অসুস্থ ‘সিস্টেম’ যখন কাউকে খুনি করে তোলে!

নাসরিন শাপলা:

আমার ফেসবুক বন্ধুর সংখ্যা ৮৭১ জন। এদের মধ্যে অন্তত শতকরা ৭০ ভাগ মানুষ আবরার ফাহাদকে নিয়ে কোন না কোনভাবে তাদের অনুভূতি প্রকাশ করেছেন। কেউ তাদের ভাবনা নিয়ে এক বা একাধিক লেখা লিখেছেন, কেউ তাদের শংকা আর কষ্টের কথা প্রকাশ করেছেন, কেউ কবিতা লিখেছেন, কেউ বা ছবি একেঁছেন। যারা এর কোনটিই পারেননি, তারা অন্যের লেখা, মন্তব্য বা ছবি শেয়ার করেছেন।

নতুন এক একটা ঘটনা ঘটে ফেসবুকে লাখ লাখ মন্তব্য আর লেখা দেখি। তারপরে আবার যে কে সেই। অপরাধীরা নতুন উদ্যমে বুক ফুলিয়ে নিত্য নতুন অপরাধ করে। কোনকিছু বদলায় না। এমনটাই তো হয়ে আসছে।

বয়স হচ্ছে। আজকাল কিছুটা হলেও আবেগকে বাদ দিয়ে যুক্তি দিয়ে গভীরে প্রবেশ করে ভাবতে পারি। তবুও ক্ষণে ক্ষণে মানুষের গিরগিটির মতো রং বদলানো দেখে কেঁপে কেঁপে উঠি। আবরার খুন হবার পর প্রাথমিক ধাক্কার মুহূর্তগুলোর প্রকাশ ছিলো সাদা-কালোর মতো সহজ আর সরল ছিলো।

তারপর ২৪ ঘন্টাও কাটেনি, ঘটনার উপর রঙের প্রলেপ পড়লো, মানুষের ভোল পাল্টানো শুরু হলো। জানতাম এমনটাই হবে, তবুও কেন যেন এখনও অবাক হই।

এদের একদল নিঃশ্বাস আটকিয়ে বসে ছিলেন, কখন হাই কমান্ডের পক্ষ থেকে ‘ওহী’ নাযিল হবে। কবে ক্যারিশমা আর কথার মারপ্যাঁচে সবার মুখ বন্ধ করা হবে। যখন বিচারপতি নিজেই সাজেন ভিক্টিম, তখন আর কার কাছে বিচার চাইবার থাকে? ব্যস! হলো তো বাচ্চালোগ! এইবার কান্না বন্ধ করেন।

আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী কারো কাছে মমতাময়ী মা, কারো কাছে বুবু তো কারো কাছে বেটি। উনি আশ্বাসও দিলেন মা হিসেবে তিনি আবরার হত্যার বিচার করবেন। এসব কথায় কথায় মা মাসী টানলে অনেকে বেশ আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেও, আমার কাছে তাতে প্রফেশনালিজমের খামতি মনে হয়। আর এটাও তো সত্যি আপনি যখন আবরারের মা হিসেবে বিচার করতে চাইছেন, তখন ছাত্রলীগের দোষীরা অপেক্ষায় আছে মায়ের কাছে এই যাত্রায় ক্ষমা পাবে বলে।

আসলে আমাদের জীবনে মা, মাসি, বুবু, চাচা, খালা সবই আছে। নাই শুধু একজন নিরপেক্ষ সরকার প্রধান যার উপর আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক মতাদর্শে বিশ্বাসী অবিশ্বাসী সবাই নিঃসংকোচে নির্ভর করতে পারে। তাই অনুরোধ, দলীয় রাজনীতির ঊর্ধ্বে উঠে আপনি সারা বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী হয়ে উঠুন। তাতে মানুষের মনে শান্তি আর স্বস্তি ফিরে আসবে।

আবরার ফাহাদ

আরেকদল পুরনো পাপী দেখি হায় হায় করে, “আমাদের সময় তো রাজনীতি এরকম ছিলো না”। আমি পড়ি আর হাসি।

আসলে বাংলাদেশের রাজনীতি আমি যতটুকু দেখেছি, তাতে তার সাথে একমাত্র কাকের নীতিরই তুলনা চলে। এদের সারাদিন কাজ হলো কাকের মতো বখরা নিয়ে কামড়াকামড়ি করা আর হল্লাচিল্লা করে বাকি সবার মাথাটা খারাপ করা। তারপর দিনশেষে গাছের আগায় বসে চোখ বন্ধ করে বিষ্ঠা ত্যাগ করে ভাবে কেউ দেখেনি।

একটা ঘটনা বলি। সালটা বোধহয় ১৯৯৫ বা ৯৬। আমি তখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অনার্সের ছাত্রী। আমাদের ক্লাস হতো শহীদ মিনার আর ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের উল্টো দিকের অ্যানেক্স বিল্ডিংয়ের চারতলায়। একদিন ক্লাসে আসতেই আমার এক রাজনৈতিক দলের ছোটখাটো ছাত্রনেতা বন্ধু খুব গর্বের সাথে বললো,
-” বুঝলা শাপলা, আজ এই অ্যানেক্স বিল্ডিং শিবিরমুক্ত”।
-“মানে কী?”
-” গত কয়েক সপ্তাহ ধরে তো অনেকগুলো শিবির খ্যাদাইসি। বাকি ছিলো দুইটা। গত সন্ধ্যায় দুইটারে লাইথ্যাইতে লাইথ্যাইতে চাইর তালার সিঁড়ি দিয়া নামাইয়া এই মাঠে আইন্যা এমন মাইর দিসি যে ঐ দুইটা আর জন্মে এদিকে আসবো না”।
যারা অ্যানেক্স বিল্ডিং চেনেন তারা জানেন এই চারতালার সিড়িগুলো কী ভয়ানক খাড়া আর দীর্ঘ। আমরা এই সিঁড়ি ভাঙার ভয়ে অনেক ভেবেচিন্তে সব কাজ সেরে চারতলায় উঠতাম যাতে বারবার ওঠানামা করতে না হয়।

আমার মুখ থেকে নিজের অজান্তেই বের হয়ে আসলো-
-” তোমরা কি মানুষ”
-” হেঃ! হেঃ! আমরা মানুষ! কিন্তু ঐগুলা মানুষ না, ঐগুলা শিবির “।

সুতরাং পুরনো পাপীরা ‘কাউয়া নীতি’ ছাড়েন। যতই আম জনতাকে বোঝানোর চেষ্টা করেন যে আপনাদের রাজনৈতিক চরিত্র ছিলো ফুলের মতো পবিত্র, পাবলিক খাবে না যতোক্ষণ না পুরো জাতি ডিমেনশিয়ায় আক্রান্ত না হচ্ছে। সত্য হলো এরা আপনাদেরই যোগ্য উত্তরসুরি- একটু বেশিই যোগ্য আর কী!

কলেজ জীবনে আমাদের মাইকেল মধুসূদন দত্তের ‘সমুদ্রের প্রতি রাবণ” পড়াতেন আজমল স্যার। অসাধারণ সেই ক্লাস। স্যারের পড়ানোর গুণেই হোক আর মধুসূদন দত্তের লেখণীর গুনেই হোক, আমার চোখে রাবণের রাক্ষস রূপটি গৌণ হয়ে যেতো। আমার কাছে রাবণকে মনে হতো এক অসহায় ভগ্ন হৃদয় পৌরাণিক চরিত্র।

প্রতিটি মানুষের ভিতরেই বোধহয় এই রাম-রাবণের খেলা থাকে। আমার যে বন্ধুটি শিবিরের ছেলেগুলোকে নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়ে ক্যাম্পাস ছাড়া করেছিলো, তার মতো মা ভক্ত ছেলে আমি কম দেখেছি। সাড়া পৃথিবী তার একদিকে আর তার মা ছিলো আরেকদিকে। তার পরিচিত বন্ধু মহলে সে ছিলো উদার আর অন্যের বিপদে ডান বাম না তাকিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া মানুষ। ওর চরিত্রের এই বৈপরীত্য আমাকে অবাক করতো।

আসলে রাজনীতি, ক্ষমতা, দম্ভ এগুলো রামের পিছনে লুকিয়ে থাকা রাবণকে সাড়ম্বরে বের করে আনে। চোখের সামনে কতো দেখেছি। মফস্বলের গন্ধ গায়ে মাখা ছেলেমেয়েগুলো অনেক কম সুযোগ সুবিধা নিয়েও যখন মেধা আর পরিশ্রমের জোড়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় বা বুয়েটের মতো শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পড়বার সুযোগ পায়, তখন তো তার আর পিছনে ফিরে তাকাবার কথা নয়।

অথচ অসুস্থ একটা সিস্টেম ঠিক তখনই তাদের উপর থাবাটা বসায়। হলে যেই সীটটি সে তার মেধা দিয়ে অর্জন করেছে, সেটা পেতে তাকে রাজনৈতিক দলের নেতা পাতি নেতাদের হাতের পুতুল হতে হয়। আর এগুলো ঘটে হাউজ টিউটর আর হল প্রাধাক্ষ্যদের প্রত্যক্ষ ছত্রছায়ায়। বহিরাগতরা এসে সীটের দখল নেয় আর সীটের যৌক্তিক দাবীদার গণরুমে মাটিতে বিছানা করে ঘুমায়। জীবনটাকে বদলে নেবে বলে বইটা টেনে নিয়ে পড়তে বসলেও, মিছিলের ডাক পড়লে অনিচ্ছাসত্ত্বেও ‘জ্বালো জ্বালো আগুন জ্বালো” শ্লোগান দিতে বের হতে হয়।

উপেক্ষা করার উপায় বা সাহস নেই। তাতে নেতার রোষে পড়ে সীট তো বটেই, পৈতৃক প্রাণটাও যেতে পারে। একটা কথাও বাড়িয়ে বলছি না। চোখের সামনে অনেক দেখেছি এসব ঘটনা। Prey and Predator এর খেলায় এক সময় মফস্বলের এইসব ছেলেমেয়েগুলো কেউ কেউ ঘুরে দাঁড়িয়ে নিজেই Predator হয়ে যায়। আর যারা পারে না, তারা তল্পিতল্পা গুটিয়ে ফিরে যায় যার যার নিবাসে। তখন সমাজ তাদের মনে করে ব্যর্থ, এতো বড় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে চান্স পেয়েও পড়তে পারলো না।

তখন আমরা কেউ যাই না এদের বা এদের বাবা মায়েদের সান্ত্বনা দিতে। যার ইঞ্জিনিয়ার হবার কথা ছিলো, সে হয়তো মোড়ের ফার্মেসি দোকানের মালিক হয়। যার ইকনমিস্ট হবার কথা ছিলো সে হয়তো ঠিকাদার হয়।

অথচ পাঁকে পড়ে যারা পঙ্কিল হয়, খুব আশা করি টিভি ক্যামেরা কেন এদের বাবা-মায়ের মুখের উপরে ধরে জানতে চায় না, ” আপনার সন্তান খুন করেছে, আপনার অনুভূতি কী?”
সাব্বাস! এখন বাবা মা যদি আপনাকে প্রশ্ন করে আমার সন্তানকে যখন পড়তে পাঠিয়েছিলাম, তখন তো সে খুনি ছিলো না, ছিলো মেধাবী এক সন্তান। তার এই খুনি হয়ে ওঠার দায় কি পিতামাতার নাকি সমাজের?

কী উত্তর দেবেন আপনি?

শেয়ার করুন: