আর একটি মেয়েও যেন সৌদিতে বর্বরতার শিকার না হয়!

সুপ্রীতি ধর:

পুরো ফেসবুক এখন মধ্যপ্রাচ্যে বিশেষ করে সৌদি আরবে নির্যাতন ও নির্যাতন-পরবর্তি খুনের শিকার নারী শ্রমিকদের পক্ষে। অধিকাংশই এই বর্বরতার বিচার চাইছে। তাদের দাবি গৃহকর্মী পাঠানোর নামে সৌদিতে যৌনকর্মী হিসেবে নারীদের পাঠানো বন্ধ হোক। আশা করছি, আগামী আরও কয়েকটা দিন এই দাবিতে প্রতিবাদ অব্যাহত থাকবে, গণমাধ্যম বিশেষভাবে তৎপর হবে এ সংক্রান্ত খবরগুলো প্রকাশের ক্ষেত্রে এবং এর পরিপ্রেক্ষিতে সরকারের সংশ্লিষ্ট মহলগুলো নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবে।

সাংবাদিকতার সুবাদে এ পর্যন্ত প্রচুর সংখ্যক অভিবাসী নারী শ্রমিকদের সাথে আমি কথা বলেছি অতীতে। আমার মনে আছে সেই ২০০২ সালে একজন নারী শ্রমিক বিদেশ থেকে ফেরত এসে সংবাদ সম্মেলনে তার ওপর হওয়ার নির্যাতনের বিস্তারিত তুলে ধরেছিলেন। নামটা তার মনে নেই আজ আর। সেই সংবাদ সম্মেলন কভার করেছিলাম আমি। মেয়েটি দেশে ফিরে এসেছিল এইচআইভি পজিটিভ হয়ে। স্বভাবতই তার আর জায়গা হয়নি নিজ সংসারে, যে সংসারের হাল ধরতে সে বিদেশে পাড়ি দিয়েছিল স্বামীর উৎসাহে, সে ফিরে এসেছিল একেবারে নি:স্ব হয়ে। সংবাদ সম্মেলনে তিনি এসেছিলেন একমাত্র কন্যাকে সাথে করে। এইডস আক্রান্তদের নিয়ে কাজ করে এমন একটি সংগঠনে তার ঠাঁই হয়েছিল তখন। এখন জানি না এতো বছর পর সে আদৌ বেঁচে আছে কীনা!

যখনকার কথা বলছি তখন এভাবে ঢালাওভাবে মধ্যপ্রাচ্যে নারী শ্রমিকরা যেতো না। কিন্তু যেতো। আর ফিরে আসতো এমন অসংখ্য নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে। তখন একজন দুইজন মুখ খুলতো, ফলে অজানাই থেকে যেতো তাদের সেই নির্মম দিনগুলির কথা। এবং পরবর্তিতে তাদের দেশের জীবনও যে অমানিশায় ঢেকে যেতো তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।

তখন আমরা পারিবারিক নির্যাতনের পাশাপাশি মেয়েদের ওপর এসিড নিক্ষেপ এবং এইডস নিয়ে অনেক কাজ করেছি। দেশে তখন ভয়াবহ আকার নিয়েছিল এই দুটি ঘটনা। এ বিষয়ে সরকারও আমাদের পক্ষে ছিল, আর আমরা সাংবাদিকরাও তখন বিষয়গুলোকে একেবারে আত্মস্থ করে জানপ্রাণ দিয়ে কাজ করে গিয়েছিলাম। ফলে এসিড সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে আইন হয়েছিল, এসিড আমদানি এবং ব্যবহারের ওপর ব্যাপক নজরদারি ও ক্ষেত্রবিশেষে নিষেধাজ্ঞাও আরোপ করা হয়েছিল। এর অবশ্যই একটা ইতিবাচক ফল আমরা পেয়েছিলাম তখন। দেশে এসিড সন্ত্রাসের হার কমে এসেছিল।

এইডসের ক্ষেত্রেও ব্যাপক সচেতনতা তৈরির পাশাপাশি গণমাধ্যমে এ নিয়ে বিস্তর রিপোর্ট একসময় এই মহামারী রোধ করা গেছে। গত অনেক বছর ধরে তো কিছুই শুনি না, জানি না আদৌ কেউ আর কাজ করে কীনা এ বিষয়ে! কিন্তু ঠিক একইভাবে বা একইমাত্রায় হয়তো আমরা কাজ করিনি দেশে বহুবিধ নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। নইলে নারী নির্যাতন, ধর্ষণ কেন এমন মহামারী হয়ে উঠবে আজকের দিনে? যেখানে বহু নারী সংগঠন গত প্রায় পাঁচ দশক ধরে কাজ করে যাচ্ছে নারীর উন্নয়নে, নারী নির্যাতন বন্ধের লক্ষ্যে।

আমার সময়ে আমরা বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের সাথেই কাজ করেছি নারী উন্নয়নে এবং নারী নির্যাতনের বিরুদ্ধে। সবাই খুব পজিটিভভাবেই আমাদেরকে সহযোগিতা করেছে, এটুকু আজ বলতেই পারি। সেটা বিএনপি আমল ছিল বললেই যাদের গায়ে জ্বালা ধরাবে তাদেরকে বলতে চাই, হ্যাঁ, ওই আমলেই আমরা অনেক কাজ করেছি। প্রতিটি মন্ত্রণালয়েই নারী উন্নয়নে বিশেষ প্রজেক্ট ছিল এবং তাদের বাধ্য করা হয়েছিল সেগুলো বাস্তবায়নের ব্যাপারে।

একইভাবে পরিবার পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ে অনেক কাজ হয়েছে তখন। জনসংখ্যার বিস্ফোরণ তখন এভাবে আজকের মতোন হয়নি শুধুমাত্র ওই কাজগুলোর কারণেই। অথচ এখন সেই মন্ত্রণালয়ে কী কাজ হয়, আদৌ হয় কীনা, তাই তো জানি না। কেউ তো সেইসব খবর দেয় না আমাদের! এই কথা বলছি বলে আমাকে ‘বিএনপি’ ট্যাগ দেয়ার চেয়ে নিজেদের আমলনামার দিকে নজর দিয়েন। কারণ আমরা তখন ক্ষমতায় কোন সরকার তা দেখার চাইতে কাজগুলি ঠিকমতো হচ্ছে কীনা তা দেখতেই বেশি আগ্রহী ছিলাম।

হঠাতই সরকার প্রসঙ্গটা আনলাম কেন? না আনলেও অসুবিধা ছিল না। কিন্তু বার বার মনে হয় প্রশাসনিক কাঠামোকে সরকারি হস্তক্ষেপের বাইরে রাখতে পারলে কিছুটা হলেও সুফল পাওয়া সম্ভব। সেইসাথে দুর্নীতিরোধ করতে হবে। দুর্নীতি এমন একটা বিষয় যা মানুষের মনুষ্যত্বকে হত্যা করে, তখন মানবিক বোধগুলো আর ডালপালা মেলতে পারে না। সেখানে নারী যখন পুরো সমাজেই একজন ঊনমানুষ বলে বিবেচিত হয় তখন তার জীবনকে বাজি ধরতেই পারে একটা আপাদমস্তক দুর্নীতিগ্রস্থ রাষ্ট্র।

গত ১০-১১ বছর ধরে মধ্যপ্রাচ্যে যে সংখ্যায় নারী শ্রমিক রপ্তানি হচ্ছে, কোন উন্নয়নকামি রাষ্ট্র হলে যথাযথ কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করে এই জনশক্তিকে দেশেই কাজে লাগাতে পারতো। আমি জানি না কেন এই নতজানু নীতি একটা রাষ্ট্রের? সৌদি আরব চাইলেই তাকে দিয়ে দিতে হবে কেন? আর যেখানে এমন বীভৎস সব কাহিনী সবার জানা, সেখানে রাষ্ট্র কেন আগ বাড়িয়ে নিজের ঘরের মেয়েকে নির্যাতক, ধর্ষক রাষ্ট্রের হাতে তুলে দেবে? কেন?

একজন সৌদি ফেরত নারী শ্রমিককে জিজ্ঞাসা করেছিলাম যে, তোমাদের যে বাড়িতে রাখা হয়, যেখানে নির্যাতন করা হয়, সেখানে কোনো নারী বাসিন্দা ছিল না? তারা তোমাদের বাঁচাতে আসেনি কখনও?
উত্তরে ওই নারী জানিয়েছিলেন, ওরা তো সবই জানে, তাদের ছেলে সন্তান, স্বামী দুজনই অত্যাচার করে আমাদের ওপর, কিন্তু কখনও সাহায্য করে না, বরং তারাও রাত বাড়তে থাকলে সুন্দর সেজেগুজে বোরকা চাপিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
জানতে চাইলাম, কোথায় যায় তারা, জানো কিছু?
-ওরা গাড়িতে করে অনেক দূরে ‘নাইট পার্টি’তে চলে যায়। সারারাত থেকে ভোরের বেলায় ফেরে।
ওই নারীর সাথে এই সামান্য আলাপেই বোঝা যায়, কতোটা ভারসাম্যহীন একটা সমাজ ওদের! বাড়ির নারী বেরিয়ে যাচ্ছে ‘নাইট ক্লাবে’ দূর মরুভূমিতে, আর ঘরের ছেলে এবং স্বামী মিলে গৃহকর্মির ওপর চড়াও হচ্ছে।
সব জেনেও আমাদের সরকার নারীদের ঠেলে দিচ্ছে ওই গুহায়। সৌদি আরব নামক এক গুহায়। পবিত্র, পূণ্যভূমি বলে কথা! সেখানে গিয়ে যারা মারা যায় তারা নাকি বেশ কয়েক ধাপ এগিয়ে যায় বেহেশতের দিকে, তাহলে তো ধর্ষণ, ধর্ষণের পর আত্মহত্যা বা খুন, সবই জায়েজ সেখানে।
ভাবেন, এখনও ভাবেন সবাই মিলে কীভাবে মানুষগুলোকে বাঁচানো যায়! সিস্টেমের পরিবর্তনটা জরুরি। আর জরুরি নিজেদের মন থেকে সৌদির প্রতি ‘ভালবাসা’টুকু বিসর্জনের।

সুপ্রীতি ধর, প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক, উইমেন চ্যাপ্টার

কেউ কেউ বলার চেষ্টা করছেন সৌদিতে পরিবর্তন আসছে। আমি তা শুনতে নারাজ। কোন দেশে কী পরিবর্তন আসবে তার জন্য আমরা গিনিপিগ হতে রাজী নই। দেশটাতে হয়তো কিছু পরিবর্তন আনা যাবে, কিন্তু তাদের মনে হাজার বছরের যে প্রতিবন্ধকতা তা থেকে মুক্তি পাবে কী করে?

সরকারকে শক্ত হাতে দেখতে হবে বিষয়টি। সৌদি সরকারকে জবাবদিহিতার কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে হবে। যদিও জানি এ অরণ্যে রোদন মাত্র।

শুধু বলবো, আর একটা মেয়েও যেন সৌদিতে গিয়ে এমন বর্বরতার শিকার না হয়, আর একটা মেয়েও যেন লাশ না হয়! যেসব সংগঠন কাজ করছে এসব নারী শ্রমিকদের নিয়ে তাদের বলতে চাই, বন্ধ করুন এবার ব্যবসাটা। অনেক কামাই করেছেন। ‘দক্ষ’ নারী শ্রমিক পাঠানোর নামে যে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে বসেছেন, যার কল্যাণে বিভিন্ন দেশ ঘুরে বেড়ান, আবার যারা ফেরত এলে তাদের কান্না শুনিয়ে আরও একপ্রস্থ ব্যবসা করেন, তাদের নিয়ে আবার খাবারের ব্যবসায় নামান, বন্ধ করেন এবার! আপনাদের আমরা চিনি। যারা চেনে না এখনও তাদেরকে চেনানোর ব্যবস্থাও তাহলে করবো।

আর সেইসাথে সবাই জোটবদ্ধ হোন, সোচ্চার হোন এই বর্বরতার বিরুদ্ধে। এভাবে চলতে দেয়া যায় না।

শেয়ার করুন: