নওরীন পল্লবী:
খুনের পরেই যে অপরাধটি সভ্য মানুষ সবচেয়ে বেশি ঘৃণা করে, সেটি হচ্ছে ধর্ষণ। দুঃখজনক হলেও সত্যি, মানুষের সভ্যতার যাত্রাপথে কাঁটার মতো বিঁধে গেছে ধর্ষণের মতো প্রবণতাটিও। এটা অনেকটা আব্রাহামিক ধর্মমত অনুসারে মহাপ্লাবনে নবী নূহে’র (আ) নৌকায় শয়তান চেপে বসার মতো।
সভ্য মানুষের ভীড়ে লুকিয়ে থাকা এই নরপশুরা ঠিক মানুষের মতোই দেখতে হয়। মানুষের মতোই হাসে, কাঁদে, ঘর বাঁধে, বাবাও হয়। আবার সুযোগ পেলেই হয়ে ওঠে হিংস্র ধর্ষক।
ধর্ষণ আমাদের সমাজের সংক্রামক ব্যধিতে রূপ নিয়েছে মোটামুটি বিগত দেড় দশকে। দিন যতো যাচ্ছে, ধর্ষণের মতো এই অসভ্য, বর্বর, অমানুষিক অকাজটি ক্রমান্বয়ে বাড়ছে। বিকৃত রুচির এই অমানুষগুলোর হাত থেকে ইদানিং সদ্যজাত শিশুও রক্ষা পাচ্ছে না, নারী হলে তো কথাই নেই!

সম্প্রতি ধর্ষণে নজিরবিহীন রেকর্ডও করে ফেলেছে বাংলাদেশ। চলতি বছরে মাত্র সাড়ে তিন মাসে ৩৯৬ জন নারী-শিশু হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। বেসরকারি সংগঠন ‘মানুষের জন্য’ ফাউন্ডেশনের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি মাসের প্রথম ১৫ দিনে সারা দেশে ৪৭ শিশু ধর্ষণ, ধর্ষণচেষ্টা ও যৌন হয়রানির শিকার হয়েছেন। ৪৭ শিশুর মধ্যে ধর্ষণের শিকার ৩৯ জন। এই পরিসংখ্যানটি একজন সুস্থ মানুষকে মানসিকভাবে অসুস্থ করে তোলার জন্য যথেষ্ট নয় কি?
মূল্যবোধের অবক্ষয়ের এই চরম দুর্দিনে, আমাদের মনোবিদ, আইনবিদ, সমাজবিজ্ঞানী কিংবা অপরাধবিজ্ঞানীরা কি আদৌ কোনো ভূমিকা পালন করছেন? জানি না। এই জেনারেশনটা মিসগাইডেড হওয়ার পেছনে এই বুদ্ধিজীবীদের দায়িত্বহীনতা কম দায়ী নয়। সামনে যখন গাইড দেওয়ার কেউ থাকে না, মানুষ তখন নিজের মনকে বুঝানোর জন্য নিজেই একটা যুক্তি দাঁড় করায়, কিংবা তথাকথিত আইডলের শরণাপন্ন হয়।
এই জেনারেশনটার হয়েছে তাই। সমাজের মেজরিটি এখন সস্তা ওয়াজীদের ‘পর্দা করলে ধর্ষণ বন্ধ হয়ে যাবে’- নামক লেইম লজিকে বিশ্বাস করতে শুরু করেছে। ধর্ষণ থেকে বাঁচতে চারিদিকে বোরকা হিজাবের ধুম।
না, বোরকায় আমার সমস্যা নেই, সমস্যা এই ‘বিশ্বাসে’। জানি না, এই একই বিশ্বাসে, হুজুরদের হাত থেকে বাঁচতে কওমী মাদ্রাসার কোমলমতি শিশুদের জন্য পর্দার ফতোয়াও কি দিবেন তারা?
পূব থেকে পশ্চিম কোথাও ধর্ষকের প্রতি ক্ষোভ কম না মানুষের। সভ্য মানুষ কেনো জানি এই পাশবিক অসভ্য আচরণটিকে কখনোই হালকাভাবে নিতে পারেনি। হয়তো কখনোই পারবে না।
বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে ধর্ষণকে খুনের চেয়েও বড় অপরাধ মনে করে মানুষ। কারণ এ অঞ্চলে ধর্ষণের শিকার হওয়া একজন নারীর বেঁচে থাকা (টিকে থাকা) মরে যাওয়ার চেয়ে কয়েকগুণ বেশি দুঃসাধ্য ব্যাপার।
গ্রাম্য ভাষায়, ধর্ষণের শিকার নারীর ‘ইজ্জত’ চলে যায়, এর অর্থ শুধু সম্মান চলে যাওয়া নয় কিন্তু, মেয়েটির সতীত্ব নষ্ট হয়ে যাওয়া মানে কুমারীত্ব হারানো। রক্ষণশীল সমাজে সতীত্ব রক্ষা মেয়েদের প্রধান কর্তব্য বিবেচিত হয় বলে ধর্ষণের শিকার নারীকে সমাজ আর স্বাভাবিকভাবে মেনে নেয় না, সে সময় দেখা মেলে না প্রেমিক পুরুষদের, ঘরে আরও মেয়ে থাকলে বাবা-মা পর্যন্ত মেয়ের মৃত্যু কামনা করে- এমন নজিরও কম নেই।
নিজের সেই দুর্বিষহ অভিজ্ঞতার সাথে সাথে সমাজের ব্যাঙ্গোক্তি, বক্রোক্তি, অবহেলা, ব্লেইমিং সহ্য করে ক’জন নারী শেষ অবধি বেঁচে থাকতে পারেন জানি না। মেয়েদের সম্মান যে নারীর যোনীর ভেতর থাকে না- লজিক্যালি কিন্তু অনেকেই মানি। তবে গুটিকয়েক মানুষের সুস্থ চিন্তা কিন্তু ধর্ষণের শিকার নারীকে সমাজের এই কুৎসিত আচরণ থেকে বাঁচাতে পারে না। যার পরিণতি প্রায়শই হয় আত্মহত্যা।
অপরদিকে বিচারব্যবস্থার ফাঁকফোকর ও দীর্ঘমেয়াদী মামলা শেষে গুটিকয়েকের শাস্তি কার্যকর হওয়া অর্থাৎ অধিকাংশ ধর্ষক পার পেয়ে যাওয়া, মামলা চলাকালীন হয়রানি, ভিক্টিমকে ভয়ভীতি প্রদর্শন, সর্বোপরি বিচার ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারানো, ধর্ষিতার প্রতি সামাজিক অবজ্ঞা, ঘৃণা, ভিক্টিম ব্লেইমিং সব মিলিয়ে ধর্ষণ এ অঞ্চলের মানুষের কাছে হত্যার চেয়ে বড় অপরাধ কিংবা হত্যার সমান অপরাধ বলেই বিবেচিত হয়। তাছাড়া এ অঞ্চলে প্রচলিত মিথ-‘মৃত্যুদণ্ড মানুষের অপরাধপ্রবণতা কমায়’ ও ‘সর্বোচ্চ শাস্তি কেবল ফাঁসির মাধ্যমেই নিশ্চিত করা সম্ভব’- এসবে বিশ্বাসী হয়ে মানুষ ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড হওয়া উচিৎ বলেই মনে করে।
কিন্তু এই পর্যন্ত ধর্ষকের বিচারের জন্য যে চারটি আইন প্রণীত হয়েছ (Penal Code, 1860 এর Section – 375/376, Cruelty to Women Ordinance, 1983 এর Section -7/8, নারী ও শিশু নির্যাতন আইন, ১৯৯৫ এর ধারা- ২(গ) তৎসহ ধারা- ৬, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইন, ২০০০ এর ধারা-৯ (২০০৩ এ সংশোধিত) -তাতে ধর্ষণের শাস্তিস্বরূপ মৃত্যুদণ্ডের কোন বিধান বাংলাদেশের আইন ব্যবস্থায় নেই।
“ধর্ষকের ফাঁসি চাই”- শীর্ষক প্ল্যাকার্ড হাতে প্রায়ই সচেতন মানুষদের আমরা প্রতিবাদ করতে দেখি, এটা নতুন নয়। কিন্তু গত বছরের শেষের দিকে কিছু নারীবাদী ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি (মৃত্যুদণ্ড) দাবি করে লেখালেখি শুরু করলে, বিষয়টি বিতর্কের জন্ম দেয়।
কারও কারও মতে, “ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড চাওয়া ব্যাপারটি মানবিক নয়। কঠোর শাস্তি অপরাধ প্রবণতা কমাতে পেরেছে এমন কোনো নজির নেই।” তাই যারা ধর্ষকের ফাঁসিতে ঝুলাতে চায়, সমালোচকরা তাদেরকে মানবতাবাদীদের তালিকা থেকে এক রকম খারিজই করে দিচ্ছিলেন।
আমার প্রশ্ন হলো, একটি দেশের আইনে যখন ‘ডেথ পেনাল্টিকে’ সর্বোচ্চ শাস্তি হিসেবে রাখা হয় এবং কেউ যদি সমাজের প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ধর্ষণকে খুনের মতোই বড় অপরাধ মনে করে ধর্ষকের ফাঁসির দাবি জানায়, তাহলে সমস্যাটি কোথায়?
সমালোচকরা সম্ভবত এখানে ‘ডেথ পেনাল্টি অ্যাবোলিশন মুভমেন্ট’কে ‘ধর্ষকের ফাঁসির দাবির মতো একটা সেন্সিটিভ ইস্যুর সাথে গুলিয়ে ফেলেছেন। নিঃসন্দেহে ‘ডেথ পেনাল্টি অ্যাবোলিশন’ একটি মানবিক ও সভ্য চাওয়া। মৃত্যুদণ্ড কখনোই খুনের প্রবণতা কমায় না, এটি যারা মানতে নারাজ, তারা নিচের গ্রাফটি (১) দেখে নিন:
প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুদণ্ডের চেয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড স্বজন হারানো মানুষদের বেশি স্বস্তি দেয়।
বিবিসি’র তথ্যমতে, ১৯৯১ থেকে ২০১৭ সাল পর্যন্ত ১০০টিরও বেশি সভ্য দেশ মৃত্যুদণ্ডের নামে ‘রাষ্ট্রীয় খুন’ রহিত করেছে।
তাই আপনাদের এই মুভমেন্টে অংশ নেওয়া মোটেও দোষের না, বরং বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের মানবতাবাদীরা এই মুভমেন্ট নিয়ে যে ভাবছে তা প্রশংসার দাবি রাখে এবং আশার বিষয়। তবে আপনারা যদি ভেবে থাকেন যে মৃত্যুদণ্ড রহিত হলে অপরাধ প্রবণতা কমে যাবে, গ্রাফে আমি এরকম কিছু বুঝিয়েছি, সেটা সঠিক নয়।
কেননা ২০০৯ সালে বিভিন্ন দেশের সেরা অপরাধ বিজ্ঞানীদের মতামত নিয়ে দেখা গেছে, ৮৭% বিজ্ঞানী মনে করেন, মৃত্যুদণ্ডের সাথে অপরাধ প্রবণতা হ্রাস কিংবা বৃদ্ধির কোন সম্পর্ক নেই, সম্পর্ক আছে মানবতার। গ্রাফে যে পার্সেনটেজের যে পার্থক্য পরিলক্ষিত হচ্ছে, সেটি সভ্য দেশের মানুষের অপরাধ প্রবণতা কমের কারণে, মৃত্যুদণ্ড না থাকার জন্য না।
নিচের গ্রাফটি লক্ষ্য করুন, আমেরিকার মার্ডার রেট সভ্য দেশগুলোর চেয়ে বেশি হলেও, অসভ্য দেশগুলোর তুলনায় কম।
কিন্তু যতোদিন বাংলাদেশের আইনে ‘সর্বোচ্চ শাস্তি মৃত্যুদণ্ড’ বহাল থাকছে, ততোদিন মানুষের ধর্ষকের ফাঁসি চাওয়ার অধিকারেও আপনাকে বিশ্বাস রাখতে হবে। ধর্ষকের ফাঁসি চাওয়া যদি আপনার কাছে অমানবিক মনে হয়, তবে তারও অনেক আগে ‘খুনের বদলা রাষ্ট্রীয় খুন’ অর্থাৎ মৃত্যুদণ্ড প্রথার বিরোধিতা করতে হবে আপনাকে।
খেয়াল রাখতে হবে, মৃত্যুদণ্ড রহিতকরণ মুভমেন্ট যেনো ধর্ষকের ফাঁসি চাওয়া মানবিক কাজ নয়- এই টপিকে বারবার ঘুরপাক না খায়। তাছাড়া ধর্ষণের মতো সেন্সিটিভ ইস্যুতে “ডেথ পেনাল্টি অ্যাবোলিশন মুভমেন্টকে” জড়ানো কতটা দূরদর্শিতার পরিচয় হবে, তাও একবার ভেবে দেখার অনুরোধ থাকবে।
একটা কথা বলুন তো, ধর্ষকের সর্বোচ্চ শাস্তি চাইলেই কেবল আপনাদের ‘ডেথ পেনাল্টি খুব খারাপ জিনিস’— এইটা মনে পড়ে কেন? আপনাদের কথাবার্তা শুনলে মনে হয়, আপনার দেশে ‘ডেথ পেনাল্টি’ বলে কিচ্ছু নাই! মানুষ খালি ধর্ষকেরই ফাঁসি চায়। ধর্ষকের বেলায় খালি মানবিকতা উথলে ওঠে তাই না? কই, দেশের সর্বোচ্চ আইনে যে মৃত্যুদণ্ড আছে, সে ব্যাপারে চুপ কেন আপনারা? এই হিপোক্রেসির মানে কী?
দেশে যতদিন সর্বোচ্চ শাস্তি ‘মৃত্যুদণ্ড’ আছে, ততদিন ধর্ষকের মৃত্যুদণ্ড চাওয়ায় দোষের তো কিছু দেখি না। আর যদি আপনার আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে মৃত্যুদণ্ড রহিতকরণ মুভমেন্ট হয়, তবে আমি সেই আন্দোলনে আসবো। সার্বিকভাবে ‘রাষ্ট্রীয় খুন’ আমিও সমর্থন করি না, যাবজ্জীবনকেই সর্বোচ্চ সাজা মনে করি। কোন সভ্য দেশেই ‘ডেথ পেনাল্টি’ নাই। কিন্তু খালি ধর্ষণের বেলায় মানবতা আওড়ানোর পক্ষে আমি না।
আমার সিক্সথ সেন্স বলে, এভাবে ধর্ষণ ইস্যুতে ‘মৃত্যুদণ্ড রহিতকরণ মুভমেন্টটিকে বার বার জড়াতে থাকলে মুভমেন্টটি এ অঞ্চলে শুরু হবার আগেই বাতিলের খাতায় চলে যাবে। তাছাড়া আপনি যখন সার্বিকভাবে মৃত্যুদণ্ড রহিত করার দাবি না জানিয়ে শুধু একটা নির্দিষ্ট অপরাধের( ধর্ষণ) ক্ষেত্রে মৃত্যুদণ্ডের দিকে আঙুল তুলছেন, সেটি পরোক্ষভাবে অপরাধকে লঘুকরণের হাতিয়ার হিসেবে কাজ করছে।
আমরা চাই না, দূরদর্শিতার অভাবে ‘মৃত্যুদণ্ড রহিতকরণ মুভমেন্টটিও’ বিতর্কিত হয়ে কাঙ্ক্ষিত গ্রহণযোগ্যতা হারিয়ে ফেলুক।