্রতি কোন এক গভীর সততার দায়বোধে মানুষের মিছিলেই তো মিশে ছিলে সবসময়। অথচ কি ভেবে যে এমন বিচ্ছিন্নতায় পাড়ি জমালে! বড় জানতে ইচ্ছে হয় তোমার ঠিকানাটা, দেখতে ইচ্ছে হয় কেমন এক শিশুর কৌতূহলে, দৃষ্টির তীক্ষ্ণতায় বিচিত্র এই জীবনের গল্প অনুসন্ধানে তাকিয়ে আছো তোমার ক্যামেরার লেন্সে।


তুমি নিশ্চয়ই সময় অসময়ে চিলেকোঠা থেকে সন্তর্পণে নেমে আসো । তোমার বাসার এঘর-ওঘর ঘুরে বেড়াও অশরীরী হয়ে । শোবার ঘরের দেয়াল জুড়ে থাকা তোমার বড়-সড় ছবিটা এত জীবন্ত ! তোমার সেই মনখোলা হাসি, তাকিয়ে থাকা এমনকি তোমার হাতের দৃশ্যমান দপদপে নীল শীরাগুলোও যেন কত প্রাণময়। তোমার বাসার সেই খোলা ব্যালকনির ছোট্ট রেলিংটা ধরে মঞ্জুলী কেমন এক অসীম শূন্যতায় দাড়িয়ে থাকে। একাকী নিঃসঙ্গতায় কখনো বা দু’হাতে মুখ ঢেকে হু হু করে কাঁদে। এত কোলাহল ওর চারপাশে, তারপরও তুমি নেই বলে কী নিদারুণ এক নৈঃশব্দের দৈন্যতা ঘিরে থাকে ওকে।

 কানাডায় কেন পাড়ি জমালে সে প্রশ্নে তুমি কখনো সন্তানের দোহাই দিতে না, প্রায়শঃই মঞ্জুলীর অসুস্থতায় তোমার উদ্বিগ্নতার কথাই বলতে শুনেছি। মঞ্জুলীর সাথে তোমার ঘর বাঁধার গল্পগুলো যেন একটা উপন্যাসের জীবন্ত পটভূমি । ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই বোহেমিয়ান যুবক তুমি কি যেন দেখেছিলে মঞ্জুলীর মধ্যে। তাই তোমার মাকে নাকি নির্দ্বিধায় বলেছিলে পৃথিবীর সবচেয়ে অসাধারণ সুন্দরী মেয়েটাকেই ঘরে আনছো তুমি । এই গল্পটা বলতে যেয়ে মঞ্জুলী খুব হাসে আর বলে ‘আমাকে প্রথম দেখে ‘মা’ মন্তব্য করেছিলেন যে, ‘মিশুক কোন গোধুলী লগ্নে যে মঞ্জুলীকে দেখেছে, আমার কাছে তো…’ । মনে আছে আমরা সবাই তোমার কাঁচ ঘেরা সেই রান্নাঘরে কেমন ভীড় করে বসে থাকতাম। আতিথেয়তায় তোমার জুড়ি ছিল না, আমাদের রান্না করে খাওয়াবে বলে তোমার সেই কি ব্যস্ততা । জলন্ত সিগারেটটা মুখ থেকে কোথাও গুঁজে রাখতেও যেন ভুলে যেতে । আমার বাসার দাওয়াতে তুমি স্পেশাল রেসিপিতে ইলিশ মাছ রেঁধে এনে কি কাণ্ডটাই যে বাঁধিয়েছিলে!

 সবাই কিভাবে হামলে পড়েছিল তার উপর । আমার রান্না করা খাবারের গড়াগড়ি অবস্থা দেখে আমি তোমাকে ‘শয়তান বুড়া’ বলে গাল দিয়েছিলাম। কাঁচাপাকা চুল গোফে ঢাকা তোমাকে দেয়া সেই নামটা নিয়ে যে কত কৌতুক হত! তুমি না মঞ্জুলী- কে বেশী ভাল রাঁধে এই বিতর্কে তোমার পক্ষে ‘টোরীর’ সেই কি আস্ফালন, আর ‘কনক’ কোন পক্ষে যাবে এই দোটানায় তোমাকে ঘেষেই ছোট্ট মেয়ের মত দাঁড়িয়ে থাকতো, ‘অনু’ সবার পাতে বাড়তি খাবার তুলে দিয়ে কেমন মায়ের ভূমিকা নিত।

 সবাইকে জড়িয়ে প্রতিমূহূর্তে এমন প্রাণভরে বাঁচার দিনগুলি কি ভোলা যায় মিশুক? আজকাল সন্ধ্যা হলেই আমার মনটা কেমন ভারী হয়ে আসে, হারিয়ে যাওয়া মানুষেরা কেমন ভীড় করে আসে আমার চারপাশে। আমার খুব ছুঁয়ে দেখে পরখ করতে ইচ্ছে হয়-আসলেই কি কেউ আসতে পারে মৃত্যুর ওপার থেকে? মনে আছে ‘মুক্তির গান’ ছবিটার প্রিমিয়ার শোতে তারেককে ছুঁয়ে বলেছিলাম ‘ছুঁয়ে রাখি তোমাকে, বিখ্যাত হয়ে যদি আবার ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাও’। আমি নিশ্চিত জানতাম, তুমি আর তারেক একদিন খুব বিখ্যাত হবে, কিন্তু এমনভাবে সত্যি সত্যি ধরা ছোঁয়ার বাইরে চলে যাবে তা কখনো ভাবিনি।


তোমার সাথে আমার শেষ কবে দেখা হয়েছিল মনে পড়ে না । আমার খুব রাগ হয় যখন কেউ আমাকে না বলে হঠাৎ চলে যায় । অপসৃয়মান দেহের ছায়ায় চোখ রেখে আমি সবসময় প্রার্থনা করি-যেন আবার দেখি, যেন আবার ফিরে আসে। তোমার জন্য এমন একটা কিছু করা হলো না বলেই কি আর ফিরলে না মিশুক! এইতো তোমার ‘মা’ কে দেখাশুনার পাশাপাশি এটিএন নিউজ এর প্রধান নির্বাহী হিসেবে কাজ করবে-এমন খবরের মধ্যেই তো তুমি বাংলাদেশে চলে গেলে। তোমার ক্যামেরার নিঁখুত কাজের উপর তারেকের ছিল অগাধ আস্থা। ‘আদম সুরত’ ছবিটা দিয়েই তো জুটি বেঁধেছিলে তারেকের সাথে, দু’জনে একে একে করে গেলে ‘মুক্তির গান’ ‘মুক্তির কথা’ ‘নরসুন্দর’ ‘রানওয়ে’ র মত অসাধারণ সব ছবি । জীবনের উপর চরম ঝুঁকি নিয়ে তুমি চলে যেতে এখানে-ওখানে স্যুটিং করবে বলে। যুদ্ধবিধ্বস্ত আফগানিস্থানের উপর তোমার কাজ ‘রিটার্ন টু কান্দাহার’ তৈরির সময়ও তো কত ঝুঁকি নিয়েছিলে, অথচ কি এক দুঃসাহসিকতায় কেমন নির্ভীক ছিলে তুমি। তোমার কোন কাজে কখনোই বাধা দেয়নি মঞ্জুলী । তোমার আর তারেকের শেষ ছবি ‘রানওয়ে’ দেখে আমি মঞ্জুলীকে জড়িয়ে ধরে হাহাকার করে উঠি-কেন ও তোমার অবাধ বিচরণে একটু আরোপিত শর্ত বেধে দেয়নি?

 ‘একসাথে বৃদ্ধ হব’- তোমার দেয়া এমন অঙ্গীকারেই বোধহয় ও নিশ্চিন্তে ছিল। বেদনায় আকন্ঠ ডুবে থাকা মঞ্জুলী কেমন লিখে যায়-“হারাই হারাই সদা হয় ভয়, হারাইয়া ফেলি চকিতে…এই ভয় সবসময় ছিল… মিশুক মধ্যপ্রাচ্যে ঘুরছে -কখনো সিরিয়া, কখনো লিবিয়া, কখনো গাজায়, আবার কখনো প্যালেস্টাইনে, কখনো জেরুজালেমে…ফোন করে চমকে দিয়ে বলবে কোথায় আছে…এটিএন নিউজ রুমে বললাম যেন মুক্ত এলাকায় আসা মাত্র যেন আমায় ফোন করে। ফোন করে বললো ‘ভয় পাচ্ছিস কেন? কানাডিয়ান পাসপোর্ট সাথে আছে না?’

১৩ আগষ্টেও ওর সাথে কানাডিয়ান পাসপোর্ট ছিল…আসলেই আমি মিশুককে ‘চকিতেই হারাইয়া ফেলিলাম।’ জানো মিশুক, তোমাকে নিয়ে তৈরি ভিডিও ‘ক্লিপ’গুলো দেখে আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে বাক্যহারা হয়েছিলাম । এত ঘটনাবহুল আর অর্থপূর্ণ জীবন ক’জনের হয় বল? অনলাইন টেলিভিশন ‘রিয়েল নিউজ’ এ তোমার চাকরিটা কি কম সম্ভাবনাময় ছিল? কোন কিছুরই সহজবোধ্য ব্যাখ্যায় কী অসাধারণ ছিলে তুমি! নারী না পুরুষ- লিঙ্গ বিভাজনের এই সামন্ত কৌশলের পুরোটাই ছিল তোমার কাছে অসার। এক সমান্তরালে নেমে মেশার তাগিদে সমর্পণের সেই স্বর্গীয় হাসিতে নিজেকে কেমন সমর্পিত করতে জানতে তুমি । তোমার সাথে দেখা না হলে আংগুর লতায় লতানো বন্ধুত্বের এই শর্তহীন নির্ভেজাল দিকটা হয়তো আমার বোঝা হতো না। সাফল্যের এত দীর্ঘ তালিকা ছিল তোমার অথচ তা ‘প্রকাশ’ ও ‘স্বীকৃতি’ র বিষয়ে তুমি ছিলে একেবারে মোহশূন্য, উদাসীন । তোমার মত এমন বিশাল কাজের সিকি ভাগ সমাপ্তির আগেই আমরা কেমন ‘আত্মপ্রচারের’ কাঙালীপনায় নিজেকে আটকে ফেলি। এমন নিরহংকার নীরবতায় এত কিছু করে গিয়ে আমাদের হয়তো তুমি শিখিয়ে গেলে- ‘কর্মই ফল, কর্মই ধর্ম’।

 তোমাকে ছাড়াই কেমন দু’বছর চলে গেল মিশুক! পৃথিবীটা কি দ্রুত বদলে যাচ্ছে-এই সময়, এই মানুষ এখন যেন অস্থিরতার এক ক্রান্তিলগ্ন ধরে হাঁটছে। মানুষের সাথে মানুষের সম্পর্কগুলো কি এক হীনমন্যতায় সারাক্ষণ টলোমলো করে, নিজেকে নিয়ে অতি ব্যস্ত মানুষ নিজের কাছেই কেমন ‘দুর্বোধ্য’ থেকে যায় । নিজেকে এখন আমার কেমন ‘অস্তিত্বহীন’ ‘নাম হারানো’ ‘বর্ণ-গন্ধহীন’ মনে হয় । কতবার ভাবি ফিরে যাব যেখানে ছিলাম, যেখানে তুমিও ফিরে গেছো-কিন্তু ভাল থাকার কি এক আয়েসী স্বার্থপরতায় ফেরা আর হয় না।

 তোমাকে তো বলাই হয়নি-তোমার অনেক যত্নে আর আদরে লালিত সেই ছোট্ট সুহৃদ ওর ‘বাবাই’ এর মৃত্যুতে কেমন রাতারাতি বড় হয়ে গেছে। ওর চোখে-মুখে বুঝি তোমার ছায়াই দেখে মঞ্জুলী- তোমার অনুপস্থিতিতে কেমন দায়িত্ববান হয়ে সংসারের হালটা জোরেশোরে আঁকড়ে ধরতে শিখে গেছে, এইটুকু জীবনেই বুঝে গেছে এই জীবনের সব জটিল লেনদেন। তোমার বাসার টবে নতুন কুঁড়িতে নতুন ফুল ফোটার আনন্দে আধমরা মঞ্জুলী বাঁচার তাগিদে কেমন বার বার বেঁচে ওঠে- তুমি নিশ্চয়ই দেখতে পাও। ভাল আর মন্দে, দিন রাত্রির এইসব পাঁচমিশেলী খবর ছুঁয়ে আমরা ভালই আছি। তুমিও ভাল থেকো মিশুক!

 (কানাডা থেকে প্রকাশিত দি বেঙ্গলি টাইমস থেকে নেয়া)

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.