সাহাবউদ্দিন মাহমুদ:
মানুষ গুজবে কান না দিয়ে যাবে কোথায়? যেখানে এই পৃথিবীতে ৪ হাজার ৩০০ ধর্ম বিশ্বাস করে মানুষ হাজার হাজার বছর ধরে গুজবের জালে আটকা পড়ে আছে। পৃথিবীর ৭৫ ভাগ মানুষ কোন না কোন প্রথাগত ধর্মের সাথে জড়িত। এমনকি ইউরোপ-আমেরিকা যারা বাংলাদেশ থেকে সভ্যতায় অনেক এগিয়ে, তারাও এই ধর্মবিশ্বাসে আসক্ত। সেই অনুযায়ী বাঙালিরা পদ্মা সেতুতে মাথার খুলি লাগবে, এই কথাটা বিশ্বাস করা তো খুবই সামান্য বিষয়!
আপনি আমি কীভাবে গুজব থেকে বাঁচবো, কীভাবে আমরা গুজব প্রতিরোধ করবো? এই নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা দীর্ঘদিন ধরেই চলে আসছে। তবে কাজের কাজ কিছুই হয়নি।
পৃথিবীর মানুষ দুই ভাগে বিভক্ত!
ধার্মিক-অধার্মিক
শিক্ষিত-অশিক্ষিত
সভ্য-অসভ্য
উন্নত-অনুন্নত
ধনী-গরীব
ভালো-খারাপ
এইভাবে আমরা পৃথিবীর সকল মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করতে পারি। এই পৃথিবীতে সরকারিভাবেও অনেক গুজব পালন করা হয়, যেমন মুসলমানদের ঈদ উল আযহার গরু কোরবানি করা, এবং হিন্দুদের কালী পূজায় পাঁঠা বলি দেওয়া, এগুলোও এক ধরনের গুজব। তবে এই গুজবগুলো সমাজস্বীকৃত। এই পৃথিবীতে আপনি মানুষ হিসেবে যেমন বাঁচার অধিকার আছে, একইভাবে পশুপাখিদেরও বাঁচার অধিকার আছে।
তারপরেও আমরা এই নিরীহ পশু পাখিগুলোকে গালিতে রূপান্তরিত করেছি। এটাও এক ধরনের অমানবিক কাজ। কুত্তার বাচ্চা, শুয়োরের বাচ্চা, জানোয়ারের বাচ্চা, বান্দরের বাচ্চা, এই গালিগুলোর মধ্য দিয়ে নিরীহ পশুদেরকে খুবই ছোট করে দেখা হয়। অনেক মানবিক বোধসম্পন্ন মানুষও এই ধরনের গালিগুলো দিয়ে থাকেন। তখন সত্যিই খুব দুঃখ লাগে, আবার মানুষরাই এই গালি দেওয়া পশু পাখিদেরকে জবাই করে হত্যা করে খাই।
কিন্তু মানুষের প্রথাগত ধর্মীয় গুজবের বলি হয়ে, উল্লাসের সাথে প্রতিনিয়ত পশু হত্যা করে যাচ্ছে। সেটাও কিন্তু এক ধরনের অমানবিক কাজ, আবার মানুষরাই সেটাকে স্বীকৃতি দিয়েছে। একটা মানুষের জীবন, আর গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগির জীবনের মধ্যে তেমন কোন পার্থক্য নেই। সবারই সমানভাবে বাঁচার অধিকার আছে। সবারটাই জীবন!
বর্তমান পৃথিবীর মানুষ হাজারো সমস্যার মধ্য দিয়ে তাদের জীবন অতিবাহিত করছে। এমন নয় যে সমস্যাগুলো আগে ছিলো না, আগে আরও বেশি ছিল। দিন দিন মানুষ সভ্য হচ্ছে, আর সমস্যাগুলো থেকে নিজেদের বের করে এনেছে।
বর্তমান বিশ্বে যে সমস্যাগুলো বিদ্যমান!
– ধনী গরিবের বৈষম্য
– উগ্র ধর্মান্ধতা
– উগ্র জাতীয়তাবাদ
– লিঙ্গ বৈষম্য
এই সবগুলোর পিছনেই আছে রাজনীতির এক ভয়ংকর খেলা!
এইরকম আরো কয়েকটা সমস্যা যুক্ত করা যায়। তবে প্রধানত এই সমস্যাগুলো সমাধান করতে পারলেই পৃথিবীতে শান্তি ফিরে আসবে। পৃথিবীর অনেক দেশেই শান্তি ফিরে এসেছে, কারণ তারা এই সমস্যাগুলো থেকে বের হয়ে এসেছে। তারা একটা মানবিক সমাজ প্রতিষ্ঠা করেছে। তারা মানুষকে মানুষের চোখে দেখে, এমনকি পশুপাখির দিকেও তারা মানবিক দৃষ্টি দেয়।
তারপরেও যে দেশগুলো বেশি সমস্যায় জর্জরিত, সেগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। রাষ্ট্রীয়ভাবে অনেক চেষ্টা করা হচ্ছে সমস্যাগুলোর সমাধান করার। ধনী গরিবের বৈষম্য দূর করার, ধর্মীয় বিদ্বেষ বন্ধ করার, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার থেকে মানুষকে বের করে আনার। তারপরেও সরকার পেরে উঠতেছে না, কিন্তু কেন? তার পিছনের আসল কারণ কী?
আমাদের ক্ষতটার দিকে তাকালে হবে না! আমাদের বুঝতে হবে ক্ষতটা কতটা গভীর। বর্তমান সমাজে যে সমস্যাগুলো বিদ্যমান, আমাদের কেবলমাত্র সমস্যা নিয়ে ভাবলে হবে না। আমাদের বুঝতে হবে সমস্যাগুলোর উৎপত্তি স্থল কোথায়!সমস্যা থাকবেই, সমস্যার সমাধানও আছে, তবে আমাদের সমস্যা সম্পূর্ণভাবে নির্মূল করতে হলে সমস্যাগুলোর গভীরে যেতে হবে।
প্রথমেই কিছু বিষয় লক্ষ্য করা যাক। মানুষ অন্য একজন মানুষকে হত্যা করার সাহস কোথায় পায়? অথবা অমানবিকভাবে, অনেকগুলো মানুষ মিলে একজন মানুষকে পিটিয়ে ফেলার উৎসাহ কীভাবে অর্জন করে?
ধরুন কোন একজন ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে, দিনে অথবা রাতে যেকোনো সময়ই হতে পারে। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকা কয়েকজন লোকটার দিকে তাকিয়ে সন্দেহ করলো, তার কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলো, আপনার পরিচয় কী? এখানে কেন আসলেন? অথবা কার কাছে আসলেন? এই বিষয়ে তর্কাতর্কির মধ্য দিয়ে বিষয়টা বাড়াবাড়ি দিকে চলে গিয়েছে, এবং আশেপাশে থাকা আরও অনেক মানুষ সেখানে জড়ো হতে থাকলো। অবশেষে শুরু হয়ে গেল উপর্যুপরি গণধোলাই। এখানে একটা বিষয় খুব সুক্ষ্মভাবে খেয়াল করবেন, যাকে গণধোলাই দেওয়া হচ্ছে সে কিন্তু অপরিচিত একজন মানুষ। আর যারা গণধোলাই দিচ্ছে তারা সঙ্ঘবদ্ধ এলাকাবাসী।
অনেক সময় দেখা যায়, কয়েকজন মানুষ সুকৌশলে পূর্ব শত্রুতার জের ধরে, চোর অথবা অন্য কোন অপবাদ দিয়ে উপর্যুপরি গণধোলাই দিয়ে থাকে। বেশিরভাগ সময় এইসব ঘটনায় ভিকটিম মারাও যেতে পারে। সেটা এক ধরনের ক্রাইম, যেকোনো প্রকার আক্রমণই অপরাধ, সেটা শত্রুতার বশে হোক, অথবা গুজবের কারণেই হোক।
যেহেতু দুইটার কারণই ভিন্ন, তাই আমাদের দুইটা দুইভাবে বিবেচনা করতে হবে। পূর্ব শত্রুতার জেরে ঘটে যাওয়া অপরাধ সেটা আলাদা বিষয়। সেটা নিয়ে আমরা আলোচনা নাই করলাম। কারণ সেটা কেন হয়, তা আমরা সবাই মোটামুটি জানি।
তবে গুজবে কান দিয়ে অন্যের কথা শুনে সবাই মিলে একটা মানুষকে কেন হত্যা করা হয়, সেটা নিয়ে আমাদের ভাবনার আছে অনেক কিছুই। আসুন কিছু বিষয় লক্ষ্য করা যাক, ধরুন কিছু মানুষ মিলে একটা মানুষকে আক্রমণ করেছে, তখন সেখানে থাকা অনেকেই দূর থেকে দাঁড়িয়ে সেই ঘটনাটা উপভোগ করবে। অনেকেই ঘটনাটা দেখেও না দেখার ভান করে বাসায় চলে যাবে। অনেকেই সেখানে দাঁড়িয়ে থেকে মোবাইলে ভিডিও করবে, অথবা ছবি তুলবে। আবার কেউ কেউ বাঁচানোর চেষ্টা করবে।
কিন্তু লক্ষ্য করুন সেখানে থাকা কিছু উচ্ছৃঙ্খল ছেলে আছে, যাদের কেউ থামাতে পারবে না। যারা কারোর কোন কথাই শুনবে না। যাদের বয়স বিশ থেকে শুরু করে ৩৫ এর মধ্যে হয়ে থাকে। কিন্তু তারা অল্প সময়ে সংঘবদ্ধ হয়ে কেউ একজনকে মারার সাহস পায় কোথায়? খেয়াল করবেন, সেই ছেলেগুলো সাধারণত বেকার হয়ে থাকে, অথবা লেখাপড়া করছে এইরকমও হতে পারে।
খুব ভালোভাবে খেয়াল করবেন, এই ছেলেগুলোর পিছনে থাকে কোন এক রাজনৈতিক পরিচয়, এরা সচরাচর বিভিন্ন দোকানে বসে আড্ডা দেয়, বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। বিভিন্ন স্কুল কলেজের সামনে দাঁড়িয়ে থেকে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। এবং গুজবের সুযোগ নিয়ে মানুষকে আক্রমণ করে, নিজেদের শক্তি দেখানোই এদের উদ্দেশ্য, এগুলোই হচ্ছে তাদের দৈনন্দিন কাজ।
বাচ্চারা কাউকে গণধোলাই দেয় না, বয়স্ক বৃদ্ধরাও কাউকে গণধোলাই দেয় না, আবার নারীরাও এইসব কাজে কখনো সম্পৃক্ত হয় না। তাহলে যারা এই অপরাধগুলো করে তারা নিশ্চয়ই মাঝ বয়সী যুবক।
এবার একটা বিষয় লক্ষ্য করুন। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটি ৩৬ লাখ ৫০ হাজার।
এর মধ্যে ৮ কোটি ১৯ লাখ ১০ হাজার পুরুষ ও ৮ কোটি ১৭ লাখ ৪০ হাজার নারী। বাংলাদেশে যুবক যুবতীর সংখ্যা চার কোটি ৮০ লাখ। আর পুরুষের মধ্যে যুবকের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি, পুরুষ তার অর্ধেক, মানে দুই কোটি ২২ লাখ, এদের মধ্যে ১৫ থেকে ২৯ বছর বয়সী ১০ লাখ ১ হাজার যুবক কোনো কাজই করে না।
এদের মধ্যে একাংশ বিভিন্ন অনৈতিক কাজে জড়িত, যেমন চুরি, ডাকাতি, সন্ত্রাসী, মাদক ব্যবসা। এদের সাথে যোগ হয় সামান্য কিছু কলেজ এবং ভার্সিটির ছাত্ররা, সাথে বিভিন্ন বয়সের শ্রমজীবী মানুষ, এরা সবাই মিলেই সমাজে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছে। সমাজের যতরকম অন্যায়-অবিচার আছে এরাই প্রত্যক্ষ এবং পরোক্ষভাবে এগুলোর সাথে জড়িত।
আর এদের নিয়ন্ত্রণ করা, এবং এদের পিছনে ইন্ধন দেওয়ার জন্য বসে আছে বড় বড় রাজনৈতিক নেতারা। তারাই এদের সৃষ্টিকারী, তারাই এদের হাতে অস্ত্র তুলে দেয়, তারাই এদেরকে অন্যকে মারার অনুমতি দেয়। তারাই এদেরকে সামান্য কিছু টাকার বিনিময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিযুক্ত করে।
সকল সমস্যার মূলই বসে আছে রাজনীতিবিদরা। বাংলাদেশের এমন কোন সেক্টর নেই যে সেক্টরে রাজনীতিবিদদের দাপট নেই। শহরের ফুটপাত পর্যন্ত রাজনীতিবিদদের দখলে, এমনকি টয়লেটের ইজারাও এরা নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশের সবকটা মসজিদ রাজনীতিবিদরাই নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশের সবকটা ওয়াজ মাহফিলের প্রধান অতিথি থাকে রাজনীতিবিদরা। এমনকি প্রশাসনের বিভিন্ন জায়গা দখল করে বসে আছে রাজনীতিবিদরা। যে দল যখন ক্ষমতায় থাকে, তাদের দাপট সবচেয়ে বেশি থাকে। রাজনীতিবিদরাই চেয়ারম্যান, মেম্বার হয়ে এলাকায় অধিপত্য বিস্তার করে, আর সংসদ সদস্য হয়ে পুরো একটি আসনের ক্ষমতা নিজের হাতে নিয়ে নেয়।
রাজনীতিবিদরা ধর্মকে পুঁজি করে, মানুষের অনুভূতি নিয়ে খেলা করে। ধর্ম জিনিসটাও একটা গুজব। এই যে বিভিন্ন এলাকায় মাজার, ফকির দরবেশ বসে আছে, এরাও কিন্তু রাজনীতিবিদদের হাতেই নিয়ন্ত্রিত। পীর ফকিররা যত প্রকার ধর্মীয় কুসংস্কার মানুষের মাঝে ছড়িয়ে দিয়েছে, যেমন তাবিজ কবজ, পানি পড়া, জিনে ধরা, বান মারা, সেইসব পীরদের সব ধরনের সাহায্য দিয়ে থাকে এই রাজনীতিবিদরা। আমাদের বুঝতে হবে সমাজের কুসংস্কার গুলো এখান থেকেই জন্ম নেয়।
এদের বিরুদ্ধে প্রশাসন মাঝে মাঝে বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করে, কিন্তু রাজনীতিবিদরা সেটার বিরুদ্ধে দাঁড়িয়ে তাদেরকে থামিয়ে দেয়। মূলকথা সমাজের সকল সমস্যার মূলেই আছে এই নষ্ট রাজনীতির এক ভয়ঙ্কর খেলা। ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চাদের হাতে বোমা তুলে দেয় এই রাজনীতিবিদরা। রাজনীতি খারাপ কিছু না, মানুষের জীবনে রাজনীতি থাকবেই। তবে রাজনীতিকে খারাপ পথে যারা পরিচালনা করে তারাই খারাপ, যারা নিজেদের স্বার্থে রাজনীতিকে নষ্ট করে ফেলেছে তারাই খারাপ।
রাজনীতি আপনার আমার ভাতের অধিকার নিশ্চিত করে। আবার আপনার আমার ভাতের অধিকার রাজনীতিই হরণ করে। যে দেশের রাজনীতি যতটা সুস্থ সেই দেশের মানুষের জীবন যাত্রার মান ততটাই উন্নত।
দুঃখজনক হলেও সত্য বাংলাদেশের রাজনীতি নষ্ট হয়ে গেছে, এই রাজনীতিকে কখনো নষ্ট করেছে আওয়ামী লীগ, কখনো বিএনপি, কখনো জাতীয় পার্টি। ক্ষমতায় যারা ছিল তারাই মানুষের অধিকার কেড়ে নিয়েছে। জোর করে ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য সমাজের সব স্তরে নিজেদের অাধিপত্য বিস্তার করেছে।
এইসব সমস্যা থেকে মানুষের মুক্তি পাওয়ার একটি মাত্র পথ খোলা আছে, সেটা হলো নষ্ট রাজনীতির ভয়ংকর খেলা থেকে মুক্তি পাওয়া। রাজনীতিতে তালেবানদের উত্থান ধ্বংস করে দিয়েছে আফগানিস্তানকে। একদিন হয়তো বাংলাদেশকেউ ধ্বংস করে ফেলবে।
তাই এখনই সময়, রাজনীতিবিদদের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে প্রতিবাদ প্রতিরোধ গড়ে তোলা। আমাদের বুঝতে হবে, তরুণদের হাতেই আগামীর বাংলাদেশ, তরুণরা সঠিক পথে এলেই বাংলাদেশ এগিয়ে যাবে।
ব্লগার – অনলাইন অ্যাকটিভিস্ট