সঙ্গীতা ইয়াসমিন:
নোবেলের জাতীয় সঙ্গীত নিয়ে বক্তব্য শুনলাম। কী বলবো ভাষা খুঁজে পাচ্ছি না।ওকেই বা আর কী বলি!
আমাদের সমাজ এখন এমনই দ্বিধাবিভক্ত যে, কোনো সত্যবচন, সত্যকথন, কোনোকিছুই সহজভাবে গ্রহণ করার, যৌক্তিকভাবে গ্রহণ করা, কিংবা সমালোচনা করার মতোন পরিস্থিতি নেই আর। আমরা ধর্মের আফিমে বুঁদ হয়ে এমনই বিকারগ্রস্ত আচরণ করছি যার ফলাফল হিসেবে চিন্তা-চেতনায়, কথায়-কাজে, কর্মে প্রতিনিয়ত নিজেদেরকে প্রমাণ করেই চলছি যে আদতেই আমরা কী!
জাতীয় সঙ্গীত যেটা আছে তার বিকল্প আরও কী কী হতে পারে এমন আলোচনা এই নতুন নয়। কেনো সেই আলোচনা? প্রথম ও প্রধান কারণ হলো যিনি লিখেছেন তিনি রবীন্দ্রনাথ! আর রবীন্দ্রনাথ হলেন হিন্দু!(?) এই সাম্প্রদায়িক বিষোদগার, বিষক্রিয়া কেবল যে অসচেতন জনতার মধ্যে, নিচুমনের মানুষের মধ্যেই বসবাস করে, সেকথা ভুল! গেলো তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে এই ধারণা সমাজের সুশীল জনতার মধ্যেও আরও বেশি প্রকট হয়ে বাসা বেঁধেছে।
আমাদের সমাজের মুখোশধারী, পরিস্কার পোশাক পরা, সততার আড়ালে ভণ্ডামির আদলে যাদের দেখি তাঁদের অনেকেই এই ধারণা পোষণ করেন। একসময় সেসব প্রগতির মোড়কে সস্তা জনপ্রিয়তায় চাপা পড়েছিল, এখন সেসব প্রকাশ্যেও হয়, হচ্ছে। অন্তত আমার এই ক্ষুদ্র জগতের পরিসরেই তাঁদের অনেকের সাথে দেখা মিলেছে।
অনেক বিষয়ে আলোচনা হতেই পারে, ধর্ম নিয়ে নৈব নৈব চ! ধর্মের নামে সব ভণ্ডামিও চলতে পারে, প্রশ্ন করা নৈব নৈব চ! এই চিত্র সকল প্রকার মৌলবাদ এবং সাম্প্রদায়িক চেতনায় গরীয়ানদের জন্য একইরকম! কোনো ভিন্নতা নেই।
সাম্প্রদায়িক আচরণ, কর্মকাণ্ডের বিরোধিতা করায় আমি অনেকের রোষানলে পড়েছি। অনেকের কটু কথা শুনি এখনও। কেউ কেউ প্রশ্ন করেন, ভারতে জয় শ্রীরাম বলে মানুষ হত্যা করছে, সে বিষয়ে তো কিছু বলো না? তাঁদের উদ্দেশ্যে বলতে চাই-
প্রথমতঃ সারা পৃথিবীতে যেখানেই অন্যায়ভাবে মানুষ হত্যা হয়, ধর্মের নামে মানুষের রক্ত ঝরে, আমি তা মনে প্রাণে ঘৃণা করি। আমি তার প্রতিবাদ করি। ভারতে যা হচ্ছে তাও আমি ঘৃণা করি।
দ্বিতীয়তঃ বাংলাদেশ আমার দেশ। আমি আমার নিজের ত্রুটি সর্বাগ্রেই দেখি এবং দেখা উচিত। আমি যদি সতেরো কোটির একজন হই, যেকোনো প্রকারের জুলুমবাজীর বিরুদ্ধে আমি দাঁড়াবোই। আমি প্রশ্ন করবোই। সে কেবল ধর্মীয় কারণেই নয়, গণতন্ত্র, আইনের শাসন, এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের মতো ঘটনায়ও।
তৃতীয়তঃ নিজে অন্যায় করে অন্যের অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমি আঙুল তুলতে পারি না। নিজের ঘর আগে সাফ করতে হবে বলেই আমি বিশ্বাস করি।
আর সর্বোপরি আমি বিশ্বাস করি, অধিকার হচ্ছে তাই, যতক্ষণ আমার বাক স্বাধীনতা অন্যের কোনো প্রকার স্বাধীনতায় বিঘ্ন ঘটাবে না ততক্ষণই আমার কথা বলা সাজে, উচ্চকণ্ঠে!
পরিশেষে, সুধীজনদের উদ্দেশ্যে বলি, এই সাম্প্রদায়িক ক্ষুদ্র চিন্তা দিয়ে নিজের ভালো হয়তো করা যায়, সন্তান সন্ততিরও ভালো হয়তো হয়, দিনশেষে সেই ভালোর কোনো আলো বৃহৎ পরিসরে দেশের, মানুষের কোনো কাজে আসে না। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় দেশটাকে এগিয়ে নিতে গেলে, সকলে মিলে একসাথে কাজ না করলে সকল মন্দের বিরুদ্ধে একাত্ম হতে না পারলে সত্যিই আমাদের মুক্তি নেই।
ছোট্ট একটা দেশ, অনেক মানুষ, অনেক সমস্যা আমাদের। এর মধ্যে এতো দলাদলি, এতো হানাহানি! ভারতে ‘জয় শ্রীরাম’ বললে আমাদের এখানেও একইরকম কিছু করতে হবে, এই শিক্ষা কি ইসলাম দেয়? যদি না-ই দেয়, তবে আমরা ভারতের কাজকে নিন্দা জানাই, ঘৃণা করি! এ জাতীয় সকল অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের একাত্ম হতে হবে বলেই আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
‘৭১ আমাদের একটা সীমারেখায় আটকে একটা সার্বভৌমত্ব দিয়েছিল বটে। ‘৭১ আমাদের একটা চেতনায় সেদিন একাত্মও করেছিল! সেদিন অসাম্প্রদায়িকতাই ছিল আমাদের বড় শক্তি! আমাদের যেতে হবে অনেক দূর। আমাদের মুক্তি সুদূর পরাহত। আবারও একটা যুদ্ধ চাই, যুদ্ধ চাই।