রেনু, মিন্নি, প্রিয়া বা আমি

গুলশান আরা:

আমাদের সামাজিক মূল্যবোধের কতটুকু অবক্ষয় হয়েছে এই কিছুদিনের ঘটনাগুলো এর জলন্ত প্রমাণ। রেনু বলো, মিন্নি বলো বা প্রিয়া বলো, প্রতিটি ক্ষেত্রে কিন্তু একটা জায়গায় যথেষ্ট মিল আছে। এরা মেয়ে, পারিবারিকভাবে সামাজিকভাবে তাদের পিঠ আমরা দেয়ালে ঠেকিয়ে দিয়েছিলাম।

তোমরা যদি রেনুর ভাইয়ের কথাগুলো পড়ো তাহলে খুব সহজেই বুঝতে পারবে কতটুকু অনিশ্চয়তার মধ্যে সে জীবন যাপন করছিল, একটা একা মাকে দু‘দুটো সন্তান নিয়ে আমাদের সমাজে বেঁচে থাকতে হলে যে কতটুকু ভয়াবহ যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে বেঁচে থাকতে হয় এটা শুধুমাত্র সেই মেয়েরাই বুঝবে যারা এভাবে বেঁচে রয়েছে।

রেনু নামের যে মেয়েটা খুব ভালো একজন ছাত্রী ছিল, সেই মেয়েটা নাকি খুব ভয় পেত, খুব সহজেই প্যানিক হয়ে যেত, আমরা কি বোঝার চেষ্টা করেছি যে কেন এটা হতো?

‘দায়িত্ব’ এত বড় এক বোঝা! জীবন যুদ্ধে ক্লান্ত শ্রান্ত এক মানুষকে এই দায়িত্বের বোঝাই নিয়ত কুরে কুরে খায়। দুই সন্তানের ভবিষ্যৎ, তাদের একটা সুন্দর জীবন এইসব চিন্তাগুলো রেনুকে প্রতি নিয়তই হয়তো ভাবাতে। একা মা হওয়ার পিছনে চারিদিকে গঞ্জনা তো ছিলই, একই সাথে ছিল প্রতিদিনের তার নিজের কষ্ট। সেখান থেকেই হয়তো দুটো বখাটে যখন তাকে বিভিন্ন কথা জিজ্ঞেস করছিল সে ভয় পেয়ে গিয়েছিল, অগোছালো উত্তর দিচ্ছিল।

আমাদের অসুস্থ সমাজের একজন সদস্য হওয়ার জন্য সে প্রতিদান স্বরূপ তাকে নির্মমভাবে মৃত্যুবরণ করতে হলো।

রেণু, তোমার তুবাকে নিয়ে আমরা সবাই খুব চিন্তিত এখন। তুমি নিশ্চয়ই হাসছো এখন, কারণ, তুমি এখন মেঘের বাবা-মার সাথে, পেট্রোল বোমায় পুড়ে মরা অগনিত বাবা মায়ের সাথে বসে আছো আর দেখছো, তাদের তুবারা কেমন আছে! তুমি তাই জানো তোমার তুবাও একই রকম থাকবে। আহা! উহু! আর বড়জোর এক মাস! তারপর সবাই আমরা যার যার কাজে ব্যস্ত। আর একটা তুবাকে নিয়ে ব্যস্ত এক অসুস্থ সমাজ!

গুলশান আরা

আর মিন্নি! বেচারা মেয়েটা যা সুন্দর, কী সুন্দর মায়াময় চোখ দুটো; কিন্তু মেয়েটাকে আমার বলতে ইচ্ছে করে নিম্নবিত্ত পরিবারে সুন্দর হয়ে জন্মানোটা একটা অপরাধ, সেটা ওর বোঝা উচিত ছিল। আর আমাদের মতো সমাজে যদি তুমি সুন্দর হয়ে জন্মাওই, তোমাকে অবশ্যই নিজেকে ঢেকে রাখতেই হবে, ভয়ে ভয়ে চলতে হবে, অবলা নারী হিসেবে নিজেকে সাজাতে হবে। আর তা না করে তুমি কোথা থেকে নিজেকে এতো সুন্দর করে উপস্থাপন করতে গেলে? তুমি কি জানো সমাজে বাপের খুঁটির জোর থাকা কত প্রয়োজন যেসব মেয়েরা তোমার মতো দেখতে সুন্দর হয় তাদের জন্য? প্রতিটি জায়গায় প্রতিটি মানুষের কাছে তুমি অপদস্থ হবে।

এই আমরা মেয়েরাও যারা তোমার মতো সুন্দর নই, তুমি জানো কত অসম্ভব ঘৃণা করি আমরা তোমাকে? তোমার মত সুন্দর মেয়েদের জন্যই তো আমাদের স্বামীরা নষ্ট হয়, ছেলেগুলো পথভ্রষ্ট হয়, সমাজে বিশৃঙ্খলা তৈরি হয়। মেয়ে এগুলো তোমার জানা খুব প্রয়োজন ছিল।

তোমার ভিডিওটি যেদিন প্রথম দেখি সেদিনই মনের অজান্তে লিখে ফেলেছিলাম “মেয়ে তুমি বেঁচে রও”। কথাটা লিখেছিলাম মনের অজান্তেই, তোমাকে দেখে মনে হয়েছিল এই সমাজ তোমাকে আর বাঁচতে দেবে না, সমস্ত অপকীর্তির দায়ভার তোমার ঘাড়ে চাপানো হবে, তোমার সৌন্দর্য সমাজের সবচেয়ে বড় শত্রু। তার তিন দিন পরেই তোমাকে নিয়ে নিউজটা দেখে যা হেসেছিলাম। এ এক অলিখিত সত্য।

মেয়ে তুমি যদি সুন্দর হও মনে রেখো তুমি শুধুই ভোগ্যপণ্য। তবে জানো আমি খুব চাই তোমার বাবার মতো বাবা প্রত্যেকটা ঘরে জন্ম নিক। পৃথিবীর সকল পুরুষদের প্রতি যখন ঘৃণায় দুচোখ কুঁচকে আসে। এক তোমার বাবার প্রতি শ্রদ্ধায় মাথা নত হয়। বেঁচে থাকুক এমন বাবারা প্রতিটি মেয়ের জন্য।

এবার আসি ধর্ম বর্ণ জাতি গোত্র এমনকি রাজনীতি -নির্বিশেষে সবাইকে এক কাতারে দাঁড় করিয়ে দেয়া প্রিয়ার ক্ষেত্রে। আহা প্রিয়া! তুমি দেখিয়ে দিলে এই বাঙালির একতা কত শক্তিশালী। এমনকি দেশ, মুক্তিযুদ্ধ, রাজাকার এই তিনে বিভক্ত রাজনৈতিক দলগুলোও কী ভয়াবহ দেশপ্রেমিক হয়ে উঠলো! শুধু আবারও একজন শেখ হাসিনা এই আগুনে পানি ঢাললেন, তিনিই যে সত্যিকারের রাষ্ট্র নায়ক তা বোঝালেন।

এই প্রিয়া সাহা কি আমাদের কাছে আবেদন জানায়নি যখন তার বাড়িঘর পুড়িয়ে দেয়া হয়েছিল? সেই জন্য কি সে রাস্তায় মানববন্ধনও করেনি? কই ছিলো আমাদের এতো সহমর্মিতা তখন? রাষ্ট্র কি তার অধিকার ফিরিয়ে দিতে পেরেছিল?

প্রিয়া যেটা করেছে সেটাকে সমর্থন করছি না, কিন্তু ছোটবেলায় পড়তাম ৮৫ ভাগ মুসলমান আর বাকি ১৫ ভাগ অন্যান্য ধর্মাবলম্বী নিয়ে আমাদের এই দেশটা গঠিত। খুব জানতে ইচ্ছে করে ওই ১৫ ভাগ কোথায় গেল? একটা মানুষকে যখন তুমি দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে দাও, তারা আহাজারিগুলো যখন তোমার কানের পাশে চিৎকার করে বলার পরও তোমার কর্ণকুহরে পৌঁছায় না, বিন্দুমাত্র সমবেদনা তৈরি হয় না, অসহায় সেই মানুষটি কিন্তু তখন পদে পদে ভুল করে।

প্রিয়ার ভুলটি কিন্তু তেমনই একটি ভুল। বিচারের বাণী যখন নীরবে নিভৃতে কাঁদে, ন্যায়বিচারের হাহাকার মানুষকে তখন অনেক দূর পর্যন্ত নিয়ে যায়। খুব কম মানুষই এই সময়টাতে নিজেকে সঠিক পথে চালিত করতে পারে। বিশাল মানসিক শক্তির দরকার হয়, যা প্রিয়ার হয়তো ছিল না। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে আমরা অনেক মেয়েরাই তার পাশে দাঁড়িয়েছি। কিন্তু তার স্বামীর একটা বয়ান পেলাম না।

মনে রাখতে হবে ক্ষুধার্ত মানুষ চুরি করবেই, একইভাবে ন্যায় বিচারের আশায় দ্বারে দ্বারে ঘুরে বেড়ানো মানুষটিও একটা অন্যায় করে ফেলবে। এই অন্যায় আসলে তার প্রতিবাদ, তার সাথে ঘটে যাওয়া অন্যায়ের বিরুদ্ধে তার প্রতিবাদ। এর বিচার কোন রাষ্ট্রীয় আদালতে হবে না, এই বিচারের ভার শুধু মানবিক আদালতেই ছাড়া যায়।

পরিশেষে বলবো, এক নষ্ট সমাজে বড় হচ্ছে আমাদের সন্তানেরা, এই সমাজ থেকে নষ্ট সন্তানই তৈরি হবে। ছেলের সমান একজনের কাছে যখন মার খেতে খেতে একজন মা মারা যায়, ভাইয়ের বয়সের একজন ছেলে যখন আর আরেকটি ছেলেকে কুপিয়ে হত্যা করে, ছোট ছোট বাচ্চারা যখন নিগৃহীত হয়, পদস্থ মানুষজন যখন পদের অপব্যবহার করে অন্যকে অপদস্থ করে, দুর্বলের উপর সবলের অনবরত আঘাত চলে, বিচারের বাণী নীরবে নিভৃতে কাঁদে না বন্দি হয়, সেই সমাজ বা দেশ অর্থনৈতিকভাবে যতই উন্নত হোক না কেন কিচ্ছু যায় আসে না…ঐ সমাজকে গোড়া থেকে উপড়ে ফেলতে হবে অথবা পরিত্যাজ্য করতে হবে।

শেয়ার করুন: