আমার বুকফাটা আর্তনাদ কি আপনাদের ঘুমন্ত চেতনাকে জাগাবে?

ফাহমিদা খানম:

আমি এক অক্ষম মা — যার সন্তানেরা পড়ে পড়ে মার খায়, ওদের কুপিয়ে মারে, আগুনে ঝলসে মারে!
আচ্ছা আমার ছেলে আবরার ফাহাদ কি আপনাদের মা-বাবা তুলে গালি দিয়েছিলো? অথবা বংশ তুলে? ও কি কাউকে খুন করেছিল? শুধুমাত্র সন্দেহের বশে আপনারা ওকে পিটিয়ে মেরেই ফেললেন? ওখানে যারা উপস্থিত ছিলো তাদের কারো মধ্যেই কি কলিজা, হৃদয় বলতে কিছুই ছিলো না? আমার বাচ্চার আর্তনাদ কি কারো মনে সামান্য দয়া জাগায়নি? একজন মাত্র মানুষও কি ছিলো না সেখানে?

আমার ভাবতে কষ্ট হয়! সারা শরীরে ছেলের আমার রক্ত জমাট বেঁধে আছে, কতোটা ভয়ানক কষ্ট পেয়ে ও মরেছে কেউ কি ভাবতে পারেন? এভাবে পিটিয়ে মানুষ মারা যায়? হ্যাঁ যায় তো – এর আগে আমার ছেলে বিশ্বজিৎকে এভাবেই কুপিয়ে মেরেছিলো সন্দেহের বশে – সেদিনও কেউ বাঁচাতে আসেনি।

ওর লিখাটা কেউ একজন পড়ে শুনিয়েছিল, আচ্ছা মতের ভিন্নতা ঘরে ঘরেই থাকে, তাই বলে কি আমরা তাকে মেরে ফেলি? যারা ওকে পিটিয়ে মেরে পৈশাচিক আনন্দ নিলো, তারা কি একবারও নিজেদের আপন ভাইকে সে জায়গায় কল্পনা করতে পারেনি? নাকি এই বোধই হারিয়েছে?

সন্তান জন্ম দেয়া, তাকে বড় করা – এসব কি ওরা বোঝে? মধ্যবিত্ত মা-বাবার অনেক স্বপ্নই আলোর মুখ দেখে না – তারা সন্তানের মাঝেই সেই স্বপ্নগুলোকে বাঁচিয়ে রেখে দিন কাটায়, আমার তরতাজা ছেলেটা শুধু সন্দেহের জন্যেই মরে গেলো? সারা দুনিয়ার সবকিছুর বিনিময়েও সেই ছেলে আর ফিরবে না, মায়ের কাছে আবদার করবে না, আমি ছুটিতে ছেলের অপেক্ষায় আজীবন রইবো যতক্ষণ বেঁচে থাকবো! এই দিনের জন্যে কি আমি সন্তান বড় করেছি? দরকার হলে মেরে ছেড়ে দিতো – টাকা চাইলে আমি মা যেখান থেকে পারতাম এনে দিতাম – দরকার হয় আমাকেই মেরে ফেলতো! আমার ছেলেকে তুচ্ছ বিষয় নিয়ে মেরেই ফেললো! এটা কি হত্যাকাণ্ড না?

অদৃশ্য গোপন কোন ইচ্ছার বলি হলো ফাহাদ? সুনজরের আশায় কি এমন হিংস্রতার জন্ম হয়? ক্ষমতার জন্যে আদিমতা কী করে হাতিয়ার হয়ে উঠে? কতোটা মানবিকতার বিপর্যয় ঘটেছে আমার মোটা মাথায় এটাও ঢুকছে না! সর্বোচ্চ বিদ্যাপিঠে এসব কীভাবে ঘটে, যেখান থেকে তৈরি হয় মানুষ হবার ধাপ? কারও কানেই কি ফাহাদের করুণ আর্তনাদ ঢুকেনি নাকি সবাই কানে তুলা দিয়ে বসেছিল? দলের প্রতি আনুগত্য দেখাতে গিয়ে ভাইয়ের গায়ে হাত দিতে যাদের বাঁধে না, তারা আসলে কারা? ঘায়েল করার এই নিচু মানসিকতা তাদের কোথায় টেনে নিচ্ছে, ভাবে কি একবারও?

নিজ দেশে নিজের ভাবনাটুকু শেয়ার করাই কি অপরাধ? যদি অপরাধ হয় তার জন্যে কি দেশে আইন- আদালত নেই? নাকি তারা সেসবে বিশ্বাসী না? তাহলে আমরা কার কাছে যাবো?

রোহিঙ্গা নিয়ে আমাদের ভালবাসা আছে, ঐক্য আছে, ধর্মীয় ভ্রাতৃত্ববোধ আছে, অথচ নিজ দেশে নিজ ভাইয়ের প্রতিই নাই! এ কোন সভ্যতা? যেখানে মানবিকতা লোকদেখানো!

ক্ষমতা যদি উন্মাদ করে দেয় তাহলে শিকড়েই তাকে মেরে ফেলা উচিত, হ্যাঁ ছাত্র রাজনীতির কথাই বলছি আমি। আমার ক্ষমতার জোরে আমি যা ইচ্ছা তাই করতে পারি না, তুচ্ছাদি বিষয় নিয়ে আদিমতায় মেতে উঠার অধিকার আমাকে কেউ দেয়নি, আমার ক্ষমতা যদি আমার ভেতর পৈশাচিকতার জন্মই দেয় – তাহলে কি আদৌ সেটার দরকার আছে কিনা ভাবার সময় অনেক আগেই এসেছে, ক্ষমতার অপব্যবহার করে কীসব হচ্ছে তা প্রকাশ্যে এসেছে আরও আগেই।

এ কোন যুগে বাস করি আমরা? যেখানে শুধুমাত্র সন্দেহের বশেই পিটিয়ে মারা যায়? আবরার যদি শিবির হয়ও, তাকে মারার অধিকার কে দিয়েছে? নাকি যাদের উপরে জোর চলে তাদের নিপীড়িত করার মাঝেই সব আনন্দ! যারা বলছেন সুবিচার হবে – তাদের বলি, কেউই ওদের বিপক্ষে কথা বলার সাহস পাবে না, এরা দল করে নিজেদের আগের গুছানোর ধান্দায়, নাহলে মনের পশুবৃত্তিগুলো মাথাচাড়া দিয়ে উঠতো না — ভাবতে কষ্ট হয় এরা মানবসন্তান? পশুরাও খিদে পেলে শিকার করে আর এরা? পুঁথিগত আর প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষার উপরে জোর দিতে গিয়ে এই সন্তানদের কি অজান্তে অনুভূতিহীন আর অসাড় করে ফেলেছে মা-বাবা?

আমি সুশীল সমাজকে খুঁজে বেড়াচ্ছি, যারা টিভিতে টকশোতে বড় বড় বুলি কপচায় তাদের! আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দেন —আমার ছেলেমেয়ে পড়ে পড়ে মার খাচ্ছে, আমি অক্ষম মা কোথায় যাবো, কার কাছে যাবো? আর কতো নির্বাক হয়ে সন্তানের মৃত্যুযন্ত্রণা নেবো? আপনাদের সন্তানেরা বিদেশে নিরাপদে আছে – আমার সন্তানদের জন্যে কে আছে? মানবিকতার বিশাল বিপর্যয়ের পরেও আপনাদের মুখে তৃপ্তির ঢেঁকুর দেখলে আমার সহ্য হয় না, আমার জায়গায় আসেন – নিজের সন্তানকে আমার সন্তানের জায়গায় বসান তারপর দেখবেন দুর্ভেদ্য অংক মিলবে আমার।

উটপাখির মতো আর বালিতে মুখ গুঁজে বাঁচতে ইচ্ছে হয় না – শরীরের একটা অংশ যখন চলে যায় তখন জীবন্ত ফসিল হয়ে বেঁচে থাকাটা দুঃসহ কষ্টকর ব্যাপার। পারলে মা-বাবাগুলোকেও মেরে ফেলেন, বেঁচে থাকলেই সুবিচারের জন্যে – ঘ্যানঘ্যান করবে, দুয়ারে দুয়ারে ঘুরবে, কিন্তু সেটাও পাবে না কোনদিন আমি নিশ্চিত!

সন্তানের এপিটাফ লেখার জন্যে আমি তো সন্তান জন্ম দেইনি! সন্তানের মৃত্যুর সংখ্যা দিনে দিনে বেড়েই চলছে, আর আমি তো বিশ্বজিৎ হত্যারই সুবিচার পাইনি, আবরারের বেলায় কী আর পাবো!

অন্যায়ের কাছে বারবার মানবতা হেরে যাচ্ছে, ইতিহাসের পাতায় আমরা নিজেদেরকে কোথায় নিচ্ছি? শক্তির কাছে বারবার পরাজিত হচ্ছে মানবিকতা। বর্গী, লাঠিয়াল কিংবা ইংরেজ না – আমরা এখন নিজেরাই নিজেদের আপনজনদের মেরে নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব বজায় রাখছি – এর চেয়ে লজ্জা আর কিছু কি আছে?

শেয়ার করুন: