লড়াইটা আরও অনেককাল জারি থাকুক

ইমতিয়াজ মাহমুদ:

আপনি কি কখনো ভেবেছেন আমাদের দেশের প্রায় সকল পুরুষই, এবং অসংখ্য নারীও, কেন তসলিমাকে মন্দবাসে? মন্দবাসে কেন বললাম, কারণ পছন্দ করুন আর নাই করুন তসলিমাকে এড়িয়ে কেউ থাকেন না। নিরাসক্ত কেউ নেই বললেই চলে। সকলেরই কোন না কোন একটা বক্তব্য আছে তসলিমা সম্পর্কে। মানে হচ্ছে যে ভালো না হলেও একরকম একটা ‘বাসাবাসি’ ঠিকই আছে আপনাদের তসলিমার সাথে। সেইটাকেই না হয় ‘মন্দবাসা’ বললাম।

আমি তো আমার চারপাশে দেখেছি (প্রায়) সকল পুরুষ, এবং কিছু কিছু নারীও, এমনকি যাদেরকে আপনি অপেক্ষাকৃত লিবারেল ও সংস্কৃতিবান মনে করেন, ওরাও তসলিমা প্রসঙ্গে নাকটা একটু কুঁচকে নেয়। ধার্মিক বা সাম্প্রদায়িকেরা তো আছেই, নাস্তিক বলেন, সমাজতন্ত্রী বলেন বা মাওবাদী বলেন বা মিডিল ক্লাসের সিপিবি মেম্বাররাও, তসলিমা সম্পর্কে নিরাসক্ত নির্মোহভাবে দুইটা ভালো কথা বলবেন না।

অনেককেই দেখেবেন এইরকম, বেশ খানিকটা অভিজাত ও সংস্কৃতি ভাব গলায় ঢেলে কায়দা করে বলে কিনা, না তসলিমা নাসরিনের অনেক কথাই হয়তো ঠিক আছে, তবে …। এই ‘তবে’ বলে তসলিমাকে দুইটা গালি দিতে হবে। যেন এই গালি দুইটা না দিলে ওরা শোভন সংস্কৃত শ্রেণীতে থাকলেন না।

আপনার সমস্যাটা কী? কেন এই দেশের পুরুষ এবং পুরুষের সঙ্গিনী নারীরা তসলিমার উপর খড়গহস্ত?

তরুণ বন্ধুদেরকে বলি তাইলে, এই আপাতদৃষ্টিতে যাদেরকে লিবারেল সেক্যুলার এবং প্রোগ্রেসিভ মনে হয় তসলিমাকে নিয়ে ওদের কী সমস্যা!

(২)
ধর্ম ইস্যুটা বাদ দিলাম। তসলিমা নাসরিন যখন বলেন যে ধর্মীয় বিধানগুলি নারীর জন্যে বৈষম্যমূলক, তখন তো ধার্মিকরা রাগ করবেনই। সেই আলোচনা বাদ দিলাম। লিবারেল সেক্যুলারদের কথা বলি।

দেখবেন যে লিবারেল সেক্যুলার ধরনের লোকজন যারা তসলিমার অন্যান্য বক্তব্য সমর্থন করেন, তারা তসলিমার ব্যক্তিগত সম্পর্ক যৌনতা প্রেম ও কাম বিষয়ক কথাগুলি নিয়ে আপত্তি তোলেন। ওসব নাকি অশ্লীল, বড় অশ্লীল। তসলিমা নাসরিন নাকি কেবল ‘সস্তা’ জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্যে বা কেবল মানুষের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্যে এইসব করেন। এইগুলিতে নাকি তার অন্যসব কথা, নারীর অধিকার নিয়ে আর দশটা যেসব কথা বলেন তিনি, সেগুলিও নাকি গুরুত্ব হারিয়ে ফেলে।

বটে! প্রথমেই সস্তা কথাটা সেরে নিই। ভাইসাহেব, তিনি জনপ্রিয়তা পাওয়ার জন্যে লেখেন কিনা সেটা নিয়ে আমি তর্ক করবো না, জনপ্রিয়তা গুরুত্বহীন ব্যাপার নয়, কিন্তু তসলিমার জনপ্রিয়তাকে যদি ‘সস্তা’ বলেন তাইলে তো অসুবিধা আরকি। প্রাণ হাতের মুঠোয় নিয়ে দেশ থেকে পালিয়ে যাওয়া, পৃথিবীর যেখানেই থাকুন মৌলবাদী ও পুরুষবাদীদের হাতে নিহত হওয়ার বা নিগৃহীত হওয়ার শঙ্কা নিয়ে বসবাস করা- এই মূল্যটাকে সস্তা বলবেন না, আপনার বুদ্ধিমত্তা নিয়ে আমার সংশয় দেখা দিবে।

শ্লীল অশ্লীলের কথায় আসেন। আপনি যদি তসলিমা নাসরিনের লেখা পড়ে-টরে থাকেন, তাইলে আমাকে বলেন তো তিনি এমনকি অশ্লীল কথা লিখেছেন যেটা এর আগে বাংলায় লেখালেখিতে আসেনি! না, প্রেম কাম নরনারীর সম্পর্ক শরীর এইসব তো সকল সৃজনশীল লেখকের লেখাতেই কম বেশী আসে। একেকজন একেকভাবে লেখেন, কিন্তু লেখেন সবাই-ই।

উদাহরণ দিতে পারি অজস্র- গীতগোবিন্দের কথা তো জানেনই। আরেকটা উপন্যাসের কথা মনে পড়ছে, সম্ভবত সেলিনা হোসেনের নীল নিশীথ, সেখানে একজন বিবাহিতা নারী অবিবাহিত একজন যুবকের সাথে মাঝে মাঝেই মিলিত হয়। কিন্তু সেখানে নারীটি যুবকটিকে কেবল পেছন দিক দিয়ে করতে দেয় তাতে করে সে মানসিকভাবে তার স্বামীর প্রতি একরকম বিশ্বস্ত থাকে। উদাহরণ আরও দিতে পারি যেগুলি আমাদের সাহিত্যে আছে কিন্তু সেগুলি নিয়ে আপনাদের কোন বিরাগ নেই।

তসলিমার প্রতি বিরাগ কেন? কারণ তসলিমার এইসব প্রেম বা কামের বর্ণনায় নারীটি সক্রিয় থাকে, নারীটি তৃপ্তি পেতে চায়, নারীটি কামের অংশীদার হতে চায়। কারণ তসলিমা নাসরিনের আত্মজীবনীমূলক বা অন্যান্য যে কোন লেখায়ই যখনই কামের প্রসঙ্গটি আসে, সেখানে নারীটি কেবল পুরুষের খাওয়ার জিনিস না, কেবল পুরুষকে করতে দেয় না- সে করতে চায়। এইখানেই আমাদের পুরুষদের আপত্তি, এইখানেই আমাদের পুরুষদের দাসী যেসব নারী আছেন তাদের আপত্তি। এটা কেবল যে আজকের বা গত তিরিশ চল্লিশ বা পঞ্চাশ বছরের প্রবণতা, তা কিন্তু নয়- হাজার বছর ধরেই পুরুষ নারীকে দেখতে চায় পুরুষের পরিতৃপ্তির খোরাক হিসাবে। সেখানে নারী যদি নিজেই পরিতৃপ্তি চায়, সেটাকে বিবেচনা করা হয় অশ্লীল বেয়াদবি বা বেত্তমিজ বেলেহাজ আকাঙ্ক্ষা হিসাবে।

(৩)
অনেক বছর আগে ইন্ডিয়ার ফুলন দেবীকে নিয়ে একটা সিনেমা হয়েছিল ব্যান্ডিট কুইন নামে। ফুলন দেবীকে তো জানেন, নির্যাতিতা এক নিচু জাতের নারী দস্যুতে পরিণত হয় এবং দীর্ঘদিন ধরে চম্বল অরণ্যের আশেপাশের এলাকাগুলিতে একচ্ছত্র আধিপত্য বিস্তার করে রাখে। পরে সরকারের সাথে আপোষ করে আত্মসমর্পণ করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে এসে তিনি রাজনীতিতেও যোগ দিয়েছিলেন। সম্ভবত সমাজবাদী পার্টির টিকেটে এমপিও হয়েছিলেন তিনি। সেই সিনেমাতে একটা কামের দৃশ্য আছে যেখানে ফুলন দেবীকে দেখানো হয় তিনি একজন পুরুষকে একরকম ধর্ষণই করছেন। সেই নিয়ে সেবছর সেইরকম তোলপাড়!

তখন ইন্টারনেট এইসব ছিল না, আমি যতটুকু যা কিছু দেখেছি টেলিভিশনে বা ম্যাগাজিন খবরের কাগজে। সেই দৃশ্য নিয়ে লোকের আপত্তির মূল কারণ ছিল যৌনতায় নারীকে কেন এইরকম আগ্রাসী ভূমিকায় দেখানো হবে? এটা নাকি স্বাভাবিক নয়, এটা নাকি অশ্লীল ইত্যাদি।
এই একই সিনেমায় কিন্তু ঐ উঁচু জাতের একজন সমাজপতি ঠাকুর বা এরকম একজন ফুলনকে ধর্ষণ করে সেই দৃশ্য আছে। এই ধর্ষণের বদলা নেওয়া ফুলনের দস্যুতায় যাওয়ার মূল কারণ। সেই দৃশ্য নিয়ে কিন্তু কারো কোন আপত্তি নেই? সেটা অশ্লীল নয়। কেন? কারণ, পুরুষ তো ধর্ষণ করতেই পারে, যৌনতার সক্রিয় অংশটি তো পুরুষই, কিন্তু নারী তো নিষ্ক্রিয় থাকবে। নারী কেন সক্রিয় হবে বা আগ্রাসী হবে ইত্যাদি।

এইটাই কিন্তু আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের অন্তর্নিহিত বিধান। নারীর কামনা থাকতে নেই, নারীর পরিতৃপ্তি জরুরী নয়। যৌনতায় নারীকে বিবেচনা করা হয় নিষ্ক্রিয় সঙ্গী হিসাবে, যে কিনা ততটুকুই সক্রিয় হবে যতটুকু তার মালিকের অর্থাৎ কিনা পুরুষটির আনন্দের জন্যে বা উত্তেজনার জন্যে জরুরি। পুরুষটির প্রশমন হয়ে গেলে সেটাকেই বিবেচনা করা হয় একটি সফল সঙ্গম হিসাবে- নারীর এখানে পাওয়ার কিছু নাই, তিনি দিবেন। আর বিবাহিত সম্পর্কের ক্ষেত্রে নারীটি এইরকম দিতে বাধ্য, তার মালিক যখন যেভাবে চাইবে। আর যতদিন তার বিবাহ না হচ্ছে ততদিন সে কাউকে দিবে না, সে তার সতীত্ব রক্ষা করবে। মানে পুরো ব্যাপারটা হচ্ছে ঐখানে, নারীকে পুরুষ ভোগ করবে, নারীর আবার ভোগ কি?

সুতরাং তসলিমা নাসরিন যখন প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে বলেন যে, না, এই শারীরিক ক্রিয়াটা আমিও উপভোগ করতে চাই, আমি পরিতৃপ্তি চাই। তখন আমাদের পুরুষতান্ত্রিক সমাজের ভুরু কুঁচকে ওঠে। বলে কী এই মাতারি! যখন তিনি একজন অক্ষম পুরুষের কথা বলেন, আপনাদের সামনে সমাজ তখন তাঁকে বেয়াদব বেত্তমিজ বলে গালি দিতে থাকে। আর যখন তিনি একজন নারীর তৃপ্তির কথা বর্ণনা করেন, একজন প্রেমিক পুরুষ নারীটিকে আনন্দের শিখরে পৌঁছে দিচ্ছে সেই বর্ণনা করেন, তখন আপনারা ‘ছেনাল ছেনাল’ বলে চিৎকার করে ওঠেন।

(৪)
এই যে আপাতদৃষ্টিতে যাদেরকে লিবারেল ইত্যাদি মনে হয় ওদের যে তসলিমা বিদ্বেষ, এটা কী? এটা নিতান্তই পুরুষতান্ত্রিক অহম। পুরুষতান্ত্রিক অহমে আঘাত লাগে বলেই আপনারা তসলিমার অধিকার সংক্রান্ত অন্যান্য কথার অনেকগুলির সাথে একমত হলেই এইখানে এসে, অর্থাৎ নারীর শরীর, নারীর যৌনতা, নারীর শরীরের মালিকানা, নারীর পরিতৃপ্তির অধিকারের কথা যেখানে আসে, সেখানে তাঁকে গালাগালি করতে থাকেন। আর ঐ যে অশ্লীলতা ফশ্লিলতা বলে যেসব যুক্তি দেখান সেগুলি এতোই খোঁড়া যে এগুলি দেখে খোঁড়া যুক্তিরাও শরম পায়।

তসলিমা নাসরিন আপনাদের এইসব ইয়ের যে খুব একটা পরোয়া করেন না সে তো জাহিরি কথা আরকি।

আজ ওঁর জন্মদিন, আমরা তাঁকে জন্মদিনের শুভেচ্ছা জানাই, দীর্ঘদিন বেঁচে থাকুন আপনি। আপনার ঐ ‘সস্তা’ জনপ্রিয়তা জারি থাকুক। ঐসব বেয়াদবি বেত্তমিজি লেখা জারি থাকুক। সক্রিয় থাকুন, সুস্থ থাকুন। লিখতে থাকুন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.