সুশীল সংখ্যাগুরুদের কাছে খোলা চিঠি…

সান্দ্রা নন্দিনী:

প্রিয়া সাহা সংক্রান্ত বিতর্কটা তার অতিকথন অর্থাৎ মনগড়া অতিরঞ্জিত তথ্যপ্রদান এবং ঘরের কথা একেবারে ট্রাম্পকে জানানোর এই আয়োজনের পেছনের ষড়যন্ত্র পর্যন্তই রাখুন। তিনি যেটা করেছেন তা অবশ্যই দেশের ভাবমূর্তি ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ঠেলে দেয়। তার তথ্যগত বাগাড়ম্বরের জন্য তাকে অবশ্যই জবাবদিহি করতে হবে।

এসব তো ঠিকই আছে, তবে কখনোই এইদেশে হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান ও আদিবাসীদের ওপর কোনও নির্যাতন হয়নি কিংবা হচ্ছে না-জাতীয় দাবিটা যারা করার চেষ্টা করছেন, তাদের এই অসততার তীব্র নিন্দা জানাচ্ছি। আপনাদের এই চোখে ঠুলিপরা কুৎসিত চেহারাটা একেবারেই আর নেওয়া যাচ্ছে না।

মুক্তিযুদ্ধকালেও যেখানে এইদেশে ৩৫ শতাংশ অমুসলিম নাগরিক (‘সংখ্যালঘু’ ট্যাগ তখনো গায়ে লাগেনি কিনা!) বসবাস করতেন, এরপর কমতে কমতে এখন তা কীভাবে ৭ শতাংশে এসে ঠেকলো সে বিষয়টা কখনো একটুও ভেবে দেখেননি বোধহয়।

আপনি নিশ্চই কখনোই কোনও মন্দিরে প্রতিমা ভাঙচুর কিংবা আগুন দেওয়ার খবর শোনেননি। রামুর প্রাচীন বৌদ্ধবিহার পুড়িয়ে ছাই হতে দেখেননি। একইসাথে সেখানকার হিন্দু-বৌদ্ধদের ওপর দুইদিন ধরে চালানো লুটপাটের খবর আপনার কান পর্যন্ত পৌঁছায়নি। আপনি ফেসবুকে ভুয়া অ্যাকাউন্ট খুলে কাবা শরিফে শিবকে বসিয়ে রসরাজকে ফাঁসিয়ে মন্দির ও হিন্দুদের বাড়িতে হামলা চালিয়ে শেষপর্যন্ত বেচারাকে জেল খাটিয়ে, ভারতে পাঠাতে বাধ্য করার ঘটনাও জানেন না। নাসিরনগরে মসজিদে মাইকিং করে আপনাদের ভাষায় সেখানকার সংখ্যালঘুদের ওপর চালানো তাণ্ডব সম্পর্কেও কিছু শোনেননি।

এছাড়া, প্রত্যেকবার এইদেশে নির্বাচনের আগে ও পরেও কিছু ঘটে না, তাইতো? আবার বাড়ির পাশের নামেই গণতান্ত্রিক অথচ ভয়ংকর রকম সাম্প্রদায়িক দেশটির ভেতরে কিছু ঘটলেই এখানকার হিন্দুসমাজে যে বিভীষিকাময় আতঙ্ক নেমে আসে, এমনও কখনো এই জীবনে আপনি দেখেননি আশাকরি।

আচ্ছা, এসব না হয় অনেক দূরের বিষয়, তাই হয়তো আপনার জানার সুযোগ হয়নি, কিন্তু আপনার জীবনে নিশ্চয়ই কখনও আপনার সনাতন ধর্মাবলম্বী ক্লাসমেট কিংবা প্রতিবেশীকে ‘মালাউন’ অলংকারে ভূষিত হতে শুনেছেন। একটু মতের অমিল হলেই কিংবা ছোট-খাট বাক-বিতণ্ডাতেও “আপনারা সব ইন্ডিয়ায় চলে যান না কেন?” জাতীয় প্রশ্ন নিশ্চিতভাবেই কখনো আপনার কান ছুঁয়ে চলে গেছে।

কোরবানি ইদের পর এলাকার মন্দির ও ‘তাদের’ বাড়ির সামনে গরুর হাড়-শিং কিংবা নাড়ি-ভুঁড়ি ফেলে আসতে দেখেছেন। হিন্দুরা সাপ-ব্যাঙ খায়, এটা নিশ্চয়ই ছোটবেলায় শুনে থাকবেন কারও কাছে। অথবা প্রায়শই জাতির বিবেকের পক্ষ থেকে ওঠা সরল প্রশ্ন, “তোমরা গরুর দুধ খাও, কিন্তু গোস্তো খাও না কেন?” বলতে শুনেছেন।

আচ্ছা, এবারে খুবই কমন একটা ঘটনা মনে করিয়ে দেই আপনাকে, দেখি তো কিছু মনে করতে পারেন কিনা। কোনও সামাজিক অনুষ্ঠানে নিমন্ত্রণ করে পরে খাওয়ার সময় ভীষণ এক নিষ্পাপ মুখ করে এসে, “শুধু গরুর মাংসই রান্না হয়েছে, আপনাকে কি ওটাই দেবো, নাকি বেশি করে ডিমের কোরমা দেবো?” বলতে তো নিশ্চয়ই কখনও শুনেই থাকবেন।

আবার রাজনৈতিক পৃষ্ঠপোষণে বেড়ে ওঠা পাড়ার বড় ভাইয়ের ‘নেকনজর’ পড়ায় রাতারাতি উঠতি বয়সী মেয়েকে ‘ওপারে’ পার করার ঘটনাও অবশ্য আপনি কখনো দেখেননি। আপনি তো তাহলে জানেনও না যে, প্রচুর সম্পত্তি থাকা যে কয়জন বনেদি হিন্দু এখনো এদেশে আছে, তাদের সর্বক্ষণ কী পরিমাণ আতঙ্কে দিন কাটাতে হয়। অনেক সময় শেষরক্ষা করতে না পেরে শেষপর্যন্ত রাতের আঁধারে চোরের মতো কিংবা সিকিমাত্র দামে সব বেচে-টেচে দিয়ে সীমান্ত পার হয়ে একেবারে শূন্য থেকে জীবন শুরু করতে হয়। কেননা ভিন্ন একটা দেশে তো কেউ ফুল-চন্দন নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করে না।

এসবের কোনকিছুই যদি আপনি এইদেশে বাস করেও কখনো না দেখে কিংবা না জেনে থাকেন, তবে তো বলতেই হয় যে, আপনি চোখে ঠুলি পরে দিন কাটিয়ে দিতে বেশ ভালভাবেই শিখে গেছেন এবং একই সাথে ভীষণই ‘সরল’ আপনি! তাই এসব বলে আর আপনাকে বিরক্ত করতে চাই না বাপু! আপনি বরং আশে-পাশের কোন কোন দেশের তুলনায় এখানকার ‘সংখ্যালঘুরা’ ভয়াবহ রকম সুখে-শান্তিতে-সম্মানে জীবনযাপন করছে তার ফর্দ তৈরি করুন গিয়ে…।

একটা বিষয়ের উল্লেখ না করে পারছি না, সদ্য দেশ স্বাধীন হওয়ার পর কেউ একজন তাজউদ্দিন আহমেদের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, “এখানকার ‘সংখ্যালঘুদের’ ব্যাপারে কী ভাবছেন?”

এর জবাবে তাজউদ্দিন বলেছিলেন, “আসলে আটকেপড়া বিহারিদের বিষয়ে এখনো কোনও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়নি!” জানি না বিষয়টা আপনাদের সবার মাথাতেই ঢুকলো কিনা। যাদের ঢোকেনি তাদের জন্য বলছি, উনি বাংলাদেশি ‘অ-মুসলিমদের’ সংখ্যালঘু হিসেবে আলাদা ভাগে ফেলতে চাননি। ওনার দৃষ্টিতে বাংলাদেশের বাইরের জনগোষ্ঠীই কেবল ‘সংখ্যালঘু’ হিসেবে বিবেচনার যোগ্য। আর মুক্তিযুদ্ধের মূলমন্ত্রই তো ছিলো, জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকল মানুষের অর্থনৈতিক ও সামাজিক মুক্তি।

যাই হোক, আজ সেই রামও নেই আর অযোধ্যাও নেই। তাই এসব কাঁসুন্দি ঘাঁটা বন্ধ করে চলুন সবাই নাকে তেল দিয়ে ঘুমাই…!!!

সাংবাদিক, ঢাকা ট্রিবিউন।

শেয়ার করুন: