বেল হুকস (অনুবাদ: মুহাম্মদ গোলাম সারওয়ার):
(তাঁর প্রকৃত নাম ছিলো Gloria Jean Watkins, কিন্তু বেল হুকস নামের আড়ালে প্রকৃত নামটি প্রায় হারিয়েই গেছে। হ্যাঁ, তিনি বেল হুকস নামে লিখতেন, কিন্তু আজ সারা দুনিয়ার নারীবাদী ও নারীবাদের সমর্থকেরা তাঁকে তাঁর লেখক নাম বা “পেন নেইম” দিয়েই জানেন।
নারীবাদী তত্ত্বে দারুণ সব অসাধারণ ধারণার অবতারণা করা বেল হুকস জন্মেছিলেন ১৯৫২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের ২৫ তারিখে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমের নারীবাদী লেখালেখি ও আন্দোলনে যখন শ্বেতাঙ্গ নারীবাদীদের প্রবল প্রতাপ, তখন তিনি সেই বলয়কে চ্যালেঞ্জ করেন, প্রশ্ন ছুঁড়ে দেন, “কালো নারীরা কি নারী নয়?”
দারুণ সাবলীলভাবে উপস্থাপন করেছেন নারীবাদী তত্ত্বের নানান দিক, নিজে উপস্থাপন করেছেন কিছু মৌলিক চিন্তা, বিশেষত “ব্ল্যাক ফেমিনিজম” এর ভাবনায় তিনিই ছিলেন প্রধান চিন্তক। এই লেখাটি তাঁর “Feminism is for EVERYBODY: Passionate Politics” বইয়ের ভূমিকা।
তিনি দাবি করেছেন, একটি দারুণ সহজ বইয়ের অপেক্ষা করেছিলেন তিনি, যে বইটি খুব সহজ করে নারীবাদ বোঝাবে মানুষকে, অথচ সরলীকরণে আক্রান্ত হবে না, এই বইটিকে তিনি উল্লেখ করেছেন, বিশ বছর অপেক্ষার পরে পাওয়া সেই প্রয়োজনীয় বই হিসাবে।
তিনি আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন নারীবাদীরা এক সময় এই রকমের সহজ করে লেখা হাজার হাজার বই লিখবেন, যা মানুষকে নারীবাদের কাছে আসার আহবান করবে, মানুষ নারীবাদের সাথে যুক্ত হবার আহবান করবে। এই প্রবন্ধটির অনুবাদ দারুণভাবেই মূলানুগ, তাই এর বক্তব্য বিষয়ে কোনো ব্যাখ্যা দেবার দায় অনুবাদকের নয়, তবে অনুবাদ প্রসঙ্গে যেকোনো পরামর্শ, সমালোচনা সাদরে গৃহীত হবে।)
আমি যেখানেই যাই না কেনো আমি খুব গর্বের সাথেই বলি আমার কাজ সম্পর্কে, আমি কী করি তা নিয়ে, আমি বলি আমি একজন লেখক, আমি একজন নারীবাদী তাত্ত্বিক এবং সাংস্কৃতিক সমালোচক। আমি সবাইকে বলি, আমি চলচ্চিত্র নিয়ে লিখি, আমি জনপ্রিয় সাংস্কৃতিক প্রসঙ্গগুলো নিয়ে লিখি এবং এই মাধ্যমগুলোতে যে বক্তব্যগুলো প্রচারিত হয়, সেসব বিশ্লেষণ করি।
বেশিরভাগ মানুষই এই বিষয়গুলোর প্রতি আগ্রহবোধ করেন এবং আরও বেশি করে জানতে চান। আমাদের সকলেই ছবি দেখতে যান, টেলিভিশন দেখে থাকেন, পত্রিকা ও ম্যাগাজিনগুলোতে প্রায় সকলেই চোখা বোলান এবং এই মাধ্যমগুলোতে যে সকল বার্তা, প্রতিবেদন বা বক্তব্যগুলো প্রচারিত হয়ে থাকে, সেসব নিয়ে প্রত্যেক মানুষেরই নিজের একটা বক্তব্য থাকে, যেসব ছবি দেখেন, এই মাধ্যমগুলোতে তা নিয়ে তাদের একটা বক্তব্য থাকে। ফলে এটা মানুষের পক্ষে বোঝা খুব সহজ একজন সাংস্কৃতিক সমালোচক হিসাবে আমি কী করি, অনেকেই বোঝেন লেখালেখি নিয়ে আমার আবেগকে (অনেকেই নিজেরাই লিখতে চান এবং লেখেনও)।
কিন্তু নারীবাদী তত্ত্ব? এখানেই সবাই কেমন যেন থেমে যান, সবার প্রশ্নগুলো যেন থেমে যায়। বরং তার বদলে আমি শুনতে পাই নারীবাদের সব “বদমাইশী”র কথা এবং শুনি বাজে নারীবাদীদের কথা, কীভাবে “তাঁরা” পুরুষদের ঘৃণা করেন, কীভাবে “তাঁরা” প্রকৃতি ও ঈশ্বরের ইচ্ছার বিরুদ্ধে যেতে চান, কীভাবে “তাঁরা” প্রায় সকলেই সমকামিতায় আক্রান্ত আর কীভাবে তাঁরা সব শ্বেতাঙ্গ পুরুষদের চাকুরিগুলো নিয়ে যাচ্ছে একের পর এক আর তাদের জন্যে দুনিয়াকে করে তুলছে কঠিন থেকে কঠিনতর, যাঁদের সাফল্যের কোনো সুযোগই নেই এখন আর।
যখন এই একই মানুষগুলোকে আমি তাদের ফেমিনিজম বা নারীবাদ প্রসঙ্গে পড়াশুনা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করি, যখন আমি জিজ্ঞাসা করি সাম্প্রতিক সময়ে নারীবাদ নিয়ে কী বইপত্র বা ম্যাগাজিন পড়েছেন, কিংবা কী কী বক্তৃতা বা আলোচনা শুনেছেন, তখন তাদের বেশিরভাগই আমাকে উত্তর দিয়েছেন যে, নারীবাদ নিয়ে তাদের সকল জানাশোনাই আসলে তৃতীয় কারও মাধ্যমে। তাঁরা আসলে খুব কাছ থেকে নারীবাদকে জানার চেষ্টা করেননি কিংবা সুযোগ পাননি।
যাঁরা কোনো নারীবাদী আন্দোলন বা সংগ্রাম কিংবা ইস্যুর সাথে খুব কাছ থেকে সংশ্লিষ্ট হবার সুযোগ পাননি, তাঁরা সত্যিই জানেন না বাস্তব জীবনের নারীবাদী সংগ্রামের কথা, কী ঘটে এইসব সংগ্রামে, সেসব কথা। এঁদের বেশিরভাগেরই ধারণা, ফেমিনিজম বা নারীবাদ আসলে কিছু বদরাগী নারীদের কাজকর্ম, যারা আসলে পুরুষের “মতো” হতে চান।
এই মানুষেরা এমনকি এটাও ভাবতে চান না যে ফেমিনিজম বা নারীবাদ আসলে অধিকার সংক্রান্ত, নারীর সমান অধিকার অর্জন সংক্রান্ত। তাই আমি যখন নারীবাদ নিয়ে কথা বলি, আমি আসলে খুব কাছ থেকে শুনি, খুব ব্যক্তিগত পর্যায়ে শুনি, তাঁরাও খুব স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে আমার কথা শোনেন এবং আমাদের আলোচনা শেষ হলে তাঁরা খুব চটপটে উত্তর দেন যে – আমি কেমন যেন আলাদা রকমের, আমি ঠিক “আসল” নারীবাদীদের মতো নই, আসল নারীবাদীরা খুব বদরাগী কিসিমের, সারাক্ষণ পুরুষদের ঘৃণা করে।
আমি তাদেরকে আশ্বস্ত করি, আমি তাদেরকে বলি, আমি একজন “আসল” নারীবাদী, একজন আমূল নারীবাদী হিসাবে যতটা “আসল” হওয়া যায়, আমি ঠিক তেমনটাই, বরং আমি বলি, তাঁরা যদি সাহস করে নারীবাদীদের সাথে সংযুক্ত হোন, তাহলে বুঝতে পারবেন, নারীবাদ সম্পর্কে তাঁরা যা ভাবেন, নারীবাদ আদৌ তা নয়।
প্রতিবার আমি যখন এরকম কারো মুখোমুখি হই, আমি আমার হাতে একটা নারীবাদী বই রাখতে চাই, যেন আমি তাঁদেরকে বলতে পারি, এই বইটা ধরুন, পড়ে দেখুন, আপনি খুব সহজেই বুঝতে পারবেন নারীবাদ কী! আপনি বুঝতে পারবেন নারীবাদের সংগ্রামটা আসল কী নিয়ে!
আমি আসলে একটা খুব সহজ বই আমার কাছে রাখতে চাই, খুব ছোটো, সংক্ষিপ্ত এবং খুব সহজে বুঝতে পারা যায়, এমন একটা বই। কোনো মোটা – ঢাউস বই রাখতে চাই না, হাজারটা জটিল শব্দ আর বিদ্যায়তনিক ভাষায় লেখা কোনো বই নয়, বরং দারুণ সোজাসাপ্টা, পরিচ্ছন্নভাবে উপস্থাপন করা, পড়তে সোজা, কিন্তু অতিসরলিকরণে আক্রান্ত নয়, এমন একটা বই।
যেদিন থেকে নারীবাদী চিন্তা, নারীবাদী রাজনীতি আর অনুশীলন আমার জীবনকে পাল্টে দিয়েছিলো, সেদিন থেকেই আমি এই বইটিকে খুঁজে ফিরছি, আমি এই বইটিকে পেতে চেয়েছি। আমি যে মানুষগুলো দারুণ ভালোবাসি, তাঁদেরকে এই বইটি দিতে চেয়েছি, যেন তাঁরা আমাদের সংগ্রামের কারণটিকে ভালো করে বুঝতে পারেন, এই যে নারীবাদী রাজনীতিকে আমি এতো গভীরভাবে ধারণ করি, যা প্রকৃত অর্থে আমার রাজনৈতিক জীবনের প্রধান ভিত্তিও বটে।
আমি আসলে চেয়েছি, তাঁরা অন্তত এই প্রশ্নটির উত্তর খুঁজে পাক যে – “নারীবাদ কী?” এটা কোনো ভীতিকর কিছু যেমন নয়, তেমনি এটা কোনো কল্পনা বিলাস বা ফ্যান্টাসিও নয়।
আমি চেয়েছি যে তাঁরা নারীবাদের এই সহজ সংজ্ঞাটি বারবার পড়ুন ও বার বার জানুন যে, “নারীবাদ হচ্ছে পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদী শোষণের অবসান ঘটানোর সংগ্রাম, সকল রকমের পিতৃতান্ত্রিক শোষণ ও নিপীড়ন থেকে মুক্তির সংগ্রাম”।
নারীবাদের এই সংজ্ঞাটিকে আমি ভালোবাসি, প্রায় দশ বছর আগে আমার লেখা “Feminist Theory: From Margin to Center” বইটিতে আমি নারীবাদের সংজ্ঞা হিসাবে এই প্রস্তাবনাটি হাজির করেছিলাম। আমি এই সংজ্ঞাটি ভালোবাসি, কারণ এই সংজ্ঞাটি খুব পরিষ্কারভাবেই বলে যে আমাদের সংগ্রাম আসলে “পুরুষ-বিরোধী” কোনো প্রসঙ্গ নয়। এই সংজ্ঞাটি খুব স্পষ্টভাবেই বলছে যে সমস্যাটি আসলে পিতৃতান্ত্রিকতা বা পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদ।
এই সংজ্ঞাটির স্পষ্টতা আমাদের মনে করিয়ে দেয় যে আমরা সকলেই, কী নারী কী পুরুষ, আমাদের জন্ম থেকেই সামাজিকভাবে বড় হয়ে উঠেছি এই পিতৃতান্ত্রিক লিঙ্গবৈষম্যবাদী ধারণা আর অনুশীলনগুলোকে গ্রহণ করতে। ফলে কোনো নারীও বহু পুরুষের মতোই পিতৃতান্ত্রিক ও লিঙ্গবৈষম্যবাদী হতে পারে। যদিও কোনো নারীর পিতৃতান্ত্রিক ও লিঙ্গবৈষম্যবাদী হয়ে ওঠাটা কখনই পুরুষ আধিপত্যকে জায়েজ করে না, আবার এটা ভাবাটাও নারীবাদী চিন্তকদের জন্যে ভুল ও অতিসরলীকরণ হবে যে সংগ্রামটি কেবল পুরুষের বিরুদ্ধে নারীর সংগ্রাম।
এটা আমাদের সবারই খুব স্পষ্ট করে জানা দরকার যে পিতৃতান্ত্রিকতার (লিঙ্গবৈষম্যবাদের আরেকটি প্রাতিষ্ঠানিক নাম) এই স্থায়ী হয়ে গেঁড়ে বসার ক্ষেত্রে আমাদের সকলেরই অংশগ্রহণ রয়েছে, আমরাও পিতৃতান্ত্রিকতার অংশ হয়ে থাকবো যতক্ষণ না আমরা আমাদের হৃদয় আর মস্তিস্ককে আমূল বদলাতে না পারবো, যতক্ষণ না আমাদের পিতৃতান্ত্রিক চিন্তা অনুশীলনকে নারীবাদী ভাবনা ও অনুশীলন দিয়ে প্রতিস্থাপিত করতে না পারছি।
জনগোষ্ঠী হিসাবে পুরুষ পিতৃতান্ত্রিকতার সুবিধাগুলো পেয়ে থাকে, এই সুবিধাগুলো নেয়ার ক্ষেত্রে তাঁরা বিশ্বাস করতে থাকে যে পুরুষ নারীর চাইতে শ্রেষ্ঠতর এবং পুরুষের আমাদেরকে (নারীদের) শাসন করা উচিৎ। কিন্তু এই সকল সুবিধাদির একটা চড়া মূল্য আছে। পিতৃতান্ত্রিকতার এই সকল সুবিধাদি গ্রহণ করার জন্যে হলেও পুরুষকে নারীর উপরে আধিপত্য জারি রাখতে হয়, নারীকে শোষণ ও নিপীড়ন করতে হয়, কখনও কখনও শারীরিক আক্রমণ ও নিপীড়ন করতে হয়, বিশেষত তারা যদি এই পিতৃতান্ত্রিক শাসন-শোষণ অক্ষত রাখতে চায়।
বেশিরভাগ পুরুষই নারীর প্রতি পুরুষের ঘৃণা ও ভীতি নিয়ে বিব্রত, নারীর প্রতি পুরুষের আগ্রাসী ভূমিকা নিয়ে বিব্রত, এমনকি যে সকল পুরুষ এই ধরনের আগ্রাসী পিতৃতান্ত্রিকতাকে বাঁচিয়ে রাখে তারাও। কিন্তু তাঁরা পিতৃতান্ত্রিকতার এই সুবিধাটুকু ত্যাগ করতে চায় না, ভয় পায়। তাঁরা নিশ্চিত নয় তাদের চিরচেনা এই পৃথিবীটার কী অবস্থা দাঁড়াবে যদি এই সকল পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থা বদলে যায়! তাদের কাছে এর চাইতে বরং সহজ এই পুরুষাধিপত্যকে টিকিয়ে রাখা, এমনকি এই ব্যবস্থাটি যে সঠিক নয়, এই ব্যবস্থাটি যে শোষণমূলক, এটা মনে-প্রাণে বিশ্বাস করার পরেও তাঁরা পরোক্ষভাবে হলেও একে সমর্থন করে যায়।
বহু পুরুষ আমাকে বারবার জিজ্ঞাসা করেছেন, আসলে কাঙ্খিত ব্যবস্থাটি কী যা এই সকল নারীবাদীরা চায়? আমি এই পুরুষদের বিশ্বাস করি। আমি তাদের নিজেদের বদলে যাওয়ার ও পালটে দেয়ার ক্ষমতায় বিশ্বাস করি। এবং আমি জানি, এরা যদি সত্যিই নারীবাদ সম্পর্কে আরও ভালো করে জানেন, তাহলে নারীবাদ সম্পর্কে এঁদের ভীতি কেটে যাবে, বরং নারীবাদের মধ্যেই এরা তাঁদের নিজেদের মুক্তির দিশা খুঁজে পাবেন, পিতৃতান্ত্রিকতার সাথে যে দাসত্বের নিগড়ে তাঁরা বাধা, সেই শৃঙ্খল থেকে মুক্তির দিশা খুঁজে পাবেন।
এই বইটি হচ্ছে এই সকল পুরুষের জন্যে, কী তরুণ কী বৃদ্ধ, এই বইটি আমাদের সবার জন্যে, এই ছোট্ট সহজ বইটি লেখার জন্যে আমি প্রায় বিশ বছর অপেক্ষা করেছি। আমাকে আসলে এই বইটি লিখতেই হতো, কেননা আমি অপেক্ষায় বসে ছিলাম এই বইটির জন্যে, কিন্তু কেন জানি না এই বইটি ঠিক আসছিল না। কিন্তু এমন একটা বই ব্যতীত এই বিরাট জনগোষ্ঠীকে বোঝানো প্রায় অসম্ভব ছিলো, যাঁদের প্রতিটি দিন কাটে নারীবাদবিরোধী হাজার হাজার কেচ্ছা-কাহিনী আর প্রতিক্রিয়া শুনে শুনে, যে আন্দোলন ও সংগ্রামটিকে তাঁরা জানেন না, বোঝেন না, অথচ প্রতিদিনই তাঁদেরকে বলা হয় এর বিরোধিতা করার জন্যে, একে প্রতিরোধ করার জন্যে, পণ্ড করে দেয়ার জন্যে।
আসলে নারীবাদের উপরে লেখা এই রকমের প্রাথমিক পাঠ্য আরও অনেক অনেক বই থাকা উচিৎ, ছোট ছোট পুস্তিকা ধরনের প্রকাশনা, যে সকল প্রকাশনা আমাদেরকে সহজ করে জানাবে নারীবাদ সম্পর্কে। এই বইটি ঠিক এই রকমেরই একটি বই, নারীবাদী রাজনীতির স্বপক্ষের আরেকটি নিবেদিতপ্রাণ প্রচেষ্টা আরেকটি আবেগী কণ্ঠ।
হয়তো এমন দিন আসবে যে হাজার হাজার বিলবোর্ড থাকবে, পত্রিকাগুলোতে বিজ্ঞাপন বেরুবে, বাস-ট্রামের গায়ে বিজ্ঞাপন ঝুলবে, ট্রেইন বা সাবওয়ের ভেতরে ঝুলবে নানান ধরনের পোস্টার, টেলিভিশনে বিজ্ঞাপনের মধ্য দিয়ে এই শব্দগুলোকে ছড়িয়ে দেয়া হবে, যে শব্দগুলো সারা দুনিয়াকে জানিয়ে দেবে নারীবাদ কী, নারীবাদের অর্থ কী!
কিন্তু আমরা এখনও সেই অবস্থায় যাইনি, আমরা এখনও বহু দূরে সেই বাস্তবতা থেকে। আমরা সেই বাস্তবতা থেকে অনেক দূরে হলেও এটাই হচ্ছে আমাদের করণীয়, সমাজের সকলের মনে-প্রাণে নারীবাদী সংগ্রামকে পৌঁছে দেয়া। নারীবাদী পরিবর্তন ইতিমধ্যেই আমাদের জীবনকে স্পর্শ করেছে দারুণ সদর্থকভাবে, অথচ এর পরেও আমরা আমাদের এই সদর্থক ভাবনাকে হারিয়ে ফেলি যখন সারাদিন নারীবাদ নিয়ে শুনতে হয় নানান রকমের গঞ্জনামূলক প্রচারণা।
আমি যখন প্রথম পুরুষাধিপত্যকে রুখে দিতে শুরু করেছিলাম, সব ধরনের পিতৃতান্ত্রিক চিন্তার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে শুরু করেছিলাম (এবং যখন আমাদের পরিবারের সবচাইতে কঠিন পিতৃতান্ত্রিক মানুষটি – আমার মা’র বিরোধিতা করতে শুরু করেছিলাম) তখনও আমি নিতান্তই কিশোরী, টিন-এজার, দারুণভাবে বিষন্ন, আত্মহত্যা-প্রবণ আর জীবনের মানে খুঁজে পেতে মরিয়া, পৃথিবীতে নিজের স্থান খুঁজে পেতে দারুণভাবে অনিশ্চিত।
আমার নিজের দাঁড়াবার একটা ভিত্তিভূমি খুঁজে পাবার জন্যেই নারীবাদের দরকার ছিলো আমার, নিজের বেঁচে থাকার, নিজের অস্তিত্বের ন্যায্যতা খুঁজে পাওয়ার জন্যে। আমাদের মা’ও যোগ দিয়েছিলেন আমাদের সাথে। তিনি দেখেছেন তাঁর সবকটি কন্যাকে (আমরা মোটের উপরে ছয়জন) নারীবাদী রাজনীতির কল্যাণে ভালো থাকতে দেখেছেন। তিনি নারীবাদী সংগ্রামের মাঝে প্রতিশ্রুতি আর আশাবাদ দেখেছেন। সেই প্রতিশ্রুতি আর আশাবাদই আমি আপনাদের সাথে ভাগ করে নিতে চাই এই বইটিতে, আপনাদের সবার সাথে।
ভেবে দেখুন যে বিশ্বে আমরা বাস করছি, সেখানে একে অপরের উপরে কোনো আধিপত্য নেই, যেখানে নারী পুরুষ হয়তো এক নয়, এমনকি হয়তো সকল ক্ষেত্রেই সমানও নয়, কিন্তু সমতা হচ্ছে আমাদের মূল ভাবসত্ত্বা, যা আমাদের সকল সামাজিক মিথস্ক্রিয়াকে আকৃতি দান করবে। ভেবে দেখুন একটা বিশ্বে আমরা বাস করছি যেখানে আমরা যা হতে চাই সেভাবেই হতে পারবো, আর আমাদের বসবাসের দুনিয়াটা হবে শান্তি আর সম্ভাবনার।
নারীবাদী বিপ্লব একাই সেই দুনিয়াটা গড়তে পারবে না, আমাদের আরও অবসান ঘটাতে হবে বর্ণবাদের, শ্রেণি আভিজাত্যবাদের আর সাম্রাজ্যবাদের। কিন্তু এটা আমাদেরকে পরিপূর্ণতা দিতে পারে, আমাদেরকে ভালোবাসার একটা সমাজ গড়ার অবস্থা তৈরি করতে পারে, সে সমাজে একসাথে থাকা, একসাথে আমাদের স্বপ্ন, স্বাধীনতা আর ন্যায্যতার আকাঙ্ক্ষাকে বাস্তবায়িত করার এবং এই সত্য নিয়ে বেঁচে থাকার যে নারী-পুরুষ আমরা সকলেই “সমান হিসেবে সৃষ্ট”।
তাই কাছে আসুন। দেখুন নারীবাদ কীভাবে আপনার – আমার আমাদের সকলের জীবনকে ছুঁয়ে দেয়, বদলে দেয়। কাছে আসুন, সংলগ্ন হোন, সম্পৃক্ত হোন, নিজের অভিজ্ঞতা দিয়ে জানুন নারীবাদী সংগ্রামকে।
কাছে আসুন, দেখবেন – নারীবাদ আসলে সকলের।