অশ্রু ও ঘামে ভেজা রোমের গল্প (পর্ব- দুই)

লুতফুন নাহার লতা:

ভোরের আকাশ ভরে গেছে কুসুম কুসুম লালিমায়। সেখানে বেজে চলেছে পূরবী রাগে এক মহাশূন্যের ধ্রুপদ সঙ্গীত। ধীরে, অতি ধীরে জেগে উঠছে ধ্যানমগ্না পৃথিবী। দিন রাত্রীর মিলন শেষে রাত্রী থেকে দিনের বিচ্ছিন্নতার এ এক অসামান্য সময়। রাতের জঠর থেকে জন্ম নিচ্ছে দিনের ভ্রুণ। শুদ্ধ সুন্দর পবিত্র।
আকাশ পথে যেতে যেতে সেই স্বর্গীয় লালের আভায় ফুলের মতো ছড়িয়ে দিয়েছি আমার ভালোলাগার চুম্বন রাশি। পরশে তার সূর্য উঠেছে জেগে। ঝলমল সেই সকালে আমার প্লেন স্পর্শ করেছে মিলানের মাটি। ইতালির মিলান শহর। ওরা যাকে বলে মিলানো।

সারা পৃথিবীর সকল শিল্প সম্ভার এই দেশকে করেছে তিলোত্তমা। ফ্যাশন, আধুনিকতা আর আভিজাত্য এর মাথায় পরিয়েছে মুকুট। ভূমধ্যসাগরের কোলে অভূতপূর্ব এক হীরের দুল হয়ে দুলছে ইতালি।

খৃষ্ট পূর্ব ২২২ এর দিকে রোমান অধিকৃত এই অঞ্চল মেদিওলেনা (Mediolanum০) নামে রোমান সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। এর অনেক পরে খৃষ্টপূর্ব ১৫’র দিকে সম্রাট অগাস্টাস, মিলানকে ত্রান্সপেদেনিয়া (Transpadania), কোমো, বেরগামো,পাভিয়া, এবং লোদি অঞ্চলের রাজধানী করেন।

ইতালির এই বাণিজ্যিক অঞ্চল ও লোম্বার্ডির আশপাশ এলাকাসমূহ তাই অন্যান্য দেশ ও গোত্রের কাছে শত শত বছর ধরে একটি অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক আকাঙ্ক্ষার বিষয় ছিল।

মিলানের ইতিহাসে বারে বারে এসেছে ভিন্ন ভিন্ন গোত্রের শাসন কাল। কেল্টস Celts, রোমান Romans , গথস Goths, লোম্বার্ডস Lombards, স্প্যানিয়ার্ডস Spaniards, এবং অস্ট্রিয়ান্স Austrians এরা সবাই শাসন করেছে এই অঞ্চল। আর বেশীর ভাগ সময়েই এই শহর তার অবস্থানের কারণে ব্যবহৃত হয়েছে মূলধন হিসেবে। আজকের মিলানও সেই একই কারণে বিতর্কহীন ভাবে ইউনাইটেড ইতালির একটি সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক পাওয়ার হাউস হিসেবে পরিগণিত হয়।

দেবতুল্য শিল্পী লিওনার্দো দ্যা ভিঞ্চির জন্ম হয় ১৪৫২ সালে। তিনি ছিলেন ইটালিয়ান রেনেসান্সের এক অকল্পনীয় প্রতিভা। শিল্পের সম্ভারে তিনি গৌরবান্বিত করেছেন সমগ্র ইতালিয় পেনিনসুলা। লিওনার্দো দ্য ভিঞ্চি ছিলেন একাধারে আবিষ্কারক, স্থপতি, ভাস্কর, যন্ত্র শিল্পী, সংগীত শিল্পী, চিত্রকর, গণিতজ্ঞ, লেখক, সাহিত্যিক, উদ্ভিদ ও অস্থি বিদ্যায় মাস্টার, বিজ্ঞানী, ইঞ্জিনিয়ার এবং আরো বহু গুণের অধিকারী। তিনি তৈরি করেন এ শহরের আধুনিকতার নকশা। জল আগমন ও নিষ্কাশন ব্যবস্থা। ডিজাইন করেন এর নাগরিক জীবনের সবকিছু। ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, পার্ক, বাগান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ট্রেন স্টেশন। তিনি এবং তার তৈরি শিল্পীরাই শিল্প সুষমায় ভরে তোলেন এই শহর।

আমাকে নিতে আসবেন রানা ভাই। তিনি এক সময়ে ছিলেন রোমে। বর্তমানে ব্যবসা ও বসবাস দুটিই এই শহরে। রানা ভাই অসাধারণ একজন মানুষ। একজন কমিউনিটি লিডার। দয়ালু, পরোপকারী। টিকেটের বিভ্রাটের কারণে আমার মিলান হয়ে রোমে যাওয়া। একথা জেনে জাকারিয়ার কথায় তিনি এসেছেন আমাকে নিতে।

প্লেন থেকে নেমে একসাথে আসা লোকজনকে আর চিনতে পারা যায় না। সবাই হুড়মুড় করে দৌড়াতে থাকে ইমিগ্রেশনের দিকে। ঝামেলা শেষ করে আমিও নির্ধারিত লাগেজ বেলট থেকে আমার সুটকেস তুলে নিলাম। এবার তো একটা কল করা দরকার। এয়ারপোর্ট থেকে টাকা ভাঙিয়ে নিলাম, সাথে ওয়াইফাই কোড নিলাম ফোন চালু করতে। রানা ভাইকে পাওয়া গেল একটা রিং হতেই। উনি বাইরে আছেন জানালেন। আমার পরনে কালো সিল্ক প্যান্টের সাথে সাদা শার্ট আর গলায় কালো স্কার্ফ। একথা জানাতেই জোরে হেসে উঠলেন তিনি, বললেন ওভাবে চেনাতে হবে না, আমি আপনাকে দেখলেই চিনবো। মিলান এয়ারপোর্ট থেকে বেরিয়ে চমৎকার সুন্দর সেই সকালে চললাম মিলান শহর ভ্রমণে। পথে একটু থেমে ভাবীকে তুলে নেয়া হলো। এবার শুরু হলো ভাবীর আপ্যায়ন। সবার আগে কফি আর সাথে ইতালির বিখ্যাত কেক ও কুকিস। তারপর সারাদিন ঘুরে ঘুরে শহর দেখতে বেরিয়ে গেলাম আমরা।

ড্যুমো ডি মিলানো বা মিলান ক্যাথিড্রালের সামনে গিয়ে অবাক বিস্ময়ে স্তব্ধ হয়ে রইলাম। ১৩৬৫তে এর কাজ শুরু করা হয়েছিল। তের শতক থেকে উনিশ শতক পর্যন্ত প্রায় ছয় শ বছর ধরে কাজ করেছেন বহু শিল্পী। অবশেষে উনিশ শতকেরও শেষ ভাগে ১৯৬৫ তে এসে এর কাজ শেষ হয়েছে।

মিলান ক্যাথিড্রালের দিকে তাকিয়ে আমার মনে হলো আকাশের গায়ে এক অনন্য সাধারণ নক্ষত্রখচিত সোনার পেন্ডান্ট হয়ে দুলছে ড্যুমো ডি মিলানো। কোনো মানুষ যে এর উদ্ভাবক, এর পরিকল্পক ও সৃষ্টিকর্তা হতে পারে তা বিশ্বাস করা কঠিন। বরং স্বর্গ থেকে নেমে আসা কোন মুনি বা ঋষি এর উদ্গাতা। হয়তো কোন এঞ্জেল এসে গড়েছেন এই শৈল্পিক গথিক মাস্টারপিস। যেন সূচের আগায় সুক্ষ্ম সোনার কারুকাজে ভরা চোখ ধাঁধানো এক মহাকাব্য। এক অলৌকিক ইন্দ্রপুরী! কী যে সুন্দর তার শরীর ভরা অলংকরণ! যেন সাত আসমান থেকে নেমে আসা ফেরেশতারা চাঁদের কণা দিয়ে গড়েছেন এই শিল্প। এর সৌন্দর্য প্রকাশের ভাষা নেই আমার। কেবল মন হতে লাগলো কেন আমি আরো আগে আসিনি এখানে!

মিলানে ভোরবেলা পৌঁছে হাতে সময় ছিল মাত্র পাঁচ ছয় ঘন্টা। ফলে ক্যাথিড্রাল চত্ত্বরে আমার হাতে, কাঁধে, মাথায় কবুতর এসে যতই বসুক, তারা ভালোবেসে মুখে মুখ ঘষে জানাক না সম্ভাষণ, কোন লাভ নেই। আমার হাতের তালুতে ওদের চঞ্চু ভরে গম খাওয়ার ছবি তুলেই ছুটেছি ট্রেন ধরতে। যে ট্রেন আমাকে নিয়ে যাবে বৈকুন্ঠের দিকে। আর আমি আমার আলইতালিয়া ট্রেন ধরতে পেরে আনন্দে আটখানা হতে পারবো!

চলবে—-

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.