স্নিগ্ধা রেজওয়ানা:
দুদিন আগে প্রিয়া সাহার বক্তব্য নিয়ে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ অপরাপর সংবাদমাধ্যম সকলেই নানা ধরনের প্রতিবাদ ক্ষোভ ইত্যাদি ইত্যাদি প্রকাশ করছেন।
এক্ষেত্রে প্রথমেই বলে রাখি প্রিয়া সাহা বর্তমান বিশ্বের সবচাইতে হাস্যকর বর্ণবাদী একজন শাসকের কাছে তার অভিযোগ তুলে দেয়, কাজেই তার অভিযোগের ফলাফল বা অভিযোগ করার বিষয়টি কতখানি যুক্তিযুক্ত সেটি বলার অপেক্ষা রাখে না। কিন্তু খুব নিবিড়ভাবে যদি ওনার অভিযোগগুলো চিন্তা করা হয়ে থাকে, তাহলে পরিসংখ্যানগত উপাত্তনির্ভর ত্রুটি ছাড়া উনার যে মূল অভিযোগ, সংখ্যালঘুর উপরে নির্যাতন, হত্যা, জমির দখল, ধর্মীয় আচারবিধি পালনে বাধা দেয়া, সে বিষয়গুলো কি একেবারেই অমূলক?
আমরা আমাদের জাতীয় সম্প্রীতি ও সাম্প্রদায়িক চেতনা বজায় রাখার জন্য প্রায়ই বিভিন্ন বয়ানের চর্চা করে থাকি বলে দাবি করি, যেমন ধরুন “হিন্দু মুসলিম ভাই ভাই”, “ধর্ম যার যার, উৎসব সবার” কিন্তু আদতে ইন প্রাক্টিস আমরা সেগুলো কতখানি বিশ্বাস করি বা কতখানি পালন করে থাকি সেটি কিন্তু প্রশ্নসাপেক্ষ।

জাতীয়তাবাদের ধূম্রজালে প্রান্তিক সংখ্যালঘুদের এক ছাতার ছায়া তলে নিয়ে এসে দেশাত্মবোধক চেতনা প্রতিষ্ঠা করা জাতীয়তাবাদের বহু পুরনো কৌশল, ঠিক এই মুহূর্তে দেশে যা হচ্ছে সেটি তার থেকে পৃথক কিছু নয়। কিন্তু তারপরও এ কথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই যে পৃথিবীর যেকোনো দেশে, যেকোনো প্রান্তে মাইনরিটি অথবা সংখ্যালঘুরা বরাবরই নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়ে থাকেন এবং দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই নির্যাতনের ভয়াবহতা আরো প্রকট, কিন্তু তাদের নির্যাতন-নিপীড়নের গল্পগুলো কখনো আমাদের নাড়া দেয় না। আর যখন দেয় সেটি কেবলই ধর্মীয় জাতীয়তাবাদের চেতনা থেকে।
তাই যখন মিয়ানমার থেকে লক্ষাধিক নির্যাতনের শিকার হয়, আমরা কোন ভবিষ্যৎ চিন্তা ভাবনা না করেই সে সকল মুসলমান কমিউনিটিকে সাদরে গ্রহণ করতে রাজি হয়ে যাই। ঠিক একইভাবে যখন পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারতে যখন মুসলমানরা নির্যাতনের শিকার হয়, সেই নির্যাতিত মুসলমানদের প্রতি আমাদের চেতনা জাগ্রত হয়। কিন্তু স্বদেশের প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের যে রুঢ়তা, নিপীড়ন, নির্যাতন সেটি নিয়ে আমরা খুব একটা চিন্তা ভাবনা করি না। আর তারই প্রতিচ্ছবি হচ্ছে প্রিয়া সাহার বক্তব্যের পর তাকে নিয়ে বিভিন্ন বিদ্রুপাত্মক আক্রমণাত্মক মতামতের বহিঃপ্রকাশ।
এখানে কিছু বিষয় তুলে ধরা যাক। যেমন ধরুন, একথা অস্বীকার করার কোন উপায় নেই কালের ক্রমে এদেশের সনাতন ধর্মালম্বীদের জমিগুলো এদেশের ক্ষমতাশীল ব্যক্তিরা বিভিন্ন সময় বিভিন্নভাবে জবর দখল করে নিয়েছেন। এদেশের নিপীড়ন নির্যাতন সহ্য না করতে পেরে মাঠ পর্যায়ের অনেক সনাতন ধর্মালম্বীরা দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছেন।
সনাতন ধর্মালম্বীদের প্রতি শুধু নয়, অপরাপর ভিন্ন ধর্মালম্বীদের প্রতি অবিচারের চিত্র আমার বা আপনার থেকে আড়াল নয়। পূজামণ্ডপে হামলা করে মণ্ডপ ভেঙে দেওয়া, অথবা বিশ্বজিৎ হত্যা অথবা পার্বত্য চট্টগ্রামে আদিবাসীদের উপর নিরন্তর নির্যাতনের গল্প গুলো কি একেবারেই আমার আপনার অজানা? তাহলে প্রিয়া সাহার বক্তব্যের অভিযোগগুলোকে কি একেবারে ভিত্তিহীন হয়ে পড়ে?
ব্যক্তিগত জীবনে আমি একজন নৃবিজ্ঞানী হিসেবে মাঠ পর্যায়ে বিভিন্ন সনাতন ধর্মালম্বী থেকে শুরু করে সংখ্যালঘু নারীদের সাথে আমার নানাভাবে যোগাযোগ এবং সে অভিজ্ঞতার আলোকে বলতে পারি যে তারা তাদের জীবনের বাস্তবতায় প্রতি মুহূর্তে নানা ধরনের বৈষম্যের শিকার হোন এবং নির্যাতনের শিকার হোন।
আর শুধু মাঠ পর্যায়ে নয়, খোদ ঢাকা শহরের শিক্ষিত বুদ্ধিবৃত্তিক চেতনাতেও ভিন্ন ধর্মালম্বীদের পৃথকীকরণ করা হয় বিভিন্ন পরিসরে। আর তাদেরকে পৃথক করে দেখায় একটা জলজ্যান্ত উদাহরণ আপনাদেরকে না দিলেই নয়, আমার কন্যা ভিকারুন নুন নিসা নামক ঢাকা শহরের স্বনামধন্য একটি স্কুলের দ্বিতীয় শ্রেণীর শিক্ষার্থী। প্রথম শ্রেণীতে লটারির মাধ্যমে ভর্তি হওয়ার সুবাদে তার ক্লাসে তার অনেক সনাতন ধর্মালম্বী বন্ধু তৈরি হয়, কিন্তু স্কুলের নিয়ম অনুযায়ী যখন প্রথম শ্রেণী থেকে দ্বিতীয় শ্রেণীতে উত্তীর্ণ হলো, স্কুল কর্তৃপক্ষ হিন্দু ধর্মালম্বীদের জন্য একটি পৃথক সেকশন তৈরি করলো, অর্থাৎ শুধুমাত্র সেকশন এ তেই কেবল হিন্দুধর্মাবলম্বী শিক্ষার্থীরা পড়বে।
এ বিষয়টি আমি যখন থেকে শুনেছি তখন থেকেই আমাকে এতো বেশি নাড়া দিয়েছিল যে বলাবাহুল্য। কেন এই ধরনের একটি পৃথক সেকশনে কেবল সনাতন ধর্মালম্বীদের বাচ্চাদেরকে পড়তে হবে সে বিষয়টি যখন আমি বিভিন্ন সূত্র ধরে কর্তৃপক্ষের কাছে জানতে চাই, তখন আমাকে বলা হয় হিন্দু ধর্মের শিক্ষার্থীদের কেবলমাত্র একটি বিষয় অর্থাৎ হিন্দু নৈতিক শিক্ষা পাঠদানের উদ্দেশ্য নিয়ে তারা এই কাজটি করে থাকেন, কেননা তাদের হিন্দু শিক্ষকের সংকট রয়েছে, তাহলে প্রশ্ন হলো, ভিকারুন নুন নিসা স্কুল এন্ড কলেজের মতো একটি প্রতিষ্ঠানে, হিন্দু নৈতিক শিক্ষা পাঠদানের শিক্ষক নিয়োগ দেয়া নিয়ে এই সংকট তৈরি হয় কেন? অথবা কোন চেতনায় ঢাকা শহরের স্বনামধন্য একটি প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা সুক্ষ্মভাবে সনাতন ধর্মালম্বীদের “অপর” বা other করে তোলেন এবং কেন অপর করে তোলার প্রজেক্টকে উৎসাহ প্রদান করেন!
একথাও সত্য বর্তমান বাংলাদেশের আমলা থেকে শুরু করে মন্ত্রিপরিষদ তথা শাসনতন্ত্রের সর্বোচ্চ পর্যায়ে বিভিন্ন পরিসরে সনাতন ধর্মাবলম্বীর অনেক ব্যক্তিকেই দেখা যায়, কিন্তু মনে রাখা প্রয়োজন এ সকল ব্যক্তি কিন্তু বাংলাদেশের সাধারণ সনাতন ধর্মালম্বী জনতাকে রিপ্রেজেন্ট করে না। এবং একথাও সত্য, বাংলাদেশের অনেক নারী হিন্দু মৌলবাদীতার নৃশংসতার শিকার হোন। তথাপি সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ অপরাপর ভিন্নধর্মাবলম্বীদের উপরে নির্যাতন অত্যাচার নিপীড়ন গল্প আড়াল করা সম্ভব বলে আমার মনে হয় না।
সবশেষে এটাই বলবো, সৌভাগ্যক্রমে আমি বাংলাদেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ শ্রেণীর ধারক এবং বাহক। কাজেই আমার এবং আপনার পক্ষে যত সহজে প্রিয়া সাহার ভিত্তিহীন অভিযোগ নিয়ে সমালোচনা করা সহজ, বিদেশি শাসকের কাছে অভিযোগের অবিবেচকতা নিয়ে কথা বলার সহজ, ঠিক ততটাই তার বেদনা ধারণা বা এ দেশে সংখ্যালঘুদের নির্যাতনের গল্পকে বা তাদের জীবনকে অনুধাবন করা কঠিন।