‘হিডেন চার্জে’ ভরপুর দাম্পত্যে সন্তান নেয়ার ভাবনা বড় ধরনের অপরাধ

কামরুন নাহার রুমা:

আমার যে বন্ধু কোনোদিন আমার খবর নেয় না, সে একদিন ক্লাস চলাকালীন ফোন দিয়ে জানতে চাইলো, আমার বাচ্চা হবে কীনা! কারণ সে কোনো একটা ছবিতে দেখেছে আমার পেট উঁচু। আর সেটা সে খুব রসিয়ে রসিয়ে বলছিলো!

তার বলার ধরন আর হাসিতে উৎকট যৌনতার গন্ধ ছিলো। আমি তো মোটা তাই আমার পেটও স্বাভাবিক নিয়মেই একটু বড়। এখন সেটা দেখে কারো যদি মনে হয় আমি মা হতে চলেছি, তাহলে সেটা তার ব্যক্তিগত ব্যাপার। আমার বন্ধু বিয়ের পর এমনিতে আমার কোনো খোঁজ নেয়নি।

লেখক: কামরুন নাহার রুমা

ত্রিশ এর পর যে নারী বিয়ে করে জীবন সম্পর্কে কমবেশি (খুব ব্যতিক্রম ছাড়া) ধারণা তার থাকে। সে জানে তাকে কী করতে হবে, কীভাবে চলতে হবে, কার সাথে কেমন আচরণ করতে হবে, জীবনযাপন পদ্ধতির সীমারেখাটা কতদূর পর্যন্ত নির্ধারণ করতে হবে। সে জানে কখন তার ডানা দুটো কেটে সমাজের হাতে তুলে দিতে হবে (যদিও দিতে সে বাধ্য না); কতোটুকু তাকে ত্যাগ করতে হবে; অনেকের বেসিক নিড ফিলাপ করতে গিয়ে তার নিজের সব সাধ আহ্লাদ বিসর্জন দিতে হবে সেটাও সে জানে (তাকে দিতে হয়; ছেলেটাও দেয় হাসিমুখে)।

সে জানে সামাজিক পরিস্থিতির, বিশেষ করে আর্থ সামাজিক পরিস্থিতির উপর নির্ভর করে তাকে জীবনের অনুষঙ্গ গ্রহণ ও বর্জন বা ম্যাক্সিমাইজ ও মিনিমাইজ করতে হয়। আর জীবনের বড় ইস্যুগুলোতে অনেক ভেবে তাকে সিদ্ধান্ত নিতে হয়। মেয়েটা অন্য অনেক বিষয়ের মতো এটাও জানে কখন তাকে সন্তান নিতে হবে। একটা সন্তান নেয়ার শারীরিক বয়স (বিশেষজ্ঞদের মতে) সম্পর্কে সে জানে, কিন্তু সে যদি সচেতন হয় তাহলে শুধু শারীরিক বয়সের উপর নির্ভর করেই সে সন্তান নেয় না। কারণ সে জানে একটা প্রাণকে পৃথিবীতে আনার আগে তাকে গর্ভধারণ থেকে শুরু করে সন্তান জন্মদান এবং একটা নির্দ্দিষ্ট বয়স পর্যন্ত বড় করার জন্য ন্যূনতম আর্থিক সংগতি ও ব্যবস্থা থাকতে হয়। সেটা না করে একটা প্রাণ পৃথিবীতে আনা ক্রাইমের পর্যায়ে পড়ে (আমার মতে)।

আমি বিয়ে করেছি পঁয়ত্রিশে। আমার যে সন্তান নেয়ার তথাকথিত সময় হয়েছে বা চলে যাচ্ছে সেটা আপনারা আমার চারপাশের সবাই জানেন, আর আমি জানি না, সেটা আপনাদের কে বললো? আমি কি লেখাপড়া কিছুটা জানি না? আমার কি বোধ-বুদ্ধি কিছু নাই? আমাকে কী আপনাদের নির্বোধ মনে হয়, না মূর্খ মনে হয়! ‘বয়স তো হলো এবার একটা বাচ্চা নিয়ে নাও’ – এই কথাটা যতোটা ভালোবেসে মানুষ বলে, তার চেয়ে টিপ্পনি কেটে বেশি বলে। নারীরা এক ধরনের নারীসুলভ সুখ পায় আর পুরুষেরা এক ধরনের বিকৃত যৌন সুখ পায়। আমি আপনাদেরকে আমার খুশির সংবাদ আপনাদের ইচ্ছেমতো শোনাতে পারছি না বলে খুব দুঃখিত।

বিয়ে হওয়া মানেই বছর ঘুরে গর্ভবতী হয়ে যেতে হবে, এতো সস্তা আর অপরিণামদর্শী ভাবনা থেকে দূরে থাকা ভালো। আমার কথা শুনে মনে মনে বলছেন, “বেটি বুড়ি হইসে চটাস চটাস কথা যায় না; দেখ গিয়ে বাচ্চা-কাচ্চা হয় না বলেই এমন পাকনামি করতেসে; লাজ লজ্জাহীন বুড়ি বেটি”। আপনাদের যার যা খুশি আমায় বলতে পারেন, ভাবতে পারেন আমি কিছুই মনে করবো না। ভাবনার স্বাধীনতা আপনার ব্যক্তিগত আর মৌলিক অধিকারের মতো।

অনেকের মনে হতে পারে পঁয়ত্রিশে আপনি বিয়ে করেছেন, নিশ্চয়ই সব গুছিয়েই বিয়ে করেছেন, তাহলে আর আর্থিক যোগ্যতার অভাব কোথায়?

একটা কথা বলি, শোনেন।

মোবাইল কোম্পানিগুলোর হিডেন চার্জের মতো জীবন নামক ভ্রমণে অনেক ধরনের হিডেন চার্জ আছে, যেটা খালি চোখে কেউ দেখতে পায় না। যারা সেই চার্জ পে করে তারাই জানে সেই চার্জের ধরন ও পরিমাণ। বিয়ের পর জীবন নামক ভ্রমণে বহুমাত্রিক হিডেন চার্জ যুক্ত হয়, যেটা পে করতে করতে নিজেদের অনেক মৌলিক চাহিদা পূরণের ইচ্ছেটাও ত্যাগ করতে হয় অনেককে। সেটাও খালি চোখে দেখা যায় না; অন্যেরা দেখবে না। যারা ত্যাগ করে, যারা পে করে শুধু তারা জানে। আমাদের চারপাশে এমন অনেক আছেন; আমিও তাদের মধ্যে একজন।

শেয়ার করুন: