ধর্ষণ যখন বিকৃত মস্তিষ্কের এক খেলা!

লতিফা আকতার:

“ধর্ষণ” যুদ্ধকালীন এক আতংক, যা বর্তমান সমাজে বিকৃত মস্তিষ্কের পুরুষের কাছে একটি খেলা।

আমরা এক অদ্ভুত সমাজে বাস করি। যে সমাজে নারীর জীবন নানান সমস্যায় জর্জরিত। আর নানান সমস্যার মধ্যে হালে নারী জীবনের সবচাইতে বড় সমস্যা হিসেবে আবির্ভুত হয়েছে ধর্ষণ।

ধর্ষণ এমন এক আতংক যা পৃথিবীর ইতিহাসে একেবারেই নতুন নয়। পৃথিবীর আদি হতে নানান ক্ষেত্রে এটি একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়ে এসেছে, এখনও হচ্ছে। আদিকাল থেকে পারিবারিক কলহ হতে শুরু করে রাষ্ট্র ব্যবস্থার দখলদারিত্বে- এই অস্ত্র ব্যবহার করা হয়েছে। যুদ্ধের সময়ে সময়ে আতংক বাড়ানোর জন্য পরিকল্পিতভাবে নারীকে ধর্ষণ করা হতো, এবং এখনও হচ্ছে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোতে। যুদ্ধের একটা কৌশলই হলো এই শব্দটি।

যুগে যুগে শরীরের শুদ্ধতা দিয়েই নারীকে বিচার করা হয়, এখনও হচ্ছে। তাই নারী’র শরীরের উপর তথাকথিত কলংকের কালি লেপনের মাধ্যমে পুরুষ এক আতংক তৈরি করার চেষ্টা করেছে বিভিন্ন সময়। সফলও হয়নি যে তা নয়।

আমাদের যুদ্ধকালীন বহু নারী এরকম শারীরিক নির্যাতনের মধ্য দিয়ে গেছে। আর পরবর্তীতে তার প্রভাব কী ছিলো, কেমন ছিলো তা আমাদের অজানা নয়। এই প্রভাবে নারী ঘর হারিয়েছে, তথাকথিত ‘ইজ্জত’ হারিয়ে হয়েছে দিশেহারা। আর দিশেহারা জীবনের দায় নারীকেই একা বহন করতে হয়েছে। পাশে পরিবার পরিজনকে কমই পাওয়া গেছে, পাচ্ছে।

সময় বদলেছে। শিক্ষার হার বেড়েছে। মানুষ ভদ্র হতে ভদ্রতার শিখরে পৌঁছানোর চেষ্টা করছে। কিন্তু বদলে যাওয়া সময়ে পুরুষের মস্তিষ্কের খুব বেশি উন্নয়ন হয়েছে কিনা তা গবেষণার বিষয়।

তবে একটা বিষয় স্পষ্ট, নারী সময়ের বিবর্তনে অনেকদূর এগিয়ে গেলেও তার শরীর কিন্তু আগের অবস্থানেই আছে, বরং ক্ষেত্রবিশেষে তার অবমূল্যায়ন হয়েছে। মেধায়, ক্ষমতায় না পেরে নারীর শরীরকেই এখনও আঘাতের চরমক্ষেত্র হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। বদলে যাওয়া এই সময়ে নারী শুধুই এক শারীরিক গঠনের কারণে পিছিয়ে পড়তে বাধ্য হচ্ছে। আর অপরদিকে এ সমাজে ধর্ষণ এখন একটি খেলা হয়ে উঠেছে পুরুষের কাছে। এক ভয়াবহ খেলা। চারদিকের খবর পড়লেই আমরা এর ভয়াবহতা উপলব্ধি করতে পারি।

সত্যি বলতে কী এই ভয়াবহতার কারণ এবং এর হাত হতে মুক্তি’র উপায় নারীর বা তার পরিবারের জানা নেই। জানা নেই এই কর্মকাণ্ডের পিছনে কি নারীর পোষাক দায়ী? না তার আচরণ দায়ী? এই প্রশ্নের উত্তর খোঁজা সকল হিসাবের মাত্রা ছাড়িয়ে গেছে।

মাত্রা ছাড়িয়ে যাওয়া এই হিসাবের মধ্যে কোনো হিসাবই মিলছে না। বছর পার না হওয়া শিশু ধর্ষণের শিকার হচ্ছে। শিকার হচ্ছে নিজেকে আবৃত করা নারীটিও। পোশাকের দোহাই এখানে একেবারেই খাটছে না। মসজিদ, মন্দির, বিদ্যাপীঠ কোথাও কন্যা শিশুটি নিরাপদ নয়। মোল্লা, মৌলভী হতে শুরু করে পিতা, সর্বোচ্চ শিক্ষিত বলে স্বীকৃত উপসচিবের কাছ হতেও রেহাই পায় না কন্যা শিশুটি। ধর্ষণের পরে তা ঢেকে রাখতে ধর্ষণের শিকার মেয়েটিকে ধর্মীয় গ্রন্থ ছুঁয়ে কসম কাটানোর পর্যায়ে চলে গেছে!

রেহাই পাওয়ার জন্য কন্যা শিশু’র চেষ্টার কমতি নাই। চোখ কান খোলা রেখে চারদিকে তাকালেই বিষয়টি স্পষ্ট পরিলক্ষিত হয়। একটা স্কুলে পড়ুয়া মেয়েটি তার শৈশবের সৌন্দর্য হারাচ্ছে নিজেকে ঢেকে রাখার চেষ্টায়। আমরা আমাদের স্কুলে গিয়েছি একটা নির্দিষ্ট ড্রেস কোড অনুসরণ করে। কিন্তু আজকাল সেই ড্রেস কোড ভেঙে বিভিন্নতা এসেছে কন্যা শিশুর জীবনে। কেউ বোরকা পরছে, কেউ হিজাব পরছে। কামিজের ডিজাইনে নিজেকে আড়াল করার চেষ্টা দেখে আমার কাছে মনে হয় না শুধুই ধর্মীয় নীতি অনুসরণ করার কারণে এমনটা হয়, হচ্ছে। এ যেন মেয়ে শিশুটির নিজেকে রক্ষা করার আপ্রাণ চেষ্টার এক ফল।

আমাদের মতো সাধারণ মানুষের মনে হওয়া না হওয়ায় খুব একটা পার্থক্য আসে না। পার্থক্য আসে আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায়। আর আসে কন্যা শিশু’র পরিবারের লোকজনের মানসিক জোরের কারণে। একটা সময় ছিলো নারী শারিরীকভাবে নানান অস্বস্তিকর ছোঁয়ার লুকিয়ে রাখতো। রাখতে বাধ্য হতো। শিশুটি বলতে চাইলে চুপ করিয়ে দেওয়া হতো। আর এই “চুপ” শব্দে সমাধান খোঁজা এ সমাজের পরিবারের কন্যা শিশু, নারীর জীবন এখন ধর্ষণ নামক ভয়াবহতার মোকাবিলায় ব্যস্ত। আতংকিত।

এই আতংক হতে মুক্তি পেতে আইনের শাসনের পাশাপাশি পরিবারের লোকজনকে সচেতন হতে হবে, সচেষ্ট হতে হবে। এটা শুধুই কন্যা শিশু বা নারীর পরিবারের একার দায় নয়। দায় ধর্ষকের পরিবারেরই বেশি। পরিবারের একটা সদস্যের আচরণ সঠিকভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই অনেক কিছু বোঝা যায়।

একজন ধর্ষক সন্তান, স্বামী, ভাই এদের সবার বিরুদ্ধে আওয়াজ তাদের পরিবারের সদস্যদেরই তুলতে হবে। তথাকথিত ‘মান ইজ্জত’ এর কারণে পরিবারের সদস্যরা অধিকাংশ সময়ই ধর্ষকের কাজের উপর পর্দা দিয়ে ঢেকে দেওয়ার চেষ্টা করে।

আইনের মাধ্যমে রেহাই পাওয়ার চেষ্টা করে, ক্ষেত্রবিশেষে অর্থ দিয়ে আপোষ করে নেয়। উপায় না থাকলে ধর্ষকের সাথে ধর্ষণের শিকার মেয়েটির বিয়ে দিয়ে দেয়। যা একজন নারীর জন্য খুবই অপমানের।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সচেতনতা হয়তো পুরুষের মেতে ওঠা খেলার হাত হতে নারীকে রক্ষা করতে পারবে। কঠোর শাস্তির প্রচলন একজন বিকৃত মস্তিষ্কের পুরুষকে ও- নারী মাত্র “সেক্স ডল” নয়, মানুষ -এটা ভাবতে এবং সে অনুযায়ী তার সাথে সঠিক ব্যবহার করতে বাধ্য করবে।

শেয়ার করুন: