তামান্না ইসলাম:
কিছু কিছু জায়গায় মানুষ বড় বেশি দুর্বল। মানুষের সবচেয়ে বড় দুর্বলতার জায়গা হলো পরিবার, বাবা, মা, ভাই, বোন, স্বামী, সন্তান। এছাড়া প্রেমিক, প্রেমিকা এবং কাছের বন্ধু। এরা কোনো অপকর্ম করলে, ভুল করলে, ব্যর্থ হলে সেটা কারো সাথে সহজে শেয়ার করা যায় না। এমনকি এরা কষ্ট দিলে, দূরে ঠেলে দিলেও কাউকে সহজে বলা যায় না।
এই সম্পর্কগুলো আমাদের সুখকে ডিফাইন করে, বা অন্যভাবে বলা যায় এরা কেউ আমাদেরকে কষ্ট দিচ্ছে মানে সাধারণভাবে বলা যায় যে আমরা ভালো নেই। আর আমি ভালো নেই এই কথাটা কারো কাছে স্বীকার করা ভীষণ কঠিন একটা কাজ।
ঠিক এই কারণের জন্য কিছু কঠিনতম সময়ে মানুষ অন্যের সাহায্য নিতে পারে না, অন্য কেউ চাইলেও সাহায্য করতে পারে না, এমনকি কিছু আঁচ করলেও পারে না। অথচ সেই সময়টাতেই মানুষের বন্ধুর এবং সুবিবেচক এবং সৎ পরামর্শদাতার প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি হয়।

মানুষের সহানুভূতি, মোরাল সাপোর্ট একজন ভেঙ্গে পড়া বিপন্ন মানুষকে মানসিকভাবে অনেক শক্তি দিতে পারে।
আজ এমনি একটা ঘটনা নিয়ে একটু আলাপ করি। স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়াঝাঁটি, অশান্তি খুব সাধারণ একটা ব্যাপার। কাছের বন্ধুদের সাথে এগুলো নিয়ে আলাপ করা যায়, আমরা জানি এগুলো সবার জীবনেই আছে। হয়, আবার মিটেও যায়। অনেকসময় বন্ধুদের সাথে এগুলো নিয়ে কথা বলে নিজে হালকা হওয়া যায়, অন্যের মতামত জানা যায়, বা বলতে বলতে নিজেরই চোখে নিজের ভুলটা ধরা পড়ে।
তবে, অনেকে এই ব্যাপারে একমত হবে না। আমি এমন বলতে শুনেছি যে নিজেদের ঝামেলা নিজেদের মিটমাট করাই ভালো, এটা আসলে নির্ভর করছে কার সাথে কথা বলছি তার উপরে।
কিন্তু যখন ঝামেলাটা সাধারণ ঝামেলার চেয়ে বড় হয়ে যায়? কারো স্বামী কাউকে খুব বেশি সন্দেহ করে, গায়ে হাত তোলে, অন্য মেয়ের সাথে জড়িয়ে গেছে, এসব বিষয়গুলো কাউকেই সহজে বলা যায় না। আমি কিছু কিছু ঘটনা দেখেছি একদম কাছে থেকে। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতো দম্পতিগুলো বেশ সুখী। কিন্তু অতি শিক্ষিত স্বামী একসময় স্ত্রীকে সন্দেহ করা শুরু করলো। অতিরিক্ত অধিকার বোধ বা স্বামিত্ব খাটাতে শুরু করলো। ততদিনে সংসারে একটি সন্তানও এসে গেছে। শিক্ষিত স্ত্রী স্বাধীনচেতা, সে এসব মানবে কেন? এই টানাপোড়েনে চললো অনেকদিন। স্বামীকে ডোমেস্টিক ভায়োলেন্সের অপরাধে শ্রীঘরও ঘুরে আসতে হলো।
এতোকিছু যখন ঘটছে, এদের দুজনের একজনও কিন্তু কারো কাছে শুরু থেকে সহজ হতে পারছে না। বাবা, মা, ভাই, বোনকে বললে আরেক সমস্যা। মেয়েদের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে জোরাজুরি করা হয় যেমন করেই হোক, মানিয়ে নিয়ে থেকে যাও, বাচ্চা হলে তার মুখের দিকে তাকিয়ে অবশ্যই। ছেলেদের ক্ষেত্রে আবার মেয়ের ছোট দোষটাকে বড় করে দেখা হয় এবং আরও উস্কানি দেওয়া হয়। এই সময়ে মানুষ আবেগের বশে অনেক সময় অনেক ভুল সিদ্ধান্তও নেয়, তাই এমন কারও পাশে থাকা দরকার দুজনেরই যে আবেগটাকে পাশে রেখে বাস্তবটাকে দেখতে পারবে, তবে আত্মসম্মানের বিনিময়ে নয়।
আরও কিছু ঘটনা দেখেছি, যেখানে স্বামী পরকীয়ায় জড়িয়ে গেছে। বাচ্চাদের কথা ভেবে মেয়েরা সেগুলো মাফ করে দিচ্ছে। কিছুদিন পরে আবার একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি ঘটছে। দিনের পর দিন অমানসিক অশান্তি। চব্বিশ ঘণ্টা ফোন চেক করো, মেইল চেক করো। স্বামী রাত জেগে অন্য নারীর সাথে কথা বলছে, তাকিয়ে তাকিয়ে দেখো। অফিস ট্যুরের নামে দেখা করতে চলে যাচ্ছে। এতো অশান্তির পরও অনেক মেয়ে দীর্ঘদিনের সম্পর্ক থেকে বের হয়ে আসতে পারে না। একটা সাইকেলে পড়ে যায়।
এটা ঠিক সাহসের অভাব নাকি মায়া, আমি জানি না, কিন্তু দেখেছি সিদ্ধান্ত নিতে পারছে না। পারিবারিক চাপ তো আছেই। ছোট বাচ্চা থাকলে, এই বাচ্চাদের বাবার অভাব কে পূর্ণ করবে সেই চিন্তা, একাকিত্বের চিন্তা, অনেকের ক্ষেত্রে আর্থিক নিরাপত্তার চিন্তাও আছেই।
আপনার কোনো কাছের বন্ধু যদি এমন পরস্থিতির মধ্য দিয়ে যায়, আপনি কী করবেন? নিজে থেকে নাক গলানো যাবে না, কিন্তু যদি সে কোনভাবে নিজেই খুলে বলে, তখন? সাহস দেবেন? যদি মনে করেন সে বিনা কারণে অশান্তি পুষছে, তাহলে তাকে সরে আসার সাহস দেয়াটাই ভালো। তবে এক্ষেত্রে নিজের সাহসেরও দরকার।
প্রথমত, আপনি নিজে যদি এর মধ্যে দিয়ে না যেয়ে থাকেন, তাহলে ভয় লাগতেই পারে, আসলেই কি এটা তার জন্য সবচেয়ে ভালো সলিউশন?
দ্বিতীয়ত, যদি আপনার সাহস দেওয়া সত্ত্বেও কোন কারণে আপনার বন্ধুটি ওই নরকেই থাকতে রাজি হয়ে যায়, আপনার বন্ধু হারানোর সম্ভাবনাও কিন্তু উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
তারপরেও ঝুঁকি নিয়ে হলেও যদি পরিস্থিতি এমন হয় যে খুব পরিষ্কারভাবে বোঝা যাচ্ছে এই সম্পর্ক সুস্থভাবে চলবে না, তখন সেই ভেঙ্গে পড়া মেয়েটির পাশে দাঁড়ানো জরুরি বলেই আমি মনে করি। শেষ সিদ্ধান্ত অবশ্যই তার নিজের উপরে নির্ভর করে।