গণপরিবহনে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি রোধে আপনার সদিচ্ছাই যথেষ্ট

জান্নাতুল মাওয়া:

বাংলাদেশ যে ধর্ষণে পৃথিবীর শীর্ষে আবস্থান করতে যাচ্ছে তা প্রতিনিয়ত আমাদের চারপাশ দেখে দুধ খাওয়া শিশুটিও বুঝে গেছে। কারণ এই দেশে ছয় মাসের শিশু থেকে শুরু করে শত বছরের নারীও ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। মাদ্রাসার ছেলে বাচ্চা শিশুটিও রেহাই পায় না এখানে।

তবে সার্বিক বিষয় নয়, আমি একটু গণপরিবহণে ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি নিয়ে আলোকপাত করতে চাই। ২০১২ সালে গণপরিবহনে একজন প্যারামেডিকেল স্টুডেন্ট ধর্ষণের শিকার হয় ইন্ডিয়াতে, যা সারা ভারতবর্ষকে নতুন করে ভাবিয়ে তোলে নারীর নিরাপত্তা নিয়ে। ঠিক তার এক মাস পরে ২০১৩ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার মানিকগঞ্জে গণপরিবহনে পোশাক শ্রমিকের গণধর্ষণের খবর জানা যায়।
এর আগে এই সকল ঘটনাকে খুব বেশি গুরুত্ব দেওয়া হতো না। তবে এই ঘটনা বাঙালি নারীর জীবনে শেষ নয়, বরং করে নতুন আতঙ্কের শুরু হয়। নারীকে ঘরে বসিয়ে রাখার, দাস বানানো, আর অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করার নতুন এক অস্ত্র।

উন্নয়নের মূল হাতিয়ার যোগাযোগ, আর নারীকে সেখানেই নিজেকে বাঁচাতে গুটিয়ে নিতে হবে? বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকায় ২০১৩ সালে দুটি, ২০১৫ সালে চারটি ২০১৬ সালে তিনটি, ২০১৭ সালে ছয়টি এবং ২০১৮ সালে পাঁচটি, ২০১৯ সালে দুইটি ঘটনা প্রকাশ পেয়েছে। যেগুলো গণপরিবহনে একক ধর্ষণ, গণধর্ষণ, দলবদ্ধ ধর্ষণ। ড্রাইভার, হেলপার, সুপারভাইজার এবং পরিবহনের লোক এর সাথে সরাসরি যুক্ত। যাদের বয়স ২৫ থেকে ৩৬ এবং তদূর্ধ্ব মধ্যবয়সী।

এবার গণপরিবহনের আর একটি রূপ বলি। বিন্দু নারী উন্নয়ন সংগঠন একটি জরিপে দেখাচ্ছে প্রতি ১০০ জন নারীর মাঝে ৯০ জন নারীই গণপরিবহনে যৌন হয়রানির শিকার হোন প্রতিদিন। এদের মধ্যে বেশিরভাগ মাঝ বয়সী থেকে তার বেশি বয়সী পুরুষ এই হয়রানিমূলক কাজের সাথে জড়িত।

যৌন হয়রানিরগুলোর ধরন ইচ্ছাকৃত স্পর্শ করা, চিমটি কাটা, গাঁ ঘেঁষে দাঁড়ানো, আস্তে আস্তে ধাক্কা দেওয়া, স্পর্শকাতর জায়গায় স্পর্শ করা, গায়ের উপর ইচ্ছাকৃত ঘুমিয়ে পড়া, শরীরে লিঙ্গ ছোঁয়ানো, কাঁধে হাত দেওয়া এমনকি লিঙ্গ বের করে দেখানো। ২০১৭ সালে ব্লেড দিয়ে নারীর স্পর্শকাতর জায়গার কপট কাটতে শোনা যায়। মূলত গণপরিবহনে চলাচলকারী নারীরা জীবনে বহুবার যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। প্রতিবাদ করতে গেলে এই সকল পুরুষরা দলবদ্ধভাবে নারীকে উল্টে শাসায় এবং আশপাশের মানুষ নিরব ভূমিকা পালন করে। আবার কেউ বাঁচতে হয়রানিকারক থেকে দূরে সরার চেষ্টা করে।

পুরুষের কাছে গণপরিবহনে যৌন হয়রানি হয় কিনা এই প্রশ্নে বেসরকারি সংস্থাটার আরেকটি জরিপে বলছে, ১০০ জনে ৬০ জন পুরুষ বলেন যে হয়। বাকিরা এটিকে তাচ্ছিলো, অযৌক্তিক, নারীদের প্রতি কটু মন্তব্য, তাদের পোষাক এই সকল বিষয়কে সামনে এনে ধরেন। যা পুরুষতন্ত্রের একটি ঢাল হিসেবে পুরুষ ব্যবহার করে আসছে। এমনকি জরিপকৃত নারীদের হেনস্থা করে। যাতে বোঝা যায় কোন না কোনভাবে এরা এই কাজের সাথে সম্পৃক্ত।

এবার আসি হেলপার আর কন্ডাক্টরের সরাসরি যৌন হয়রানি কথায় গণপরিবহনে উঠতে গেলে হাত ধরে তোলা, হাতের নিজ দিয়ে যতোটা সম্ভব স্পর্শকাতর জায়গা ছোঁয়া, সরাসরি পিঠে হাত দিয়ে চিমটি কাটা এসব প্রতিনিয়ত খুব দৃশ্যমান একটি বিষয়। একজন নারী তার জীবনে বহু বহু বার যৌন হয়রানির শিকার।

২০১৮ সালে দোলনচাঁপা নামে শুধু নারীদের জন্য বাস সার্ভিসটি চালু হয়। যাতে মোট যাত্রী সিট ৩৪টি এবং নগর সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ এটিকে ৩০ টি পর্যন্ত রাখতে চায়। এর বেশি করবে না। যদি এই হিসেব করি তবে প্রতিদিন ১,০২০ জন নারী নিরাপদ চলাচল করতে পারবে। তা এই শহরের মোট কর্মক্ষম নারীদের তুলনায় একেবারে কম। দোলনচাঁপার বর্তমানে একটি বাস চলে,  এক বছরে পূরণ হয়নি সেই ত্রিশের কোটা।

এতো সংখ্যক নারী বাসে ওঠার পরও নারী সিটের সংখ্যা আনুপাতিক হারে কম। নারী এবং প্রতিবন্ধী মিলে নয়টি সিট আবার কোন কোন বাসে ছয়টি যেটি ইঞ্জিন কভারের সাথে যেখানে বসা অত্যন্ত কষ্টকর। যদিও অধিকাংশ সময় পুরুষের দখলে থাকে। এক্ষেত্রে বাস চালক বা কন্ডাক্টররা নিরব ভূমিকা পালন করে। এই সবগুলো বললাম শহরের গল্প গ্রাম বা জেলা শহরে এই নারী ও প্রতিবন্ধী সিট অলীক স্বপ্ন। সেখানে যৌন হয়রানি এক ভয়াবহ জাল বিস্তার করে আছে।

২০১৭ সালে গণপরিবহনে নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও বয়স্কদের জন্য সংরক্ষিত আসনে অন্য কোন যাত্রী বসলে এক মাসের কারাদণ্ড ও ৫ হাজার টাকা জরিমানার বিধান থাকলেও আজ অব্দি তার কার্যক্রম দেখা যাইনি সারা দেশের কোথাও। কোন প্রতিরোধ না থাকায় বাসে যৌন হয়রানিকে স্বাভাবিক বলেই মেনে নিতে শুরু করেছে নারীরা।

বিআইএসআরের এক গবেষণা বলছে, ৬০ ভাগ ড্রাইভার যৌনকর্মীর কাছে গমন করে এবং বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন সমিতির গবেষণা মতে ৩০-৩৫ শতাংশ পরিবহন শ্রমিক মাদক সেবন করে। অধিক মুনাফার লোভে অতিরিক্ত যাত্রী তোলা, সিসি টিভি ফুটেজ না থাকা, টিকিট না কাটা, মানুষের নিরব ভূমিকাই এই সমস্যা বয়ে নিয়ে চলেছে বহুদিন ধরে। যে সমাজে মানুষের পুরুষতন্ত্রের বীজ মাথায় প্রতিদিন বহন করে সেখানে এগুলো যেন মামুলি ব্যপার।

আমরা যোগাযোগকে মনে করি আমাদের সব থেকে বড় হাতিয়ার সেখানে যোগাযোগ মানে নারীর জন্য এক ভয়ঙ্কর বাঁধা। তবুও নারীরা থেমে নেই তার চলার পথকে সুন্দর করতে তার যত যুদ্ধ। এই যুদ্ধে আমাদের হতে হবে সহযোদ্ধা। মুখ বন্ধ নয়। প্রতিবাদ প্রতিরোধ। আলোচনায় আনতে হবে এই ইস্যু। যত আলোচিত হবে, ততই ভাঙতে থাকবে পুরুষতন্ত্র।

লেখক: নির্বাহী পরিচালক, বিন্দু

শেয়ার করুন: