লুতফুন নাহার লতা:
মিলান ক্যাথিড্রাল থেকে বেরিয়ে এক ছুটে ট্রেন ধরে এসেছি যেখানে রানা ভাইয়ের গাড়ি রেখে গিয়েছিলাম। গাড়ি নিয়ে এবার শহরের অলিগলি পার হয়ে চমৎকার এক বাঙালী রেস্টুরেন্টে এলাম। সেখানে আমাকে দেখে পড়ে গেল মহা হৈ চৈ। বাঙালি মালিক, স্ত্রীকে ফোনে বললেন, মিস মিলি এসেছেন এখানে আমাদের রেস্টুরেন্টে, তাকে দেখতে হলে এক্ষুণি গাড়ী নিয়ে দোকানে চলে আসতে। তারপর নানান পদের খাবার পরিবেশন করে মহা যত্ন করে খাওয়ালেন। একসাথে ছবি-টবি তুলে ওনাদের কাছ থেকে বিদায় নেয়া হলো।
এবার এলাম মিলানের বিশাল সেন্ট্রাল রেল স্টেশন। এই রেল স্টেশান স্থাপত্যকলার আরো এক বিস্ময়!
রোমে যেতে লাগবে মাত্র তিন ঘন্টা। রানা ভাই স্লট মেশিনে টাকা ঢুকিয়ে টিকেট কেনার কায়দা শিখিয়ে দিলেন। টিকেট নিয়ে ভিতরে ঢোকার মুখে ওনাদেরকে আটকে দেয়া হলো। অথচ আগে নাকি ওনারা ট্রেনের দরজা পর্যন্ত যেতে পারতেন। অসহায় আমরা ওখানেই বিদায় নিতে বাধ্য হলাম। ওরা মায়ামায়া দৃষ্টিতে অসহায় আমার দিকে চেয়ে হাত নেড়ে নেড়ে বিদায় নিল।
আমি চললেম একা।
ভিতরে ঢুকে সত্যিই খুব একা হয়ে গেলাম। বিশাল এলাকা। এতো ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। এতো ট্রেন আসছে! জন অরণ্য আর কাকে বলে! আমি কেমন খেই হারা হয়ে গেলাম। ঘড়ি দেখে বুঝলাম আমার হাতে আরও কিছুটা সময় আছে। একবার ডাইনে একবার বাঁয়ে দৌড়াদৌড়ি করে বহুজনকে জিজ্ঞেস করেও কোন কুলকিনারা করতে পারলাম না।
কী আশ্চর্য কেউ ইংরেজী বলছে না। এমনকি গেটে দাঁড়ানো নিরাপত্তা রক্ষিরাও বলতে পারে না। এতো সুন্দর পোশাক-আশাক পরা স্টাইলিশ মানুষজন, অথচ তারা ইংরেজী জানে না! নাকি জেনেও বলছে না!
একবার জেনেভা’তে হয়েছিল এমনি ঘটনা।
শাশুড়ি মাকে সাথে নিয়ে আমি আর মার্ক যাচ্ছি সুইজারল্যান্ডে। দরজায় উস্টা খেয়ে মা পড়ে গেলেন জেনেভা এয়ারপোর্টে। তাঁকে এম্বুলেন্স এসে হাসপাতালে নিয়ে গেল। এম্বুলেন্সের ভিতরে মায়ের সাথে আমি। মার্ক রেন্ট করা গাড়িতে আমাদের লাগেজ টাগেজ নিয়ে পিছনে পিছনে আসছে। আমি যা কিছু বলি, যা কিছু জানতে চাই, কেউ কিছু বলে না। বার কয়েক নো ইংলিছ বলে নার্সরাও চুপ। সেই রকম আবারো এই বিষম বিপদে পড়ব তা তো ভাবিনি!
আমার ট্রেন যদি আমাকে না নিয়ে চলে গিয়েই থাকে তা হলে কী হবে! আমি কি ফিরে যাবো রানা ভাইয়ের বাসায়? কিন্তু কেমন করে? আমি তো ঠিকানা জানি না! আর তাছাড়া কিছুক্ষণের মধ্যেই রাত্রি নেমে আসবে, আর তখন আমি কোথায় যাবো! আবার কি টিকেট নিতে হবে? এরা তো ইংরেজি বলে না! আমার হাতে ছোট বড় দিয়ে গোটা তিনেক লাগেজ, একবার ডাইনে, একবার বামে টেনে নিতে নিতে ক্লান্ত আমি!
আসার আগে সিদ্ধার্থ কিন্তু বলেছিল,’বেশি কিছু নিও না মা, হালকাভাবে যাও যাতে হাঁটাহাঁটি করতে গিয়ে ক্লান্ত না হও।’ কিন্তু কে শোনে কার কথা! রোমে যাবো, ছবি টবি তোলা হবে, আর আমি ফকিরনির মতো যাবো! মোটেই না, তা হচ্ছে না। নানা রকম সুন্দর সুন্দর জামাকাপড় কিনে গুছিয়ে নিয়েছি অথচ ভুলে গেছি আঙুলে নেইল পলিশ লাগাতে। আমার বন্ধুরা কোথাও গেলে সবার আগে যায় পার্লারে, চুল আর নেইল সেটিং না হলে তো হয় না! এসব ভাবনা আসছে মনে, আবার মুহূর্তে তা উধাও।
মাথাটা কাজ করছে না। দর দর করে ঘামছি আমি, ঠিক বুঝতে পারছি না আমি কোথায় গিয়ে দাঁড়াবো! কোন দিকের প্লাটফর্ম থেকে ট্রেন যাবে রোমে! আমার মাথা এবার সত্যিই বন বন করছে। কোথায় কার কাছে জানতে পারবো! এর মধ্যে একটু পর পর ঘন্টা বেজে উঠছে, আর একটা করে ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে। লোকজন আমার পাশ কাটিয়ে আমাকে ঠেলে ঠুলে চলে যাচ্ছে।
আচ্ছা সত্যি সত্যি আমার ট্রেন চলে যাচ্ছে নাতো! সময় তো হয়ে গেছে মনে হচ্ছে। প্ল্যাটফর্মের অন্য মাথা পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে একজন রেলওয়ে কর্মিকে পেলাম সে স্প্যানিশের মতো খানিকটা কী কী বলে আমাকে আঙুল দিয়ে যেদিক থেকে এসেছি সেদিকটা দেখালো। আমি আবারও দৌড়ে ওদিকে গেলাম। এবার বয়সে তরুণ একটি ছেলেকে দেখে আমার টিকেট দেখিয়ে মরিয়া হয়ে জানতে চাইলাম। টিকেটের দিকে চেয়ে সে বললো, এই তো তোমার ট্রেন ছেড়ে যাচ্ছে!
— বলে কী! বাজনা বাজিয়ে ট্রেন দুলে উঠেছে!
ওই ওই –ট্রেন চলে যাচ্ছে! আরে হেইইই ট্রেন চলে যাচ্ছে! চোখের সামনে সব অন্ধকার হয়ে যাচ্ছে আমার মাথা গুলিয়ে উঠছে, ওহ! আমার হার্ট এটাক হয়ে যাচ্ছে।
চিৎকার করে এক দৌড়ে একশ গজ পার হয়ে গেছি। ট্রেন চলছে, সাথে আমিও। একটা অলৌকিক হাত আমার সুটকেসসহ আমাকে টান দিয়ে এক ঝটকায় তুলে নিলো রথে! তোমা হতে বহুদূরে! মনে হয় অজস্র মৃত্যুরে পার হয়ে আসিলাম!
আমি যাচ্ছি রোমে।
(চলবে)