নওরীন পল্লবী:
নো ভ্যাট অন প্যাড আন্দোলন নিয়ে কিছু কথা।
পিরিয়ড বা মাসিক নারীদের অন্য সব শারীরবৃত্তীয় কাজের মতোই সাধারণ বিষয়; আমাদের মায়েদের পিরিয়ড হয় বলেই আমরা পৃথিবীর আলো দেখেছি। মানবপ্রজাতি টিকে আছে। কী এক অজানা কারণে সমাজের একটা বড় অংশে এখনও মাসিক সংক্রান্ত কথাবার্তা ট্যাবু/নিষিদ্ধ আলোচনা।
পিরিয়ড চলাকালে কয়েকটা দিন নারীদের নানা রকম প্রতিকূল পরিস্থিতির (অস্বস্তি, পেটব্যথা, ‘মুড সুইং’) সম্মুখীন হতে হয়। আর স্যানিটারি প্যাড এই সময়ে নারীদের এক অতিপ্রয়োজনীয় অনুষঙ্গ।

২০১৪ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভে থেকে জানা যায়, শহরাঞ্চলে (৩০-৪০)% নারী প্যাড ব্যবহার করলেও, উচ্চমূল্যের কারণে সারাদেশে এখনও মাত্র (১২-১৫)% নারী স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহার করতে পারে। আর ৮৬% নারীকে পিরিয়ডের সময়ে ব্যবহার করতে হয় ‘পুরাতন কাপড় বা তুলা’।
একজন মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে হওয়ায়, নিজের অভিজ্ঞতা থেকে আরো একটি তথ্য দিয়ে রাখি। এই ১৫% মেয়ের মধ্যে ১২% মধ্যবিত্ত ঘরের এবং তারা লোকচক্ষুর ভয়েই একরকম প্যাড ব্যবহার করে এবং উচ্চমূল্যের কারণে একই প্যাড দীর্ঘসময় ব্যবহার করে। প্যাড সাশ্রয়ের জন্য মধ্যবিত্ত নারীরা প্যাডের সাথে টিস্যু পেপার ব্যবহার করে।
টিস্যু যোগ করে একটি প্যাড ২৪ ঘন্টার বেশি সময় ব্যবহার করে মেয়েরা, যেখানে স্ত্রীরোগ বিশেষজ্ঞরা বলেন, একটি প্যাড ছয় ঘন্টার বেশি ব্যবহার স্বাস্থ্যসম্মত নয়। হাইজিন বেসলাইনের তথ্যমতে, উপযুক্ত পদ্ধতি না নেওয়ায় দেশের ৭৩% নারী জরায়ু, জরায়ুমুখ ও মূত্রনালির সংক্রমণের শিকার হোন, যা পরে ক্যান্সারে রূপ নিতে পারে।
২০১৪ সালের বাংলাদেশ ন্যাশনাল হাইজিন বেসলাইন সার্ভে থেকে জানা যায়, অব্যবস্থাপনার কারণে দেশের ৪০ শতাংশ মেয়ে পিরিয়ডের সময় ৩-৪ দিন স্কুলে যায় না। এই ৪০% এর মধ্যে তিন ভাগের এক ভাগ মেয়ে জানিয়েছে, স্কুলে না যাওয়ার কারণে তাদের লেখাপড়া ক্ষতিগ্রস্ত হয়। অপরদিকে, ট্যাবু হওয়ায় মাত্র ৬% মেয়ে ঋতুকালীন সমস্যা ও এর প্রতিকার সম্পর্কে স্কুলে জানতে পারে।
২০১২ সালে সরকার স্যানিটারি ন্যাপকিন তৈরিতে ব্যবহৃত কাঁচামাল আমদানির উপর ভ্যাট আরোপ করে। টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্ট (টিটিআই) অনুসারে যার পরিমাণ ১২৭.৮৪%। যেখানে ২৫% দিতে হয় কাস্টমস ডিউটি, ৪৫% সাপ্লিমেন্টারি ডিউটি, ১৫% ভ্যাট, ৫% অগ্রিম আয়কর, ৩% রেগুলেটরি ডিউটি এবং ৪% এটিভি। এছাড়া বড় দোকান থেকে কিনতে গেলে আরও ৫% অতিরিক্ত কর দিতে হয় ক্রেতাকে।
দরিদ্র ও নিম্ন আয়ের আয়ের নারীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি প্যাকেট স্যানিটারি ন্যাপকিনের দাম ১০০ থেকে ১৫০ টাকা। মাসিক আয়ের ১০০ টাকা এ খাতে ব্যয় করলে অন্য গুরুত্বপূর্ণ খাতের হিসাব মেলানো দায় হয়ে পড়ে। তাই ইচ্ছা থাকলেও তারা এটা ব্যবহার করতে পারছেন না। ভ্যাট তুলে নিলে প্যাডের মূল্য ৪০% পর্যন্ত কমিয়ে আনা যাবে। ১২০-১৫০ মূল্যের প্যাকেটগুলো কেনা যাবে ৬০-৭০/- অর্থাৎ রিজন্যাবল প্রাইসে।
নিত্যপ্রয়োজনীয় এই পণ্যকে বিলাসী পণ্যের সাথে মিলিয়ে ‘পিংক ট্যাক্স’ আদায়ের এই অমানবিক ভ্যাটের প্রতিবাদস্বরূপ, সেচ্ছাসেবী সংগঠন ‘ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ে’র ফাউন্ডার প্রেসিডেন্ট হিসেবে আমি ২২জুন ফেইসবুকে “#নো_ভ্যাট_অন_প্যাড শীর্ষক ইভেন্ট খুলে লাগাতার লেখালেখি শুরু করলে এবং সংগঠনের সৌজন্যে ২৮ জুন রাজধানীর শাহবাগ ও রাজশাহীতে মানববন্ধনের আয়োজন করলে আন্দোলনটি ছড়িয়ে পড়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং জাতীয় পর্যায়ের পত্রিকা ‘প্রথম আলো’ ও ‘ডেইলি স্টারে’ নিউজ আসে।
সোস্যাল মিডিয়ায় যখন তুমুল ঝড়, তখন ৩০জুন সরকার আমদানি ও সাপ্লিমেন্টারি ভ্যাট প্রত্যাহার কররে প্রজ্ঞাপন জারি করে। প্রজ্ঞাপনে বলা হচ্ছে, কাঁচামালের আমদানির উপর বসানো সমুদয় মূল্য সংযোজন কর, শুধুমাত্র ৪% অগ্রিম কর ব্যতিত। এরপর ‘এবং’ দিয়ে বলা হচ্ছে ৪৫% সাপ্লিমেন্টারি শুল্ক (প্রযোজ্য ক্ষেত্রে) থেকে শর্তসাপেক্ষে অব্যাহতি দেওয়া হলো।
কথা হচ্ছে, ৬০-৭০ টাকায় কেনা প্যাড মধ্যবিত্ত নারীদের জন্য রিজন্যাবল হলেও, দেশের একটা বড় অংশ, নিম্নবিত্ত নারীদের জন্য তা এখনও বিলাসিতা। আমরা আমাদের নারীদের এই বড় অংশটাকে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে রেখে আন্দোলন এখানেই শেষ করতে পারি না।
আসুন এই আন্দোলনকে গণ আন্দোলনে রূপ দিই। স্যানিটারি ন্যাপকিনে ১% ভ্যাটও মানি না, বরং ভর্তুকি দিয়ে নামমাত্র মূল্যে প্যাড সরবরাহ করতে হবে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারত পারলে, আমরা কেনো পারবো না নারীদের সুস্বাস্থ্যের কথা চিন্তা করে প্যাডকে পুরোপুরি ভ্যাটমুক্ত করতে?
দাবি একটাই- #NO_VAT_BUT_SUBSIDY_ON_PAD