প্রিয়া সাহার ‘ভুলের’ মাশুল যেন অন্যদের দিতে না হয়!

মনজুরুল হক:

আপনি যখন বন্ধুকে কবিতা উৎসর্গ করেন, বন্ধুর জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানান, বন্ধুর বাচ্চাটার ছবি দেখে ‘এঞ্জেল’ বলেন, তখন ধরে নেন এই ভার্চুয়াল জগতটাতে হ্যাভেনলি বাতাস বইছে!

না।
আপনি একটা ভিসুভিয়াসের মতো আগ্নেয়গিরির গলিত লাভাকে সলিড ভেবে তার উপর দিয়ে আগুনের নদী পার হওয়ার চেষ্টা করছেন।

প্রিয়া সাহা ডোনাল্ড ট্রাম্পকে কী বলেছে সেটা এখন প্রায় উহ্য। এখন জ্বলন্ত বাস্তবতা হয়ে সামনে এসেছে প্রিয়া সাহাকে কীভাবে ধর্ষণ করা উচিৎ, কতদিন ধরে ধর্ষণ করা উচিৎ, তাদের নামে কী কী মামলা হওয়া উচিৎ, তার স্বামীকে কী শাস্তি দেয়া উচিৎ, তাদের চোদ্দ গুষ্টিকে দেশদ্রোহী হিসেবে বিচার করা উচিৎ এইসব জাজমেন্টাল ডিসিশন দিয়ে দিচ্ছেন আম পাবলিক।

প্রিয়া সাহা প্রস্তুতিহীন বক্তব্য দিতে গিয়ে হড়বড় করে ভুল সংখ্যা উল্লেখ করেছেন। কিন্তু সংখ্যালঘুদের গুম করা, বিতাড়ন করা, দেশ ত্যাগে বাধ্য করা, জমি-জিরেত দখল করা, সামাজিকভাবে হেনস্তা করা, অপদস্থ করা (রাষ্ট্রই তো রাষ্ট্রধর্ম দিয়ে তা করে), নিরাপত্তাহীন করা, এসব তো মিথ্যে নয়। সংখ্যা নিয়ে সমস্যা থাকতে পারে, কিন্তু সরকারের কাছেও তো গত ১০০ বছর দূরের কথা, ৪৬ বছরে কত মানুষ দেশ ত্যাগ করতে বাধ্য হয়েছে সেই হিসেব নেই। তাহলে প্রিয়া সাহার ভুল সংখ্যা নিয়ে বিচারের নৈতিকতা কোথায়?

আমি যে গ্রামে জন্মেছি সেই গ্রামে প্রায় ৬০ ভাগ হিন্দু ছিল। এখন একটি পরিবারও নেই। আমার পাশের গ্রামে নীলকুঠি ছিল। আমরা ছোটবেলা ভূতের ভয়ে ওটার পাশ দিয়ে যাওয়া-আসা করতাম না। সেই গ্রামটা ছিল প্রায় শতভাগ হিন্দুর বাস। এখন এক ঘরও নেই। এরকম চিত্র সারা দেশে। ১০০ বছর আগের ৪৫% হিন্দু একাত্তরেও ২১% ছিল। এখন হেফাজতি জমানায় কমে ৭%! বাকিরা গেল কোথায়? ওরা কি বংশবিস্তার করে না? তাহলে সংখ্যায় বাড়ে না কেন?

প্রিয়া সাহার জায়গায় আপনি নিজেকে বসিয়ে ভাবুন তো। ধরুন আপনি মুসলমান। বাস করেন ভারতের হিন্দু অধ্যুষিত বারানসীতে। আপনি নাগরিক হিসেবে অপমান-অপদস্থ হচ্ছেন। অত্যাচারিত হচ্ছেন, নিপীড়িত হচ্ছেন। তখন কী করবেন? প্রথমে সরকারের সাহায্য চাইবেন। পেলেন না। এরপর সমাজের বিবেকবানদের সাহায্য চাইলেন। পেলেন না। তারপর আপনার ধর্মীয় সংগঠনের সাহায্য চাইলেন। পেলেন না। শেষে মানবাধিকার কমিশন বা এই ধরনের মানবিকতা বেচা-কেনা করার দোকানে সাহায্য চাইলেন। পেলেন না। তখন শুনলেন বিদেশে এক প্রবল ক্ষমতাধর সাধু বাবা (যে আসলে ভয়ংকর শয়তান) সবার দুঃখের কথা শুনে প্রতিকারের আশ্বাস দিচ্ছেন। প্রতিকার হোক না হোক, এটলিস্ট কেউ একজন আপনার-আমার দুঃখ-কষ্টের কথা শুনতে চাইছে, এটাই আপনাকে-আমাকে আশ্বস্ত করবে। প্রিয়া সাহার ক্ষেত্রে এটাই ঘটেছে।

ট্রাম্পের সঙ্গে প্রিয়া ছাড়াও মিয়ানমার, নিউজিল্যান্ড, ইয়েমেন, চিন, কিউবা, দক্ষিণ উত্তর-পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইরিট্রিয়া, নাইজেরিয়া, তুরস্ক, ভিয়েতনাম, সুদান, ইরাক, আফগানিস্তান, উত্তর কোরিয়া, শ্রীলঙ্কা, পাকিস্তান, ইরান, জার্মানি ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রতিনিধিরাও দেখা করেন। এটা ওদের বাৎসরিক রেগুলেশন ওয়ার্ক।

তবে তার বড় ভুল হলো সংখ্যালঘুর ওপর অত্যাচার কারা করেছে তা নির্দিষ্ট করেননি। তাই সব বড় দলই দলগতভাবে তার বিপক্ষে কামান দাগতে না পেরে এখন ধর্মীয় আর জাতীয়তাবাদী ইস্যুতে কামান দাগছে। সংখ্যালঘুদের ধনিক অংশ কখনও বিপন্ন ছিল না। এখনও নয়। তারা সব সরকারের আমলেই ঝাঁকের কৈ।

এখন প্রিয়া সাহার ইনস্ট্যান্ট ভুলের খেসারত দিতে হবে এখানে টিকে থাকা দরিদ্র সংখ্যালঘুদের। প্রিয়া সাহার বোকামি এবং ঝাঁকের কৈ-দের শ্রেণি তোষণের খেসারত দেবে গরিব-নিঃস্ব সংখ্যালঘু মানুষগুলো। কষ্টটা এখানেই। উগ্রবাদী প্রিয়াকে পাবে না। পাবে বাড়ির ধারের হতদরিদ্র হিন্দু পরিবারটিকে। সব মর্দানি তার উপর জায়েজ হবে।

শেয়ার করুন: