ফাহমিদা খানম:
এদেশের প্রেক্ষাপটে যোগ্যতা বিচার হয় দুইভাবে –
১। যখন যে দল ক্ষমতায় তাদের তেল দিবেন
২। গ্রুপিং করে চলবেন
আপনি যদি সৎ থাকতে চান তাহলে ধরে নিন সবকিছুই আপনার জীবনে দেরী করে আসবে, কারণ আপনি এখনো ব্যাকডেটেড কিনা! এদেশে কর্মদক্ষতা ব্যাপার না — আপনি বসকে তেলিয়ে চলবেন, তাদের পরিবারকে তেল দিবেন – দরকার হলে বসের বাসার পারসোনাল কাজও করে দিবেন – তবেই আপনি বসের মন পাবেন অথবা চাকুরী করার সময়ে নিজেরা মিলে একটা গ্রুপ খুলে ফেলবেন –তারপর আপনাকে আর ভাবতে হবে না –যোগ্যতা থাক আর নাই থাক অন্যরা আপনাকে টেনে তুলবেই, মনে রাখবেন রসুনের কোয়া আলাদা কিন্তু পশ্চাত এক।
কর্মদক্ষতা, সিনিয়ারিটি এসব কোনো ব্যাপার না এদেশে আর বোধ, বিবেক, নৈতিকতা সব এখন বস্তাপচা সেন্টিমেন্ট, বিবেকবাবুকে কোথাও দেখি না আর! অন্যায় করলেও অন্যরা যখন সমর্থন জানায় তখন বুঝি গ্রুপিং এর মাজেজা, স্বার্থের জন্যে আপনি ক্ষমতার অপব্যবহার করলেন – আমি সব দেখেও চুপ করেই রইলাম, কিন্তু আমি বঞ্চিত হলাম প্রাপ্যতা থেকে — আমার দীর্ঘশ্বাস আপনি বুঝলেন না স্বার্থের জন্যে, কখনো ভেবেছেন — উপরে গিয়ে কী জবাব দিবেন?
মুখে আপনারা যতই নিজেদেরকে তুলসী পাতা বানানোর চেষ্টা করুন না কেনো – মনে রাখবেন আপনার কারণে পুরো সিস্টেম বদলে যায় – শিক্ষা আপনার কাছে একটা সনদ ছাড়া কিছুই না, বোধ, বিবেক কতটুকু অন্তরে ধারণ করেছেন? পুঁথিগত বিদ্যা মুখস্ত করেছেন মাত্র!
অন্যদের ঠেলে ফেলে যারা নিজেদের ভাগ্য বদলায় এসব চতুর মানুষ এখন চারপাশে, এদের জন্যে অন্যরা ভোগান্তির শিকার হয় তারপরেও দেখবেন এরা অন্যদের জ্ঞান কপচাইতে আসে, নিজের ঢোল পিটায় – অন্যায়কে একটা রূপ দিতে হবে যে!
এমন মানুষ দেখেছি যারা বসদের তেলিয়ে নামেমাত্র অফিস করতো, প্রাইভেট
প্র্যাকটিসে সময় দিতেন বেশি — বসেরা জেনেও চুপ করে থাকতেন। এরা দুইপক্ষই এটাকে অন্যায় ভাবেনি — স্বার্থের জন্যে। এদের যখন ধর্মীয় জ্ঞান দিতে দেখি সহ্য হয় না।
অন্যায় — অন্যায়ই সেটা যে করুক! সম্মান কিন্তু জোর করে আসে না, এটা ভেতর থেকেই আসে আর আপনাদের পদবীর জন্যে সবাই যে জ্বি স্যার করবে –এই আশাও ভুল! মুখে এক অন্তরে আরেক মানুষদের বলে মুনাফিক – এদের অন্তর থেকেই ঘৃণা করা ছাড়া আরকিছু করার ক্ষমতা নাই, ঐ যে ভদ্রতা! সেটাই কাল!
এদেশে অন্যায় করেও চুপ থাকার জন্যে অনেকেই ধর্মকে বেছে নেয় —ধর্মীয় বাণী শেয়ার আর হজ করলেই অন্যায় বৈধতা পায় না, আর কিছু হজ করে স্ট্যাটাস বজায় রাখার জন্যে —আগে করেছেন তা না হয় মানলাম, হজের পরে তো অন্তত নিজেকে বদলাতে পারতেন! এর পরেও অন্যায় করে লজ্জিত না হওয়া বিরাট অন্যায়।
এদেশের একটা অংশ নীরবে, অভিমানে দেশ ছাড়ছে, পড়ার জন্যে গেলেও বেশিরভাগই আর ফিরতে চায় না, সবাই কি আর নিজের আত্মাকে, নিজেকে বিক্রি করতে পারে? পরিচিত অনেককেই দেখছি চাকুরী ছেড়েও চলে যেতে – কারণ যোগ্যতার যে দুই ধাপ আছে তার সাথে নিজেকে খাপ খাওয়াতে পারে না। যাদের খুঁটির জোর নেই চামচামি, তেল দিয়ে চলতে পারে না – তাদের এদেশ মূল্যায়ন করে না।
এদেশের এক নাম্বার যোগ্যতাই এখন সেগুলো — চারপাশে তাকান ভুরি, ভুরি উদাহরণ পাবেন। কিছু মানুষ অধস্তনদের খাটিয়ে নিজেরা হাওয়া খেয়ে বেড়ান — কখনো বিবেকের দরজা খুলে ভাবেন না — এদেরও পরিবার আছে, সেখানে সময় দেয়া দরকার! নিজেরা সকল সুবিধা নিলেও কাজ শেষ হলেই সে সকল সুবিধাদি বন্ধ করে দেন — দিনশেষে এসব তথাকথিত বসেরা ভালই থাকেন, কারণ বিবেকের দরজা পুরোপুরি বন্ধ করে দিয়েছেন, কিছু মানুষ আরো একধাপ আধুনিক – মানে বসের সামনে এক চেহারা, অন্যদের সামনে আলাদা।
অনেক মা-বাবা চান না তাদের সন্তান দেশে থাকুক, কারণ ভালো চাকুরী পেতে হলে টাকা ঢালতে হবে, আর সন্তানের যদি বিবেক থাকে তাহলে আরেক মুসিবত! এই ছেলে/মেয়ের ভবিষ্যত পুরাই অন্ধকার। সবাই চাটুকারি করতে জানে না, কী হবে দেশে থেকে? পড়ার জন্যে গেলেও কয়জন ফিরে? বা ফিরলেও আমরা কতটা তাদের মূল্যায়ন করি? যে সন্তান দেখে তার বাবার যোগ্যতা থাকা সত্ত্বেও নোংরা গ্রুপ পলিটিক্স এর শিকার, বাবার জুনিয়ররা পেরেছে কিন্তু বাবা পারেনি — সে সন্তানদের কথা চিন্তা করুন! না পারে বাবাকে বদলাতে, না পারে সিস্টেমের বিরুদ্ধে যেতে।
এদেশে এখন সবই ছক কষা থাকে — এর বাইরে কিছুই সম্ভবপর না। যারা নিজেদের বিবেক, বোধ নিয়ে থাকে তাদের সঠিক সময়ে কিছুই হয় না, অন্যায় জেনে, বুঝেও চুপ থাকতে হয় – এভাবেই চলছে দেশ – কেউ স্বীকার করুন আর নাই করুন! মধ্যবিত্ত কিছু মানুষ স্রোতে ভাসতে পারেন না – চিন্তা করুন এদের পরিবারের কথা! যে আদর্শ নিয়ে চলছে সেটা যে মূল্যহীন এদেরকে বুঝানো সম্ভব না, ভুক্তভোগী হয় পরিবার।
যারা দেশ ছাড়ছে তারা কি বলে দিয়েছে দেশ আমার পুর্বসুরীদের? বোধ, বিবেক, সততা সবই এদেশে বস্তাপচা সেন্টিমেন্টের নাম, এদেশে আত্মসম্মান নিয়ে চলা মানুষেরা নিজেরা ঠকে, তাদের পরিবার ঠকে। কর্মদক্ষতার চেয়েও বেশি গুরুত্বপুর্ণ চামচামি আর গ্রুপিং।
চারদিকের অবস্থা দেখে বড় ক্লান্ত লাগে, একবার ঘুণপোকা ধরলে ভেতরে , ভেতরে সবই নিঃশব্দে কেটে ফেলে, সবচেয়ে খারাপ লাগে এসব মানুষের গলার জোরই এখন বেশি, অন্যায়কে তারা আর অন্যায় ভাবছে না। সম্মান দূরের কথা যখন নীতিবাক্য ঝাড়ে ইচ্ছে হয় মুখের উপরেই বলি — আগে আয়নায় নিজেকে দেখেন পরে আইসেন জ্ঞান দিতে!
ঐ যে ভদ্রতা – সেটার জন্যেই পারি না। এরা আমাদের কী ভাবে? আমরা কি ঘাস খাই? নির্লজ্জ, বেহায়া মানুষের সংখ্যা আশংকাজনকভাবেই বাড়ছে। এই হচ্ছে আমার দেশ যেখানে দুর্নীতি আর নীতির মূল্য নেই এক আনাও,
চারদিকের অবস্থা দেখে হতাশা চেপে ধরে —সন্তানেরা ভুক্তভোগী হোক –একদমই চাই না, যেখানে যোগ্যতার, সততার, কর্মদক্ষতার মূল্য আছে – সেখানেই থাকুক সন্তানেরা – নিজেদের বিকিয়ে চলুক একদমই চাই না।
# আমার এই লিখা পড়ে কিছু মানুষ বলবে নাহ আমরা যোগ্যতায় এখানে এসেছি, এসব ফালতু কথা। আচ্ছা আপনি কি ভাত হইছে কিনা পাতিলের সব চাল টিপে দেখেন? আমি কিন্তু পাতিলের একটা চাল টিপেই বুঝি ভাত হইছে কিনা!