লুতফুন নাহার লতা: বৃষ্টি বৃষ্টি বৃষ্টি! শ্রাবণের অঝোর ধারায় ভেসে যাচ্ছে সারা নিউইয়র্ক শহর, চারিদিকে জল থৈ থৈ ভাব,বৃষ্টি একটু ধরে আসতেই জোর স্রোতের টানে জল ছুটে চলেছে পাকা রাস্তার ঢালু বেয়ে। এক নিমেষেই আবার আকাশ পরিষ্কার! ভাঙা মেঘের ফাঁক দিয়ে দুষ্টু আলো এসে রাঙিয়ে দিচ্ছে গাছগাছালীর সকল অঙ্গ ! সারাদিনের কাজের শেষে এমন মেঘ রদ্দুরের খেলায় মেতে অকারণ হাসিতে যখন মন জুড়িয়ে গাড়ির জানালার কাচ নামিয়ে বাতাসে চুল উড়িয়ে ঘরে ফিরছি, এমন সময় বোস্টন থেকে কল।
কবি শহীদ কাদরী কল করেছেন। গাড়ির দুই সিটের মাঝখানে রাখা ফোনের ছোট্ট স্ক্রিনে দেখছি লেখা ‘শহীদ ভাই’, কিন্তু ধরতে পারছি না । গাড়ির রিয়ার ভিউ মিররে দেখছি আমার ঠিক পিছনেই পুলিশের গাড়ি। হাতে ফোন নিয়ে গাড়ি চালাতে দেখলেই বিপদ! সাথে সাথে একটি বিরাট অংকের টিকিট ধরিয়ে দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স থেকে গোটা দুই পয়েন্ট কাটার ব্যাবস্থা করে হাতে একটি সমন ধরিয়ে দিয়ে যাবে, যাবার বেলায় সেফ ড্রাইভিং এর কথা বলে যাবে ।
আমার জামাইকা হিলসের বাসার খুব কাছে এসে গেছি আর মাত্র ক’য়েক মিনিট ! ড্রাইভওয়েতে গাড়ি পার্ক করে ঘরে ঢুকেই শহীদ ভাইকে কল ব্যাক করলাম । সাধারণত আমিই কল করি । কাউকে কল-টল করা শহীদ ভাইয়ের ধাতে নেই, তা বুঝে এই দায় আমিই নিয়েছি । ১৯৯৭ তে আমি যখন আমেরিকায় আসি তখন প্রিয় কবি শহীদ কাদরী থাকেন বোস্টনে । মাঝে মাঝে নিউইয়র্কের কোন অনুষ্ঠান উপলক্ষে ওনাকে নিয়ে আসেন উদ্যোক্তারা, তেমনি একটি অনুষ্ঠানে সম্ভবত কবি হাসান আল আব্দুল্লার কবিতা পত্র শব্দগুচ্ছের অনুষ্ঠান হবে, তার সাথে দেখা ।
১৯৭৮ এর পরে ওনাকে আর দেখিনি। এতো দীর্ঘ সময় পরে ওনাকে দেখে আমার কী যে ভালো লেগেছিল তা বলে বোঝানো যাবে না ! ওনাকে কল করতেই বললেন ‘দাঁড়াও সিগারেট টা ধরিয়ে নিই ‘ আমি হাসলাম । এর পর শুরু হল গল্প ! অসাধারণ তার গল্পের ভাণ্ডার ! পৃথিবীর তাবৎ বিষয়ে তাঁর প্রভূত আগ্রহ আর ঈর্ষণীয় জানাশোনা । বই বই বই , তিনি বইয়ের পোকা । রাতের খাবার তৈরি করতে করতে কানে ফোন লাগিয়ে বেশ কিছুক্ষণ গল্প করলাম ।
বললেন ‘ নাসিম তোমাকে খুঁজছে সে কল করে তোমাকে পায়নি । তাকে কল দিও । নাসিম হলো কবি বদিউজ্জামান নাসিম । থাকেন বোস্টনে । আমি জানি তিনি কেন আমাকে খুঁজছেন । আসলে এই ২০০২ এর আগস্টে কবির ৬০তম জন্মদিন উৎসব করা হবে। বোস্টনে তার আয়োজন চলছে। কবি বদিউজ্জামান নাসিমের সম্পাদনায় ভিন গোলার্ধের পক্ষে ‘ দাঁড়াও, আমি আসছি ‘ শিরোনামে একটি শুভেচ্ছা পত্র বের হচ্ছে। তাতে কবিকে জন্মদিনের বারতা পাঠাবেন লেখক সাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত , বেলাল চৌধুরী , দাউদ হায়দার, মীজান রহমান , ইকবাল হাসান , সাজেদ কামাল ,পূরবী বসু , শিহাব সরকার, আলম খোরশেদ , কাইসার হক , রোজী কামাল ও আরো অনেকে। বেশ বড় রকমের আয়োজন । নর্থ আমেরিকার বিভিন্ন শহর থেকে আসবেন কবির শুভানুধ্যায়ীরা, বন্ধু বান্ধব , প্রিয় জনেরা ,ও কবির ভক্তকূল । আর আমিও যেনো নিউইয়র্ক থেকে গিয়ে সেখানে সমবেত সকলের সাথে এই উৎসব উদযাপনে অংশ নেই । এ নিয়ে বেশ আগে থেকেই কথা হচ্ছিল । সে জন্য ছুটি নিয়ে রেখেছি । এব্যাপারে অসামান্য উৎসাহ কবি ইকবাল হাসানের ! তিনি আসবেন কানাডার টরন্টো শহর থেকে। সাহিত্যিক জ্যোতিপ্রকাশ দত্ত ও পূরবী বসু যদিও থাকেন নিউইয়র্কে, কিন্তু এ সময়ে তাদের ছেলে মেয়েদের নিয়ে বেরিয়েছেন ঘুরতে, তারা আসবেন রোড আইল্যান্ড থেকে। নিউইয়র্ক থেকে যাবে আশরাফুল হাসান বুলবুল, তার স্ত্রী মাহফুজা, বোস্টন থেকে থাকবেন অনেকের মধ্যে ফার্মাসিস্ট মঞ্জু বিশ্বাস ,তার স্বামী আর্কিটেক্ট ইকবাল হোসেন, রোড আইল্যান্ড থেকে আসবে তাপস, নিতা ও তাদের সাংস্কৃতিক দল ‘ আমরা ক’জনা’। ম্যারিল্যান্ড , ওয়াশিংটন , ভার্জিনিয়া সকল এলাকা থেকে লোক আসবেন কবির জন্মদিনের উৎসবে। কবি ইকবাল হাসান কল করে জেনে নিলেন ছেলেকে নিয়ে আমি কিভাবে যাচ্ছি । আমার ছেলে সিদ্ধার্থ তখন আট বা নয় হবে । এই প্রবাসে আমার কেউ ছিল না যার কাছে একদিনের জন্য ওকে রেখে যেতে পারি । পরদিন সিদ্ধার্থকে সাথে নিয়ে যখন বোস্টন বাস টার্মিনালে পৌঁছলাম আমি কবিকে ইকবাল ভাইয়ের পাশে দেখে আনন্দে প্রায় কেঁদে ফেলি আর কি ।
নাসিম ভাইয়ের বাসায় সবার দুপুরের খাবারের আয়োজন করা হয়েছে খাবারের শেষে সবাই বসে গল্প করছেন আর চলছে চা’য়ের পর্ব , সায়মা ভাবী এরই এক ফাঁকে কবির কাপড় লন্ড্রি করে এনেছেন পরম যত্নে, তিনি একাই তা ভাঁজ করছেন দেখে আমিও তাতে হাত বাড়ালাম ! জ্যাকসন হাইটস থেকে দুই কবির জন্য দুটি লাল পাঞ্জাবী নিয়েছিলাম। ইকবাল হাসানের তা বেশ পছন্দ হলেও জন্মদিনে পরার জন্য কবির তা মোটেও পছন্দ হল না ! ফলে তিনি একটি সাদা শার্ট পরে রইলেন । আমরা সবাই রেডি হয়ে যথা সময়ে পৌঁছে গেলাম অনুষ্ঠানে। একে একে সবাই কবিকে শুভেচ্ছা জানিয়ে চমৎকার সব কথা বললেন। এইবার ডাক পড়ল আমার!
আমি কি বলব ! আমি তো কবি শহীদ কাদরী সম্পর্কে বলবার মত যোগ্যতাই রাখি না, না আমি কবি, না আমি সাহিত্যিক, না লেখক , না তার বন্ধু ! কেবল পাঠক , কবিতা পাগল, আবৃতি করতে ভালো লাগে এই তো আমার দৌড় ! ছোটবেলায় এক দুঃখের দিনে তাঁকে একবার দেখেছিলাম ।
আধুনিক বাংলা কবিতার অন্যতম প্রবাদ পুরুষ কবি শহীদ কাদরী । পঞ্চাশ ও ষাটের দশক জুড়ে সুনামির মত অস্থির দু’কুল ভাসানো তাঁর কবিতা । এতো কম লিখেছেন যে তাঁর লেখা এক একটি নক্ষত্রের মত। র্যাঁ বো, বোদলেয়র , টি এস এলিয়ট আর সুধীন দত্তের কাব্যমানসে লালিত এক স্ফটিক যেন তিনি । কবিতার আলোকযানে তাঁর সেই স্বল্প যাত্রা যেন এক চন্দ্রাভিযান!
কিন্তু না,আছে ! আমারো কিছু মূল্যবান স্মৃতি আছে রুমালে বাঁধা ! আমি সেই রুমালের গিঁট খুলে বলতে চাইলাম -১৯৭৮ সালের ১২ ই ফেব্রুয়ারী ১লা ফাল্গুন ! সেদিন খুলনায় আমাদের কলেজের বিভাগীয় পর্যায়ে কবিতা আবৃতি ও স্বরচিত কবিতা প্রতিযোগিতায় প্রথম হয়ে ঢাকা থেকে আসা স্বনামধন্য সব কবিদের কাছ থেকে আমার পুরষ্কার নেবার কথা । ঢাকা থেকে এসেছেন কবি শামসুর রাহমান , শহিদ কাদরী, আলমাহমুদ , আমরা তাদের কবিতা লাইন ধরে মুখস্ত করে খৈ ফোটাচ্ছি । আমাদের কলেজে তখন ইরেজীর অধ্যাপক অসিত বরণ ঘোষ, বাংলার অধ্যাপক কবি হাফিজুর রহমান, তাদের নেতৃত্বে গত দুদিন ধরে চলছে সব প্রতিযোগিতা, আজ শেষ দিন ।
সেই রাতে আমার বাবা মারা গেলেন । মধ্যরাত থেকে বাবার দেহাবশেষ নিয়ে বসে আছি আমরা সবাই। ফাল্গুনের প্রথম প্রহরের উদাস করা হাওয়ায় আমাদের উঠোন থেকে সব ঝরা পাতা সর সর করে সরে যাচ্ছে, কেমন আলোআঁধারির চিকন ইশারায় ভয় ভয় ভোর । সকাল হলো , আরো একটু বেলা বাড়লে কলেজে খবর পৌঁছাল, আমার বাবা ছিলেন কলেজের গভর্নিং বডির মেম্বার,তাকে শ্রদ্ধা জানাতে প্রিন্সিপাল, শিক্ষকসহ কলেজের উৎসবে সকল আমন্ত্রিত কবি সাহিত্যিকরাও এলেন আমাদের বাড়িতে। ঝরা পাতা উড়ে গিয়ে দূরে সরেতঘাড় বাঁকিয়ে চেয়ে রইল। উঠোনে সারি সারি চেয়ারে অনেকের সাথে কবি শহীদ কাদরীও বসে ছিলেন। কেবল এটুকু । এ কথা শহীদ ভাই মনেও করতে পারেন না। না পারারই কথা । শুনেছি সম্ভবত সে বছরের শেষের দিকে কবি দেশ ছেড়েছিলেন । তারপর থেকে ক্রমশ সব কিছু থেকে তার নীরব পলায়ন । কিন্তু এই দুর্মর অভিমানের কুয়াশা কাটিয়ে, দীর্ঘ স্বেচ্ছা নির্বাসনের অবসান ঘটিয়ে কবি ফিরে যাবেন সেই মাটি ও মানুষের মমতার কাছে , নাগরিক ভোর আর মধ্যরাতের ফুটপাত বদলের মোহময় স্বপ্নের কাছে সেই প্রত্যাশা আমার! পেছনে বসে থাকা কবিকে হাত ধরে কেক কাটার জন্য নিয়ে এলাম আমি আর মঞ্জু বিশ্বাস । কিছুতেই তিনি সামনে বসবেন না, কিছুতেই তিনি কেক কাটবেন না তবু আমাদের চাপে পড়ে করতে হল। সবাই মিলে বোস্টনের সেই মধুর সন্ধ্যা ভাগাভাগি করে নিলাম। কবির অনুরোধে রবীন্দ্রনাথের শেষের কবিতা থেকে পাঠ করে ‘তোমারে যা দিয়েছিনু সে তোমারি দান ‘ নাসিম ভাইয়ের বাসায় ফিরে এসে রাতের খাবারের পরে ঠিক হল হোটেলে গিয়ে পূরবী বসুর রুমে বা কবি ইকবাল হাসানের আর খসরু ভাইয়ের রুমে আড্ডা দেয়া হবে । সিদ্ধার্থ ঘুমিয়ে পড়েছে তাই সায়মা ভাবীর সাথে আমি রয়ে গেলাম নাসিম ভাইদের বাসায় ,ওরা সবাই গাড়ীতে উঠেও কবির কথায় আবার এলো আমাদেরকে নিতে, শহীদ ভাই ওদের বলেছেন ‘এতো দূর থেকে লতা এসেছে! আর সে পরম আড্ডালোভী মানুষ, তাকে বাদ দিয়ে যাওয়া যাবে না !’ মমতা মাখা এই ছোট্ট একটু কেয়ার আমাকে ঋণী করে রাখল ! ঘুমিয়ে পড়া সিদ্ধার্থকে সাথে নিয়ে এবার আবার আমরা সবাই সেই মহা আড্ডায় যোগ দিলাম, পূরবীদি , জ্যোতিদা , খসরু ভাই , ইকবাল ভাই, নাসিম ভাই , মঞ্জুদি, ইকবাল হোসেন ভাই , আরো অনেকে ছিলেন আজ আর অনেকের নামও মনে নেই। সারা রাত সেই গল্প, সেই গলা ছেড়ে আমার আর পূরবী দি’র সমবেত রবীন্দ্র সংগীত ‘তোমার খোলা হাওয়া ‘ সেই অমলিন আড্ডার সোনায় মোড়ানো স্মৃতি ভুলবার নয় ।
এর কিছু দিন পরে অপ্রত্যাশিতভাবে আবারো আমার যাওয়া হয়েছে কবিকে দেখতে, যখন খবর পেলাম কিডনির মারাত্মক সমস্যার জন্য তাঁকে বোস্টনের সালেমে এক হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে এবং তাকে দেখার তেমন কেউ নেই । নিউইয়র্ক থেকে বুলবুল, মাহফুজা, আমি, আমাদের আর এক বন্ধু মিলে ছুটে গেলাম সালেমে কবিকে দেখতে ! সারাদিন আমরা সবাই ঘিরে রইলাম কবিকে । জোর করে হাসপাতালের ট্যাপের উষ্ণ গরম পানিতে মোটা ন্যাপকিন ভিজিয়ে মুখ, হাত, পা পরিষ্কার করিয়ে, খাবার খাইয়ে দিলাম। আমরা থাকতেই এলেন কবি সুফিয়া কামালের পুত্র সাজিদ কামাল ও পুত্রবধু রোজী কামাল, আমরা সবাই মিলে গল্প করে, জোকস বলে হাসিয়ে ,কিছুক্ষণের মধ্যেই কবিকে মানসিকভাবে হালকা করে তোলা হলো। সে বার না দেখলে কবি যে শিশুর মত হাসতে পারেন তা বোধ করি আমাদের জানা হত না !
আজ দশ বছর ধরে এমনি করে বারে বারে ব্যাধি তাঁকে আঘাত হানে আর কবি শহীদ কাদরী তার তীক্ষ্ণ কলমের মতই ক্ষুরধার বল্লমে বধ করেন সকল অপশক্তি! আজ সেই ১৪ আগস্ট, আবার এসেছে জন্মদিন ! কবির ৭০ তম জন্মদিন হয়ে উঠুক সকল অন্ধকারের দূর্জয় প্রতিরোধ ! কবি আবার লিখুন শ্রাবণের ধারার মত । বেঁচে থাকুন মরণ নামক অশনিকে বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে। আমাদের সকল শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা নিয়ে জয় হোক , কবির জয় হোক!