সরকারের দায় জনগণের ঘাড়ে নিতে হবে কেন?

দিলশানা পারুল:

আমার এক ভাসুরের ছোট বাচ্চা মারা গেলো ডেঙ্গুতে। ফেইসবুক ভর্তি পরিচিত জনের ডেঙ্গু রোগীর আপডেটে।

গত ৩১শে জুলাই ব্রিটিশ পত্রিকা টেলিগ্রাফ বলছে, ঢাকা শহরে উন্নয়নের জোয়ারের ফলে যে আন্ডার কন্স্ট্রাকশন ফ্লাইওভার বা অন্য যে বড় বড় স্থাপনা আছে তার ফলেই ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ বিস্তার।
উদাহরণ হিসেবে তারা বলছে, সরকারের নতুন মেট্রোরেল প্রকল্পের কথা (The spike in the number of cases this year has been put down to a construction boom in Dhaka, with the building sites that accompany large scale infrastructure projects, such as its new metro rail project, causing water to pool.)

অথচ আমাদের দায়িত্বশীল সরকারি ব্যক্তিবর্গরা ক্রমাগত বলে আসছিলেন, আমাদের ফ্রিজের নিচে পানি জমে সেই পানিতেই এডিস মশার লার্ভা জন্মে। অতএব দায় আমাদের, দোষ আমাদের। প্রতিদিন দুই থেকে পাঁচ হাজার রোগী ভর্তি হচ্ছে হাসপাতালে। ১৭ কোটি লোকের দেশে লাখখানেক লোক মরে গেলে কীইবা আসে যায়!
আপনার, আমার আপন লোক মরলে যে মন্ত্রী, এমপি, মেয়র এদের কারও কিছু যায় আসে না, তা তাদের নড়াচড়া দেখেই তো বুঝতে পারছেন! পিএইচডি করা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য রাস্তায় ময়লা ফেলে সেই ময়লা পরিষ্কারের নাটক করছে। মন্ত্রী, সাংবাদিক, নায়িকা, মডেল কেউ বাদ নাই ঝাড়ু নিয়ে ফটোসেশনে।

দিলশানা পারুল

এইসব রঙ-তামাশা দেখে আপনার কি মনে হয় যে দে ডু একচুয়ালি কেয়ার এবাউট ম্যাংগো পিপল? থোরাই কেয়ার করে তারা আমার আপনার।

আপনার কি মনে হয় তারিন, অঞ্জনা এরা মন্ত্রীর সাথে ঝাড়ু নিয়ে নেমেছে কেন? পরের নির্বাচনে এলাকা থেকে নমিনেশন চাইবে, নয় সংরক্ষিত নারী আসনে নমিনেশন চাইবে। ওই জন্য কাজের নামে পোজ দিচ্ছে। এই দেশে মানুষের জন্য কাজ করা মানে ঝাড়ু নিয়ে নাটক করা।

বরিশালের ডাক্তার মনীষা আর তারিনকে একসাথে ইলেকশনে দাঁড় করায়ে দেন। কে জিতবে? নায়িকা তারিনরে আপনারাই ভোট দিয়ে জেতাবেন।

মানুষের এই দুর্দিনেও দেখেন খারাপ মানুষগুলো ঠিকই তাদের ব্যবসা করে নিচ্ছে। ১৫০ টাকার একেকটা কিট বিক্রি হচ্ছে ৫০০ টাকায়, কোথাও কোথাও তারও বেশি দামে। মানবিক সমাজ হলে বরং কী হতো? ১৫০ টাকার কিট বলতো ৫০ টাকায় বিক্রি করো। মানুষ মরছে রে ভাই। মানুষ হয়ে পাশে দাঁড়া।

৩১ শে জুলাই প্রথম আলো বলছে, আইসিডিডিআরবি গত বছর ২২ মে সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তর এবং দুই সিটি করপোরেশনের কর্মকর্তাদের সাথে মিটিং করে জানিয়েছিলো চিকুনগুনিয়া আর ডেঙ্গু জেনোম মিলে নতুন ধরনের ডেঙ্গুর আক্রমণ হতে পারে। এবং নতুন ধরনের ডেঙ্গু সাধারণ মশা মারার কীটনাশকে মরবে না। আইসিডিডিআরবিকে সেই আমলারা বললেন, নির্বাচনের মাসে এই সকল কথা বলা যাবে না। কথা যেন এই দেয়ালের বাইরে না যায়।

এই জায়গায় একটু যোগ করতে চাই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক দল যখন বাজারের প্যাকেটজাত দুধ গবেষণার ফলাফল জনগণকে জানালেন যে দুধে ডিটারজেন্ট এবং এন্টিবায়োটিক পাওয়া গেছে, জনসচেতনতার স্বার্থে তখন সরকারের সংশ্লিষ্ট সকল মহল থেকে প্রশ্ন করা হয়েছিলো, কেন সরকারের কাছে আগে না জানিয়ে প্রেস ব্রিফিং করা হলো? এবং সমস্ত আলোচনা এইটাকে কেন্দ্র করেই ঘুরতে লাগলো যেন দুধে এন্টিবায়োটিক থাকাটা সমস্যা না, সমস্যা জনগণকে জানানো।

এখন আইসিডিডিআরবি তো তাদের ডেঙ্গু গবেষণার ফলাফল সবার আগে সরকারকে জানিয়েছিল। তাহলে? সরকার গত এক বছরে কী পদক্ষেপ নিয়েছে? বরং সমস্ত তথ্য গোপন করতে বাধ্য করেছে।

বর্ষা মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রকোপ দেখা দিবে এইটা সরকারের সব মহলের জানা। কোন জায়গা থেকে মিনিমাম কোন প্রস্তুতি দেখেছেন কেউ?

জানুয়ারি মাসে যখন পত্রিকা রিপোর্ট করছে, ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা ৩৭, মে মাস আসতে আসতে সেটা হয়ে গেলো ১৮৪, সিমটম দেখে কি বোঝা যায় না এইটা আউটব্রেকের দিকে যাচ্ছে? কোথাও কোন নড়াচড়া ছিলো? জুন মাসে রোগীর সংখ্যা ১৮০০ থেকে এক মাসের মধ্যে সেইটা ১৫০০০ এ পৌঁছেছে।

জানুয়ারি থেকে যদি সতর্ক হওয়া হতো, প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি নেয়া শুরু করা হতো, আজকে ডেঙ্গু এ অবস্থায় আসতো কিনা? কিছু বললেই সব জনগণের ঘাড়ে দায়িত্ব দিয়ে দেয়া হয়। কেন? জনগণ কি ট্যাক্স পে করে না? মেয়র, মন্ত্রী, আমলারা কি বেতন নেন না? তাহলে দায় কার? আপনার দায়িত্ব আমি কেন ঘাড়ে নেবো?

আমার কাজটুকু তো আমি ঠিকই করছি। মাথার ঘাম পায়ে ফেলে কামাই করছি, সেই কামাই থেকে ট্যাক্স দিচ্ছি, আপনার বেতন নিশ্চিত করছি। তাহলে আপনার দায়িত্বটুকুও কেন আমার ঘাড়ে নিতে হবে? যদি নিতেই হয়, তাহলে মেয়র, স্বাস্থ্য মন্ত্রী এই সব পদপদবীর দরকার কী?

এইটুকু একটা দেশ ভূমিকম্পের মতো সারাক্ষণ ঘটনা ঘটছে। মিন্নী তার পরিবারের কাছে বর্ণনা করেছে তাকে রিমান্ডে কী ভয়াবহ অত্যাচার করা হয়েছে। তাকে নয়ন বন্ডের মতো মেরে ফেলার হুমকি দেয়া হয়েছিলো। পত্রিকাতেই বলছে, তার যে কাটপিস ভিডিও সাংবাদিকদের কাছে সরবারহ করা হয়েছিলো, সেইটাও পুলিশেরই বানানো।

খুলনায় ওসির নেতৃত্বে থানায় নিয়ে এক গৃহবধুকে পাঁচ পুলিশ সদস্য মিলে ধর্ষণ করেছে, তারপর তার হাতে ইয়াবা ধরিয়ে দিয়ে তার বিরুদ্ধে মামলা করেছে।

…কোনটা নিয়ে কথা বলবো, বলেন তো? ডেঙ্গু? ধর্ষণ? মিন্নী? নায়িকাদের ঝাড়ু নাটক? নাকি সিইসির বক্তৃতা করার নামে কোটি টাকা মেরে দেয়া?

আমি মানুষ একজন, আমার কী-বোর্ডও একটা। শুধু বলি, কোন সমস্যাই বিচ্ছিন্ন ঘটনা না। সব সমস্যার গোড়া একটা। বাঁচতে চাইলে সমূলে সেই গোড়া উৎপাটন করেন।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.