সুমিত রায়:
পরিচিত বড় এক ভাই এর সাথে নারীবাদে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য ও বোরকা-হিজাব নিয়ে এক জায়গায় কথা হচ্ছিল (শেষে এ প্রসঙ্গের গণতন্ত্রের প্রয়োজনীয়তা নিয়েও কথা হয়)।
সেখানে নারীবাদ সম্পর্কে বলতে গিয়ে বলা হয়, “পুরুষ যা করতে পারে তা করা নয়, বরং নিজে যা করতে চায় তা চাওয়া” হলো নারীবাদ। আমার কাছে এরকম অবস্থানের নারীবাদকে বেশি ইন্ডিভিজুয়ালিস্ট বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য বলেই মনে হয়েছে।
যতদূর জানি সবাই এর সাথে একমত হবেন না, এমনকি অনেক নারীবাদীই হবেন না। এক্ষেত্রে উদাহরণ হিসেবে “হিজাব ইজ মাই চয়েজ” টাইপের বিবৃতিগুলো নিয়ে সমস্যা তৈরি হয়ই। সেই আলোচনায় আমার বক্তব্য কী ছিল সেটাই এখানে তুলে ধরলাম।

* ড্রাগ নেয়া, সুইসাইড করা সব ব্যক্তিস্বাধীনতাই। রাষ্ট্র মানুষের মঙ্গলের কথা ভেবে মানুষের স্বাধীনতাকে সীমাবদ্ধ করে এসবের বিরুদ্ধে যায়।
* মানুষ স্বেচ্ছায় যা করবে সবই চয়েজ। ইন্ডিভিজুয়ালিজম বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য এমনই। নিজের অমঙ্গল করে করে এমন এমন প্রোডাক্ট বা সারভিস গ্রহণ করা হয় আবার মঙ্গলজনকগুলোও করা যায়। এখানেই ইন্ডিভিজুয়ালিজমের সীমাবদ্ধতা।
* হিজাব নির্যাতনমূলক পোশাক। কিন্তু মেয়েদেরকে ছোটবেলা থেকে বোঝানো হয় যে, “তুমি হচ্ছো মূলত তোমার শরীর, তোমার মনের কোন দাম নেই, জাজমেন্টের মূল্য নেই, কিন্তু তোমার শরীরের অনেক দাম, কোনো পুরুষের অধিকার নেই তোমার শরীরকে দেখে। যারা তোমার শরীরকে দেখবে তাদের মূল্য পরিশোধ করতে হবে, তোমার শরীর যত বেশি ঢাকা থাকবে, তোমার তত বেশি সম্মান হবে।
তোমার শরীর ‘ভোগ’ করার পূর্বে এর জন্য একটা বড় মূল্য আগেভাগে তোমাকে দেয়া হবে…” এরকম সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশনকে নারী মনে-প্রাণে আঁকড়ে ধরে। সে এটাকে তার মঙ্গলের জন্য, নারীত্বের মঙ্গলের জন্য দরকার বলে মনে করে (এটা বেনেভোলেন্ট সেক্সিজমের মধ্যে পড়ে, বেনেভোলেন্ট সেক্সিজম নিয়ে আগেই লিখেছিলাম, কেউ জানতে চাইলে জানানো হবে)।
এর সাথে যুক্ত হয় হিজাবের সাথে তার আইডেন্টিটির সম্পর্ক, যারা হিজাব পরে না তাদের নিয়ে অবমাননামূলক কথা, ঐতিহ্য, ছোটবেলা থেকে অভ্যাস, পাশ্চাত্য সমাজ বিদ্বেষ, পরমতসহিষ্ণুতার অভাবসহ অনেক কিছু। এসব কারণে হিজাব যে শুধু তার চয়েজে পরিণত হয় তা না, তার আইডেন্টিটি ও আইডিওলজির অংশ হয়ে ওঠে। সে এটাকে ডিফেন্ড করার জন্য লড়াই করে। ইন্ডিভিজুয়ালিজম বা ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে, হিজাব সেটা খুব ভালো করে চোখে আঙ্গুলে দেখিয়ে দেয়। তাই একে প্রমাণ হিসেবে দেখা যায় না।
* অতিরিক্ত কিছু কথা এড করি। মানুষের মধ্যে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তৈরি হয়েছে পুঁজিবাদের যুগ আসার পর। এটি শহর সৃষ্টি করে, শ্রমিকময় সমাজ সৃষ্টি করে, মানুষকে প্রোডাক্ট ও সারভিস নির্ভর করে কনজিউমারিজম বৃদ্ধি করে মানুষকে ‘স্বনির্ভর’ (কিন্তু প্রোডাক্ট নির্ভর) ও একাকি করেছে। ফলে মানুষ পরিবার, সমাজের বন্ধনগুলো থেকে বেরিয়ে এসেছে এবং সামন্ততান্ত্রিক যুগের বিভিন্ন শোষণমূলক বৈশিষ্ট্য কমে এসেছে। ধর্ম ও ধর্মের উপর নির্ভরশীলতা হলো সামন্ততান্ত্রিক যুগের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য, সেটা তার ফলে কমে গেছে, বিবাহ, নারীর গৃহে বন্দিত্ব, পতিতাবৃত্তি, মানুষের গ্রুপ নির্ভর চিন্তা (গ্রামের একজন দোষ করলে পুরো গ্রামের বদনাম) এইসবই তাই কমে গেছে।
* কিন্তু পুঁজিবাদের এই যুগে মানুষ ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য অর্জন করলেও এটি মানুষকে অনেক রকম পারিবারিক ঐতিহ্য, ধর্মের প্রভাব, পূর্বসংস্কার থেকে বের করে আনতে সক্ষম নয়। মানুষ এখনও পরিবার নির্ভর (তিন বা দুই সদস্যের একক পরিবার হলেও)। সে ছোট থেকে বড় হওয়ার একটি নির্দিষ্ট সময় বাবা বা মা বা দুজনের কাছেই নির্ভরশীল। এই সময়টাতে তাই তাদের প্রভাব থাকেই। এটা যতদিন থাকবে ততদিন পর্যন্ত যেসব বৈশিষ্ট্য তার বাবা-মা কর্তৃক কম বয়সেই আরোপিত হয় (হিজাবের প্রতি সমর্থনের মতো), সেগুলো টিকে যাবে। যারা সচেতনভাবে সেখান থেকে বেরিয়ে আসবে তারা বাদে অন্যদের ক্ষেত্রে সেটা দূর হবে না। পুঁজিবাদ এসব ক্ষেত্রে মানুষের এই প্রবণতাকেই ব্যবহার করে পুঁজি বৃদ্ধি করবে, ফলে এটি বাজারে বিভিন্ন রকমের ডিজাইনার হিজাব এনে হিজাবের উৎপাদন ও হিজাবের চাহিদার পুনরুৎপাদন করেছে। ফলে মানুষের হিজাব পরিধানের প্রবণতা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে।
* এই পুঁজিবাদী যুগই “আধুনিক যুগ” এর নামান্তর। আধুনিকতা তাই নারীকে হিজাবের মতো সামন্ততান্ত্রিকতা থেকে বের না করে তাকে হিজাবের দিকে ঠেলে দেয়। আধুনিক যুগের বৈশিষ্ট্য ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য তাই এখানে হিজাবের পক্ষে যায়। তাই আমাদেরকে আধুনিকতা, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের ঊর্ধ্বে গিয়ে চিন্তা করা জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে নারীর সেক্সুয়াল অবজেক্টিফিকেশন, সেল্ফ অবজেক্টিফিকেশন, বেনেভোলেন্ট সেক্সিজম – যেগুলোকে পুঁজিবাদী যুগ, আধুনিক যুগ ব্যবহার করে – সেগুলোর বিরুদ্ধে নারীদের সচেতন করা জরুরি। আমার মতে সেটাই নারীবাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ অবস্থান হবে ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যের চেয়ে।
* পুঁজিবাদ এখানে মানুষের ব্যক্তিগত (পূর্বসংস্কারগত ও পক্ষপাতমূলক) চাহিদা, প্রবণতাগুলো ব্যবহার করে। হিজাব, শাঁখা-সিঁদুরের মতো বিষয়ের উৎপাদন ও পুনরুৎপাদন করে। পুঁজিবাদের এই খারাপ দিকগুলো নিয়ন্ত্রণ করার জন্য রাষ্ট্রীয় ভূমিকা শক্তিশালী হওয়া দরকার।
কিন্তু রাষ্ট্র যদি ফ্যাসিস্ট হয়, গণতান্ত্রিকতার অভাব থাকে তবে সেই রাষ্ট্র ন্যায়ের দিকে যায় না, বরং ক্রোনি ক্যাপিটালিজম ও অন্যান্য প্রক্রিয়ায় মাধ্যমে পুঁজিপতির লাভের মধ্য দিয়ে ক্ষমতাশালীদের লাভ করার উপায় তৈরি করে, পপুলিজমের চর্চার মাধ্যমে মুক্তমনের বিকাশকে চর্চা করে, ভিন্নমতকে দাবিয়ে রাখে, ও স্ট্যাটাস ক্যু বা স্থিতাবস্থা বজায় রাখার চেষ্টা করে, যা সর্বদাই পূর্বসংস্কার ও পক্ষপাতমূলক।
তাই সবার আগে দরকার গণতন্ত্রের ও মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকার নিশ্চিত করা। সেটা না হলে নারীর উন্নয়নসহ কিছুই আর সম্ভব না। আমরা প্রচারণার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করার চেষ্টা করতে পারি। সেটাও অবশ্য কম নয়।
তাই আমাদের ভূমিকাকে ছোট করছি না। কিন্তু গণতন্ত্র না থাকলে, মানুষের বাক স্বাধীনতার সাংবিধানিক অধিকার স্বীকৃত না হলে, সেটাতেও বাধা আসে।