অশ্রু ও ঘামে ভেজা রোমের গল্প (পর্ব- পাঁচ)

লুতফুন নাহার লতা:

রোমের রেলস্টেশন তেরমিনি থেকে বেরুবার মুখেই সেই বিশাল নগর প্রবেশদ্বার। শহরে প্রবেশের প্রধান দরওয়াজা। পোরতা মাজ্জোরে। মেজর পোর্ট। বা প্রধান গেট। এটি তৃতীয় শতকের তৈরি রোমের পূবের গেট আর এর সাথে লাগোয়া রয়েছে এক বিস্ময়কর অরেলিয়ান দেওয়াল। রোমের প্রথম ক্রিশ্চান এম্পেরর কন্সতান্তিন প্রথমে এবং পরে থিওডোসিয়াস তৈরি করেন শহর রক্ষা দেওয়াল এবং সেই দেওয়ালের ভিতর দিয়ে সারা শহরে প্রবাহিত করা হয় নিকটবর্তী ঝর্ণা থেকে সুপেয় জলের ধারা।

এখন সামার। দিন অনেক বড়। সন্ধ্যের মুখে এখনো তাই আলোয় উজ্জ্বল এ শহর। আকাশ তার হালকা নীল আঁচল বিছিয়ে রেখেছে মাঝে মাঝে তার সাদামেঘের কল্পতরু। কী যে সুন্দর রোমের আকাশ! পথে যেতে যেতে পথের দু’ধারে শ্বেত করবী আর রক্ত করবীর গাছ দেখে মুগ্ধ হয়ে গেলাম। মাঝে মাঝে দীর্ঘকায় পাইন বৃক্ষ দাঁড়িয়ে আছে নিঃসঙ্গ, একাকি নিঃশব্দ প্রহরীর মতো। পাইন আমার দেশী নয়, তবু সে হাত বাড়িয়ে দেয় হ্যালো বলে। আর রক্ত করবি! সে তো হেসে হেসে চোখ নাচিয়ে আনন্দে তিন পাক নেচে আমাকে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরে।

জাকারিয়ার বাসা শহর থেকে একটু দূরে ‘তরবেল্লা মনাকা’ এলাকায়। সেখানে পৌঁছে দেখি আমার জন্যে রান্না-বান্না করে মহা আয়োজন সাথে নিয়ে অপেক্ষমান বন্ধু স্ত্রী শিল্পী। পরিচয় হলো ওদের পারিবারিক বন্ধু আরিফা শাহীন, বেবী, রতন রীনা আর মামুন এর সাথে। ডিনার শেষে সবাই মিলে দেখতে গেলাম রাতের রোম।

শুরুতেই রাতের কলোসিয়াম। ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, হঠাৎ ক্যাচ ক্যাচ করে খুলে গেলো দুই হাজার বছর আগের সেই কলোসিয়ামের দুয়ার। চমকে চমকে উঠছি আর দেখছি পুলিতে পড়েছে টান, ভরে গেছে এমফি থিয়েটারের ফ্লোর জলের সমুদ্রে। তাতে ভাসছে রোমান সাম্পান। যাতে বোঝাই করা আছে অপরাধী। রোমান আইনে বিচার শেষে আজ জনসমক্ষে এনেছে এই এমফি থিয়েটারে। সেখানে অকস্মাৎ ডুবিয়ে মারা হবে তাদের। এটা শেষ হলে জল যাবে সরে, শুকিয়ে যাবে মঞ্চ আবার শুরু হবে নয়া হত্যাকাণ্ড, ওদের মতে, অপরাধের বিচার শেষে এক্সিকিউশান।

তাকিয়ে দেখি চলছে গ্ল্যাডিয়েটরদের নিষ্ঠুর খেলা। দাগী আসামীদের পরিয়ে আনা হয়েছে রোমের মিথ অনুযায়ী পোষাক আর খেলায় হেরে যাচ্ছে ওরা। ওদেরকে হত্যা করা হচ্ছে নানা নিষ্ঠুরতায়। আবার কখনো পুলি টেনে তোলা হচ্ছে হিংস্র পশু আর তারা নখর দিয়ে দাঁত দিয়ে ছিন্ন ভিন্ন করে ফেলছে অসহায় মানুষগুলোকে। ক্যাপাসিটি অনুযায়ী প্রায় সত্তর হাজার জনগণের সামনে চলছে এই হত্যার উৎসব।
এইভাবে শিক্ষা দেয়া হচ্ছে দেশের জনগণকে, রোমানদের শক্তি ও শৌর্য সম্পর্কে। দেখানো হচ্ছে নিষ্ঠুরতায় ওদের অকল্পনীয় দক্ষতা ও গ্লোরি।

আমার কেবলই মনে হতে থাকলো সেই সত্তর হাজার রোমানদের সাথে আমিও বসে আছি এর স্তব্ধ গ্যালারিতে, দেখছি গ্লাডিয়েটরদের সেই নিষ্ঠুর খেলা! দেখছি আর্তনাদ, হত্যা, ক্রন্দন আর হাস্য, একই সাথে সভ্যতার নিষ্ঠুর খোরাক কীভাবে হয় আর আবার তা ঢেকে যায় সময়ের বুনট চাদরে।

রাতের কলোসিয়াম দেখে চলেছি ডাউন টাউন রোমে। সেখানে গিয়ে দাঁড়িয়ে মুগ্ধ বিস্ময়ে চেয়ে রইলাম। এই হলো Fontana Di Trevi বা রোমের ঝর্ণা। এ এক অসামান্য সুন্দর স্থাপত্য। ইতালির রোমে, ট্রেভি ডিস্ট্রিক্ট এর এই ঝর্ণাটি সারা বিশ্বের মানুষের বিনোদনের উৎস। মূল ঝর্ণাটি সম্ভবত খৃষ্ট পূর্ব ১৯ এ তৈরি। বহুকাল পরে ১৬২৯ খৃষ্টাব্দে পোপ অষ্টম আরবান, পুরনো ঝর্ণাটির সংস্কার এর প্রয়োজন হলে এর নাটকীয় এবং শৈল্পিক একটি রূপ দেবার লক্ষ্যে জিয়ান লোরেঞ্জো বারনিনিকে (Gian Lorenzo Bernini) একটি ডিজাইন করার অনুরোধ করেন। বারনিনি একটি স্কেচ তৈরিও করেন, কিন্তু পোপের হঠাৎ মৃত্যুতে প্রজেক্টটির কাজ আর করা হয়নি।

এরপরে দীর্ঘ সময় ধরে বহু আর্কিটেক্ট, বহু ম্যাথমেটিশিয়ান ও শিল্পীরা এর কাজ করেন। শিল্প, সাহিত্য ও সঙ্গীতের ‘বারোক এরা’ ছিল একটি প্রতিযোগিতাময় সময়। তখন ইতালিয়ান আর্কিটেক্ট নিকোলা সেলভি এই প্রতিযোগিতায় জিতে ১৭৩২ সালে এর কাজ পুনরায় শুরু করেন। ১৭৫১ তে সেলভির মৃত্যুর পরে তাঁর প্ল্যান অনুসারে অন্যান্য শিল্পী আর্কিটেক্টরা কাজ করেন এবং ১৭৬২ তে টিভোলি থেকে আনা উন্নতমানের ট্রাভার্টিন লাইমস্টোনে গিউসেপ পানিনি’র (Giuseppe Pannini) হাতে এর কাজ শেষ হয়।

ঝর্ণাটির মূল আকর্ষণ এর অসাধারণ নাটকীয়তায়। আলোর খেলায় আর স্রোতের ঘুর্ণিচক্রের মতো দেবতাদের শরীরের পেশী ও পোষাকের ঘুর্ণিচক্রের স্টাইল। অন্যান্য অনেক কিছুর সাথে রয়েছে প্রাচীন গ্রিক মিথলোজি অনুসারে সমুদ্রের পবিত্র আত্মা ও দেবতা ওশানাস। জলের দেবতা ট্রাইটন। রয়েছে জলের পাহারাদার সী হর্স। আর সেই সাথে অপূর্ব আকুয়া নীল জলের ধারা। এর ব্যাকগ্রাউন্ড হিসেবে রয়েছে বিল্ডিং প্লাজো পোলি (Palazzo Polli) সেই ১৭৬২ সালের ২২ মে ত্রয়োদশ পোপ ক্লেমেন্ট উৎসবের সাথে এর উদ্বোধন করেন।

সবার সাথে দাঁড়িয়ে আছি। ছবি তুলছি। মন আনন্দে নেচে উঠছে হঠাত মনে হলো আকুয়া নীল জলের ধারায় আমি ভেসে যাচ্ছি ফনতানা ডি ত্রেভির এই জলের দেবতার হাত ধরে। এই এই হাত ছেড়ো না দেবতা আমার, হে ওশানাস দেখো, আমি ভাসছি, ডুবছি তোমারই হাত ধরে, আমি আসছি কিম্বা চলে যাচ্ছি সেই সাগরের পরমাত্মার কাছে। আমার প্রার্থনা আমার ডান হাতে। সেখানে তিনটি কয়েন নিয়ে বাম কাঁধের উপর দিয়ে ছুঁড়ে দিলাম ঝর্ণার জলে।

জানি না কার নাম মনে করে রাত্রীর শিয়রে জ্বলে চোখের প্রদীপ! কার পদ চিহ্ন ডাকে বারে বারে! কে আমারে দু’চোখের জলে ভেজায় আর্ত চুম্বনে, জানি না! জানি না! ওগো শোনো তোমরা, আমি চোখ বন্ধ করে আমার উইশ কয়েন দিয়েছি ছুঁড়ে জলের অতলে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.