মঞ্জুলী কাজী: ‘তের’ সংখ্যাটা আমার জীবনের একটি ক্ষত। খুব ছোটবেলায় জুনের ‘তের’ তারিখে মাকে হারিয়েছি । সেই ক্ষতের চিহ্নটা রয়ে গেছে বুকের ভিতরে। তারপর এলো ২০১১ এর ১৩ই আগস্ট । বুকের ভিতরে বিধাতা পুরুষ কেটে কেটে ‘১৩’ তারিখটা লিখে দিল নিষ্ঠুর হাতে। তার থেকে অবিরাম রক্তক্ষরণ চলছে।
দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে যেমন জার্মান কনসেনট্রেশন ক্যাম্পে বন্দীদের হাতে-বুকে নাম্বার দিয়ে দেয়া হতো, বিধাতা তেমনি আমার বুকের ভিতরে ১৩ নাম্বার দিয়ে দিয়েছে। শুধু তাই নয়, যে বাসায় থাকি তার নাম্বারও ১১ -১৩ ।
মাঝে মাঝে বুকের ভিতরে রক্তক্ষরণ এতো হয় যে, চিৎকার করে বলতে চাই – হা ঈশ্বর, তুমি পৃথিবী থেকে ১৩ নাম্বারটা তুলে দাও । কিন্তু কষ্ট এতোটাই যে কণ্ঠ দিয়ে শব্দ বের হয় না । একটা সুতীব্র কষ্টের দলা যেন কণ্ঠকে রোধ করে রেখেছে । সেই তীব্র বেদনা যখন সইতে পারি না তখন বেরিয়ে যাই বাসা থেকে। প্রচণ্ড শীতে তুষারের মাঝে, কিংবা প্রচণ্ড গরমে তাপের মাঝে একলা একলা হাঁটতে থাকি। অনেকক্ষণ উদ্দেশ্যবিহীন হেঁটে তারপর ক্লান্ত শরীরে ফিরে আসি ১১-১৩ তে।
আমার সাথে যে মানুষটা থাকে, সে শুধু নিঃশব্দে তাকিয়ে দেখে মায়ের কষ্ট। কোন কথা বলে না। ফিরে এসে গুটিসুটি হয়ে শুয়ে থাকি তখন একটা কম্বল গায়ের ওপর দিয়ে চুপ করে মাটিতে বসে একমনে ল্যাপটপ নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যায়। বাসায় দুটি প্রাণী, কিন্তু কোন কথা নেই। একটা পিন পড়লেও অনেক শব্দ হবে এমন নীরবতা। আমাকে সান্ত্বনাও দেয় না, আবার রাগও করে না। আমরা দুজন ১১-১৩ বাসায় ১৩ তারিখের ক্ষত দুইভাবে বয়ে চলেছি।
গতবছর ১২ই আগস্টে সকাল থেকে বৃষ্টি। খুব সকালে এই বৃষ্টির মাঝে চলে গিয়েছিলাম বনানী গোরস্থানে । কেউ নেই চারপাশে – একা একা গিয়ে খুব কাঁদলাম। বৃষ্টির জলে, চোখের জলে একাকার হয়ে গিয়েছিলো। কোন শব্দ নেই, শুধুই বৃষ্টির শব্দ । কাঁদতে কাঁদতে বারবার কান পেতে আছি, এই বুঝি বলে উঠবে, “কাঁদছিস কেন বেবি” ? ছিঃ কাঁদতে নেই “। না, কোনও শব্দ নেই ।
অনেকক্ষণ কেঁদে ক্লান্ত হয়ে আস্তে আস্তে বাসায় চলে এলাম । যখন ফিরে আসছি , তখন অনেকে যাচ্ছে। পরদিন ১৩ তারিখ, আমার বুকের ভিতরে কেটে কেটে “১৩” অংকের জন্ম। আবার খুব সকালে গিয়েছি বনানী গোরস্থানে। দেখি গতকাল যারা এসেছিলো ফুলে ফুলে ভরে দিয়েছে তাদের শ্রদ্ধা। সেই ফুলের দিকে তাকিয়ে অনেক কথা বললাম । গত এক বছরে কি কি করেছি, কার কার কাছে কি কি কাগজ দিয়েছি , কাকে কাকে কি দিতে হয়েছে, ইত্যাদি অনেক কথা । অনেক সাংসারিক কথা, যা আগে বলিনি কখনও। একা একা এতো সাংসারিক কর্মকাণ্ড তো করিনি আগে। ছিল তো বন্ধু, তার সাথে আবোল-তাবোল কথা, গান শোনা, খুনসুটি করে চলে গিয়েছে ২৬টা বছর কখন টেরই পাইনি । ছেলেটা যে কখন বড় হয়ে গিয়েছে, তাও বুঝিনি । যখন সাংসারিক সব কথা বলছিলাম মনে হলো হাসছে, আর বলছে, ‘বেবি তুই এতো গুছানো হলি কবে থেকে রে ?’ সেদিন কিন্তু কাঁদিনি । শুধু কথা বলে গেছি । আর চুপ করে আমার সব কথা শুনে গেছে। এইবার কি করবো? আমি আর সুহৃদ কি কোথাও চলে যাবো? না, কোথাও যাবো না। ১১-১৩ বাসায় মিশুকের সাথে কথা বলবো, দুজন দুভাবে। আমাদের মাঝেই তো আছে।
নয়নসমুখে তুমি নাই ,
নয়নের মাঝখানে নিয়েছ যে ঠাঁই– আজি তাই
শ্যামলে শ্যামলে তুমি, নীলিমায় নীল ।
আমার নিখিল, তোমাতে পেয়েছে তার অন্তরের মিল।