আইরিন হক:
লোপার সাথে প্রথম পরিচয়ের দিনটি কথা খুব মনে পড়ছে!
আজ থেকে ৩৩ বৎসর আগে, সালটি ১৯৮৬, তবে তারিখটি মনে নেই..রাজশাহী বিআইটি (এখনকার রুয়েট) তড়িতকৌশল বিভাগের প্রথম বর্ষের ক্লাসের প্রথমদিন। বোধ হয় ৪০-৪৫ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে আমরা ছিলাম হাতে গোনা পাঁচজন ছাত্রী।
ভীষণ বুদ্ধিদীপ্ত মুখখানা, রোদ ঝলমলে সকালের হলুদ আলোর মতো গায়ের রং, কালো সিল্কি চুল, ছিপছিপে গড়ন, কালো মেটালিক ফ্রেমের চশমার নিচে বড় বড় চোখ, গম্ভীর অথচ আন্তরিক মেয়েটিই ছিল লোপা! দুচারটি কথা বলার পরই বুঝতে দেরি হলো না যে ও অত্যন্ত গভীর মনের মেয়ে।
একদিন দুদিন করে করে লোপা আর আরেক বন্ধু মিতু আর আমি এ তিনজনের দারুণ বন্ধুত্ব হয়ে গেল! আমার ঢাকার বাইরে থাকার অভিজ্ঞতা ঐ প্রথম। প্রথমদিকে নতুন জায়গায় এসে আমি কিছুটা ভয় এবং সংশয়ে ছিলাম ..কিন্তু লোপা আর মিতুর বন্ধুত্বে আমার সময়ই লাগেনি রাজশাহীকে সেকেন্ড হোম বানাতে।
কতদিন যে আমরা তিনজনে একসঙ্গে ঘুরেছি .. ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাস, রাজশাহী শহরে একমাত্র চাইনিজ রেস্টুরেন্টে চাইনিজ খাওয়া। একসাথে ক্লাস, ল্যাব, পড়াশোনা, লাইব্রেরি, কমনরুমে বসে আড্ডা একটানা পাঁচ বৎসর। বিআইটির সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানগুলোতে লোপা আর মিতু অংশগ্রহণ করতো- গান, নাচ, কবিতা করতো ওরা, সবসময় ওদের সাথে থেকেছি আবার কখন কখন গানে গলাযও মিলিয়েছি ওদের সাথে। পরে শুনেছি আমাদের তিনজনকে বলা হতো ইলেকট্রিকেলের তিন কন্যা!
আমরা যখন বিআইটিতে, তখন মিজান ঢাকাতে বুয়েটে পড়ে। আমি যখন ছুটিতে ঢাকায় আসতাম, প্রতিবারই আমার কাছে লোপা মিজানের কাছে লিখা চিঠি পাঠাতো। মিজান কোনো বিলম্ব না করে পরের দিনই চলে আসতো চিঠি নিতে, আর কোনবারই মিজান ভুলতো না লোপাকে লিখা চিঠিটা আমার কাছে দিতে। আমি লোপাকে কখনও জিজ্ঞেস করিনি ও কেন আমার মাধ্যমে চিঠি পাঠাতো, ওতো ডাকযোগেও পাঠাতে পারতো।
ওদের যুগল জীবনের গভীর ভালবাসা দেখে এখন মনে হয় .. হয়তো লোপা ভাবতো আমি না হয় দেখা করতে পারছি না, বন্ধু আইরিনের সাথে তো দেখা হলো মিজানের, আবার চিঠিটিও মিজানের কাছে পৌঁছাতে মিস হবার কোন চান্সও নেই। আমি যখন ঢাকা থেকে রাজশাহীতে এসে মিজানের চিঠি লোপাকে দিতাম, মিতু আর আমি জোর করে বলতাম এক্ষুণি পড় (ঐ একটি সময়ই আমি লোপাকে তুই করে বলতাম), ও খুশি ভরা মুখে মিষ্টি হেসে চিঠি পড়তো, আজও মনে পড়ে ওর সেই হাসি মাখা মুখখানা।
বিআইটিতে পড়ার সময় কতদিন যে লোপাদের রাজশাহী ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের বাড়িতে আমি থেকেছি, একসাথে সকালে নাস্তা, রাতের খাবার, পড়াশুনা! খুব মনে পড়ে লোপা আর চাচার খাবার টেবিলে বসে কথোপকথন..(লোপার বাবা গোলাম মোর্শেদ চাচা রাজশাহী ইউনিভার্সিটি’র পলিটিক্যাল সাইন্স এর অধ্যাপক ছিলেন)। কখনও রাজনীতি, কখনও এরশাদবিরোধী আন্দোলন, কখনও ৭১, ক্যাম্পাসের খবর, ক্যাম্পাসের যেকোনো অসঙ্গতি নিয়ে আলোচনা হতো। আমি তখনই বুঝেছিলাম লোপার চিন্তাচেতনা আর অন্য অনেক মেয়েদের চেয়ে একটু আলাদা। লোপার বাবা, মা আর দুটি ভাই উদয় আর তন্ময়কে নিয়ে সুন্দর পরিবারটিকে দেখে সত্যি খুব মুগ্ধ হোতাম।
এরশাদ বিরোধী আন্দলনের কারণে সেশন জট হয়েছিল ফলে আমাদের কিছুটা সময় বেশি লেগেছিল, ১৯৯১ এ ইঞ্জিনিয়ারিং শেষ হয় আমাদের। তারপর আমি ১৯৯২ এর প্রথমদিকে যুক্তরাষ্ট্রে চলে আসি, পরে অন্য বন্ধুদের কাছে শুনেছি লোপা মিজানকে বিয়ে করে জাপান চলে এসেছে। পরে মিজান খুব সম্ভবত ১৯৯৪ দিকে যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় এর পারডু ইউনিভার্সিটিতে চলে আসে লোপাসহ। আবার নিয়মিত যোগাযোগ শুরু হয় ওর সাথে। মিজানের পড়াশোনা শেষে চাকরি নিয়ে ওরা ক্যালিফোর্নিয়ায় চলে যায় সম্ভবত ১৯৯৭-৯৮ এ।
লোপা ওখানে মাস্টার্স করলো, ওদের কোল জুড়ে আলো করে দীপ্ত এলো ২০০০ এ। নিয়মিত যোগাযোগ করি আমরা। মিতুও তখন ক্যালিফোর্নিয়াতে, ফলে আমাদের তিনজনের মধ্যে কোন না কোনভাবে মোটামুটি যোগাযোগ ছিল।
একবার আমি ক্যালিফোর্নিয়ার বে-এরিয়ায় ওর বাড়িতে বেড়াতে গিয়েছিলাম, দীপ্ত আর আমার ছোট মেয়ের বয়স তখন চার আর আমার বড় মেয়ে ছয়। ও কতোকিছু রান্না করে যে খাওয়ালো। পরে লোপা, মিজান আর দীপ্তকে নিয়ে আমার নিউ জার্সির বাড়িতেও এসেছিল। সেই সুন্দর ঝকঝকে লোপা, ফুটফুটে দীপ্ত, শান্ত অথচ দৃঢ় মিজানের চেহারা আজও আমার দৃশ্যপটে ভাসে।
খুব বেশিদিন কেন যেন লোপার ক্যালিফোর্নিয়া ভালো লাগেনি, আবহাওয়া বা অন্য কী কারণ তা আর ওঁকে জিজ্ঞ্যেস করা হয়নি। একসময় ক্যালিফোর্নিয়া ছেড়ে বস্টন মুভ করলো, আমি খুব খুশি হয়েছিলাম এই ভেবে যে লোপা ইস্ট কোস্টে, সুতরাং দেখা করতে পারবো আরও বেশি। কিন্তু অস্বাভাবিক শীতের কারণে বোধ হয় ওর বস্টনও ভাল লাগেনি, শেষমেষ ও পোর্টল্যান্ড অরেগনে স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করলো। সত্যি সত্যিই যে লোপা পোর্টল্যান্ডে চিরস্হায়ী হয়ে যাবে, তা কে জানতো?
২০০৬ এ লোপা হঠাৎই ওর সারকোমার খবরটি জানায়, দীপ্তর বয়স তখন মাত্র ৬। মনটা ভীষণ বিষন্নতায় ছেয়ে যায় খবরটি জেনে। তারপর লোপার পায়ের সার্জারি, রেডিয়েশন থেরাপি, নিয়মিত পরীক্ষা-নিরীক্ষার খবর আমি সবসময়ই নিতাম। অনেকগুলো স্পট ছিল ওর শরীরের বিভিন্ন জায়গায়, তবে শুনতাম লাংগের স্পটগুলোকে ডাক্তার বেশি খেয়াল রাখছিল।
এরই মধ্যে লোপা ফেসবুকে ওর এই সংগ্রাম নিয়ে লেখালেখি শুরু করে। ওর মেডিকেল চেকআপের আগে এবং পরের অনুভূতি, আর কী করে দীপ্তকে বা নিজেকে সামলাচ্ছে সবকিছু গুছিয়ে লিখতো! আমি পড়ি আর অবাক হই, দূর থেকে ওর হাত দুটি ধরি আর প্রার্থনা করি স্রষ্টা যেন ওঁকে আরও অনেক শক্তি দেন!
আমি সত্যি আশ্চর্য হতাম, রেডিয়েশন থেরাপির সাইড এফেক্টের কারণে পায়ের ব্যথা এবং সারকোমা ভয়ংকরভাবে ফিরে আসার আশংকা নিয়েও লোপা কতধরনের কাজে যে জড়িয়ে গিয়েছিল – বাংলা স্কুল, বাংলাদেশীদের নিয়ে দেশের প্রোগ্রাম, ফান্ড রেইজিং করে দুর্গতদের পাশে দাঁড়ানো। নিজের যুদ্ধের পাশাপাশি নানান অসঙ্গতির বিরুদ্ধে কলমযুদ্ধেও যেন ও লিপ্ত হয়- পরিবার, সমাজ, দেশ, গোটা পৃথিবীর সমস্ত অসঙ্গতি যেন ওঁকে ভীষণভাবে আঘাত হানে, আর এসব বিষয়গুলো নিয়ে লিখে যায় ওর ভাবনা।
৭১ এর মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকারদের বিচার, রানা প্লাজা ধসে পড়া, সংখ্যালঘুদের উপর অবিচার, নির্যাতন, দারিদ্রতা, ধর্মান্ধতা, গণজাগরণ মঞ্চ, নারীর অধিকার, শিশু অধিকার, প্রতিবন্ধীদের অধিকার, ধর্ষণ থেকে শুরু করে নানান সামাজিক অপরাধ – এসব বিষয়গুলো নিয়ে শুধু সচেতনতা মূলক লেখাই না, কী করে প্রতিকার করা সম্ভব তাও লিখতো ও।
আমি লিখাগুলো পড়েছি আর অনেক সময় ফেসবুকে কমেন্ট করেছি, আবার অনেক সময় ফোন করে আলাপ করেছি। কোনো কোনো লিখা আমি আমার টাইমলাইনেও শেয়ার করতাম যেন আমার বন্ধুরাও পড়তে পারে। ওর লিখাগুলো মনে হতো যেন অনেকেরই মনের কথা।
ফেসবুকে ওর নিয়মিত লিখা দেখে একবার ওঁকে বলেই ফেললাম, লোপা, তুমি এতো কিছু লিখছো বই আকারে প্রকাশ করলে কেমন হয় (তখন আমার মূল উদ্দেশ্য ও বই ছাপাবার আগ্রহে আরও লিখায় সময় দিবে, তাতে ওর প্রাত্যহিক জীবনের যে কষ্ট তা কিছুটা হলেও হয়তো ভুলে থাকবে)।
ওর সেই মিষ্টি হাসি দিয়ে বলা, “আইরিন আমার লিখা কে ছাপবে আর কারাই বা পড়বে”? আমি তখন বললাম আমি যদি ব্যবস্থা করতে পারি তুমি রাজি হবে? প্রথমে রাজি হতে চায়নি, দু তিনদিন বাদে কী মনে করে বললো…দেখ। আমি বললাম, তুমি লিখে যাও আমি দেখি কী করা যায়, আর বইটির নাম আর প্রচ্ছদ কী রকম চাও তা একটু ভাবো। তারও দুদিন পরেই আমাকে ফোন করে ও জানালো বইটির নাম দিবে “এক যোদ্ধার ডায়রি”।
আমি খোঁজ করা শুরু করলাম। ২০১৩ প্রথমদিকে আমার বর দেশে গেল, তার এক বন্ধুর মাধ্যমে একজন প্রকাশক পেলাম, উদ্দেশ্য ২০১৪ র ২১ ফেব্রুয়ারি বইমেলায় লোপার বইটি প্রকাশ হবে। প্রকাশক নিজেই ওনার কোন পরিচিতির মাধ্যমে কয়েকটি প্রচ্ছদ লোপাকে পাঠায় ই-মেইলে, লোপা একটা প্রচ্ছদ বাছাই করে। কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত প্রকাশকের অসুস্হতার কারণে একটু সময় লাগছিল, পরে লোপার আম্মা (শ্রদ্ধেয় চাচী) বইটির প্রকাশনার বিষয়টি সময় এবং শ্রম দিয়ে দেখাশুনা করেন, ফলে সময়মতোই ২০১৪ সালের ২১ শে ফেব্রুয়ারি বইমেলায় “এক যোদ্ধার ডায়রি” বইটির প্রকাশ হয়। বইটি প্রকাশ করা, কবে, কীভাবে প্রকাশ হবে, বইটির নাম, প্রচ্ছদ বাছাই করা, লোপার বিভিন্ন সময়ের মৃদু আনন্দের প্রকাশ, সময় লাগছিল বলে ওর কিছুটা উদ্বিগ্ন হওয়া এসব নিয়েই আমার সাথে নিয়মিত ফোনে আলাপ হতো … আজ সবই স্মৃতি অম্লান।
২০১১ আর ২০১৪ ওর দুবার লাং সার্জারির পর আমি লোপাকে দেখতে যাই পোর্টল্যান্ডে। এতো বড় বড় সার্জারির পড়েও একটা মানুষ এতোটা শক্ত কী করে থাকতে পারে (পিঠে আর পায়ে ব্যথা নিয়ে) ওঁকে না দেখলে বোঝা যায় না।
২০১৪ পর আমার আর যাওয়া হয়নি তবে নিয়মিত ফোনে আলাপ হতো। সবসময়ই বলতাম লিখছো তো? পরে আরেকটি বই “জীবন গল্প চিন্তা” ২০১৮ প্রকাশ করলো.. আনন্দে আমার বুক ভরে যায় যে লোপা লেখালেখি নিয়ে ব্যস্ত থেকেছে। ২০১৮ শেষের দিকে ২০১৯ এর প্রথম দিকে ওর শরীর আবার বেশ খারাপের দিকে যাচ্ছিল। আমার আর মিতুর খুব ইচ্ছে ছিল আমরা দুজন একসাথে লোপাকে দেখতে যাবো। বিভিন্ন কারণে সময় মেলাতে পারিনি। তবে এ বছর অনেকবারই বিশেষ করে ওর ফেসবুকে “I am not doing good” পোস্ট দেখে আমি আর মিতু ওর ওখানে যাবো বলে ওঁকে অনুরোধ করি, ও কিছুতেই রাজি হলো না!
আমাদের প্রিয় লোপা চলে গেল ২৩শে সেপ্টেম্বর ২০১৯ এর সকালে! ১৩টি বছর অসীম সাহস আর ধৈর্য্য দিয়ে অত্যন্ত কঠিন এই যুদ্ধে টিকে থেকে এক প্রকার আমাদের অভ্যস্তই করে ফেলছিল যে এ কঠিন যুদ্ধটি বোধহয় ও এভাবেই চালিয়ে যেতে পারবে আরও অনেক কাল, তাই ওর চলে যাওয়া মেনে নেয়াটা বড় কঠিন হয়ে পড়ছে।
আমি আর মিতু গিয়েছি লোপাকে শেষবারের মতো দেখতে ২৬ শে সেপ্টেম্বর আর ২৭ শে সেপ্টেম্বর ওর ভালবাসার মিজান আর দীপ্ত এবং প্রাণপ্রিয় দুটি ভাই পরম আদরে ওঁকে চিরনিদ্রায় শায়িত করে!