অশ্রু ও ঘামে ভেজা রোমের গল্প (পর্ব- চার)

লুতফুন নাহার লতা:

ট্রেনে তো উঠে বসেছি। বুক ধড়ফড়ানি এবার একটু বন্ধ হয়েছে। চারিদিকে চেয়ে দেখতে ভালো লাগছে। এমন সুন্দর ট্রেন! চমৎকার বসার সিট, পরিস্কার ঝকঝকে। যাত্রীরা ভদ্র, আবার অনেকগুলো সিট খালিই পড়ে আছে। এরই মধ্যে সিটের সামনের দিকে নিচে আউটলেট পেয়ে ফোনটাও চার্জে দিয়ে দিয়েছি।

বসেছি খালি একটা সারিতে। ঠিক মুখোমুখি দুই সারি ওই পাশে বসেছেন ইতালিয়ান এক ভদ্রলোক। চোখাচোখি হতেই সে মিষ্টি করে হাসে, একবার, দুবার, আমিও হাসি। এই সৌজন্যতার খাতিরে হাসি আর কী! তারপরে আর তাকাই-ই না।

ট্রেনের দুলুনিতে ঘুমিয়েই পড়েছিলাম। হঠাত দেখি কোনো এক স্টেশন থেকে লোকজন উঠে ভরে গেছে সবগুলো সারি। টিকেটসহ আমার সিটের প্যাসেঞ্জারও হাজির। বাংলাদেশে বাস বা ট্রেনের কথা মনে পড়ে গেল। তাড়াতাড়ি উঠে ‘সরি”সরি’ বলে দাঁড়িয়ে গেলাম। আসলে তড়িঘড়ি করে আর নিজের টিকেটের দিকেই তাকাইনি। একটু লজ্জাই পেলাম অন্যের সিটে আরামসে বসে ঘুমিয়ে পড়ার মতো কাণ্ড করেছি আমি! উহ, আমার বোকামির আর শেষ নেই।

এবার সেই ভদ্রলোক ডেকে বললেন, তাদের সারিতে একটা সিট খালি আছে, চাইলে সেখানে বসতে পারি। আমার টিকেট চেক করে দেখি ওটা আসলে আমারই টিকেট নাম্বার। তো আর কী করা, আবারো সেই হাসি! হ্যাঁ, সেই হাসি দিয়ে ওখানেই বসলাম। ভদ্রলোক হাত বাড়িয়ে হ্যান্ডশেক করে ব্যাগ-ট্যাগ টেনে আবার ওখানেই আনলেন।

এইবার তিনি হাসি হাসি মুখে গল্প জুড়ে দিলেন। কেন আমার অমন লেট হলো ট্রেন ধরতে, জানতে চাইলে আমি ভালো করে ওনার দিকে চেয়ে দেখি আরে! এই তো সেই লোক, যিনি আমার বাক্স পেট্রাসহ আমায় টেনে তুলেছিলেন! এইবার হাসতে হাসতে ইতালিয়ান ভাষায় কী যেন বললেন! আমি না বুঝতে পেরে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলে বললেন, ‘আমার ধন্যবাদ কই।’ এতোক্ষণে আমি জোরেই হেসে উঠলাম। কী লজ্জার কথা। তুমি আমাকে টেনেটুনে এই জয়রথে না তুললে তো আমার যাওয়াই হতো না আজ! আর আমি কিনা তোমাকে ধন্যবাদ দিতে ভুলে গেলাম! বাকি পথ ওনার সাথে গল্প করে করে চললাম। জানলাম উনি ইতালির একজন কবি! আহা আনন্দে মন ভরে গেল, বললাম, কবিতা শোনাও, ইতালীয় ভাষায় তার কবিতা শোনালে আমিও স্মৃতি থেকে আমার কবিতা ‘ও যমুনা’ পড়ে শোনালাম।

জানালায় বসেছি। কাঁচের ভেতর দিয়ে দেখছি ট্রেনের গতির সাথে পাল্লা দিয়ে ছুটে যাচ্ছে আদিগন্ত খোলা মাঠ সূর্যমুখির হাসিতে হিল্লোল তুলে। ফসলের শেষে মরা হলুদ রঙ বুকে নিয়ে শুয়ে আছে ক্ষেত। কখনো ছুটছে সবুজে ভরা নবীন প্রান্তর, ইলেক্ট্রিক তারের পোলগুলো ছুটছে দ্রুত কোথাও যাবার আছে বলে।
আর আকাশ! ছুটছে নীলাকাশ, অনন্ত অসীম। ট্রেন চলছে, কিন্তু আমি যেন শুনতে পাচ্ছি জুলিয়াস সিজারের ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ, আর দেখছি সন্ধ্যার আকাশ। রোমের রক্ত করবির রঙে রেঙেছে সে আকাশ।

সহযাত্রী ভদ্রলোকের ফোন চেয়ে নিয়ে একবার জাকারিয়াকে কলও করলাম। আমার বেশ আগেই উনি নেমে যাবার সময় পই পই করে বলে গেলেন ঠিক আর কয়টা স্টেশান পরে আমাকে নামতে হবে।

রোমের রেল স্টেশনে নামবো আমি। রোম টারমিনাল। ওদের ভাষায় রোমা তেরমিনি। এই তেরমিনি শব্দটি আমাকে হাসিয়ে ফেললো। আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিল দু’জন মিনি। বাড়ির সামনে একজন, আর কয়েকটা বাড়ির পরেই আর একজন, দুই মিনি হলেও হতো, তা না তের মিনি! আবার তেরোমিনিও নয়। তেরমিনি।৷ মনে মনে ঐ একমিনি, দুইমিনি, ফেরমিনি, তেরমিনি করতে করতেই চললাম।

এই রোম রেল স্টেশানের ইতিহাসের সাথে জড়ানো আছে, ইতালির কুখ্যাত স্বৈরশাসক মুসোলিনির নাম। ১৯২২ সালে যখন মুসোলিনি ৩৯ বছর বয়সে ইতালির প্রধানমন্ত্রী হোন, তখনও তিনি কিন্তু ইতিহাসের এই ভয়ংকর মুসোলিনি হোন নাই। পার্লামেন্টারি সিস্টেম বিলুপ্ত করে আবার যখন সে নিজেকে ডিউক হিসেবে ঘোষণা করে একনায়কতন্ত্রের মুকুট মাথায় পরেন, তখনই তার অধঃপাতের শুরু।

তো সেই শুরুর দিকের মুসোলিনি চেয়েছিলেন সারা ইতালিকে আবার নতুনভাবে সাজাতে। বিশ্বের অন্যান্য দেশের সাথে একে যুক্ত করতে। আসলে বিশ্বকে দেখাতে ইতালির সাথে সাথে তার নিজের উত্থান। বিশাল এই রেল স্টেশন তখন আবার নতুন করে সেজে ওঠে। তৈরি হয় বিখ্যাত পাঁচটি মার্বেল পাথরে তৈরি ইতালির ম্যাপ।
রোমা তেরমিনি এক সুবিশাল স্টেশান। অনেকে মনে করেন মুসোলিনি এদেশের নাগরিকদের অনুভব করাতে চেয়েছিলেন ওরা কত ক্ষুদ্র। বিশালের পায়ের কাছে দিয়ে দাঁড়ালে নিজেকে যাতে ক্ষুদ্র মনে হয়, জনগণকে দিতে চেয়েছিলেন সেই ক্ষুদ্রতার অনুভব।

এইতো! ট্রেন এসে গেছে রোমা তেরমিনিতে। আমি নেমেছি ট্রেন থেকে। এদিক ওদিক তাকাতেই দেখি হাসি মুখে দাঁড়িয়ে আছে চিরবন্ধু জাকারিয়া। সাথে ওর পরির মতো মেয়েটা। এইবার কিন্তু আনন্দে আমার কণ্ঠ বুঁজে আসছে। আমার চোখ শিশিরে ভিজছে।।

চলবে—

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.