স্যানিটারি প্যাড মোটেও লাক্সারি পণ্য নয়!

পুষ্পিতা আনন্দিতা:

স্যানিটারি ন্যাপকিনের উপর ভ্যাট আরও বেড়েছে। যার ফলে দাম আরও বাড়বে। স্যানিটারি ন্যাপকিনের মতো একটা প্রয়োজনীয় জিনিসকে কী করে লাক্সারি পণ্য ধরে নিয়ে তার উপর আরও ট্যাক্স বসানো হয় বুঝতে পারলাম না। বাংলাদেশের অধিকাংশ মেয়েই যেখানে কাপড় ব্যবহার করে। কিছু ব্যবহার করে তুলা, টয়লেট পেপার। যারা কাপড় ব্যবহার করে সেইটা যে কি পরিমাণ আনহাইজেনিক সেইটা না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন।

গ্রামে থাকতে গ্রামের মহিলাদের দেখতাম পুরোনা শাড়ি লুঙ্গি গামছা যা একেবারেই কোনভাবে ব্যবহার করার মতো নেই আর তাই ইউজ করতে। আর এইগুলারে বাড়ির পাশের নোংরা কালো জলের ডোবা, খালে নিয়ে গিয়ে সবার অগোচরে ধুয়ে নিয়ে আসতো। টিউবওয়েল বা পুকুরে তো আর এইগুলা ধুবে না। এরপর শুকানোর ব্যবস্থা ছিলো আরও ভয়াবহ। খড়ের গাদা, ছনের চালের কর্ণার, গোয়াল ঘরের বেড়া, খাটের কোনা, ঘরের অন্ধকার কোনো স্থান ইত্যাদি যেসব জায়গায় অন্যকারো চোখে পরবার কথা না। যা তারা ব্যবহার করে, যেখানে পরিস্কার করে আর যেখানে শুকায় পুরো প্রক্রিয়াটা একবার ভাবুন। কেমন গা ঘিন ঘিন করা একটা অবস্থা!

পুষ্পিতা আনন্দিতা

অনেক মেয়ে তুলা, টিস্যু এসব ব্যবহার করে প্যাডের পরিবর্তে বা প্যাডের সাথে। অনেকটা অর্থনৈতিক কারণেই এটি করে মেয়েরা। কিন্তু এইটারও ভয়ানক স্বাস্থ্যঝুঁকি রয়েছে। তুলা টিস্যু মেল্ট হয়ে জরায়ুর ভেতরে চলে যেতে পারে। প্যাড ব্যবহারেরও নিয়ম আছে। এটা নির্ভর করে ফ্লো এর ওপর। বেশি ফ্লো হলে দুই থেকে আড়াই ঘন্টা, কম হলে চার থেকে ছয় ঘন্টার বেশি ব্যবহার করা ঠিক না কোনো প্যাড। তাতে ইনফেকশন হতে পারে। কিন্তু প্যাডের দাম বেশি হওয়ার কারণে বেশিক্ষণ ইউজ করতে চায় বলে এরসাথে টিস্যু ইউজ করতে দেখেছি। ইভেন রোকেয়া হলে থাকার সময়ও অনেক মেয়েরে এই কাজ করতে দেখতাম।

আমার জীবনে একটা অদ্ভুত ঘটনা ঘটেছিলো একবার। মনে হয় ২০০৯ সালের কথা। হলে থাকতাম। আশুলিয়ায় গেলাম ছোটবেলার বান্ধবীর বাসায়। ও আর ওর বর হামিম গার্মেন্টসে জব করতো। আমার পিরিয়ডের ডেইট মনে ছিলো না, হঠাৎ পিরিয়ড হয়। ওর কাছে প্যাড নেই। প্যাড ইউজ করে না সে।আমরা দুজন ওর বাসা থেকে বের হয়ে রাস্তায় গেলাম। ছোট ছোট বেশ কয়টা ফার্মেসি পেলাম। কিন্তু কোথাও কোনো প্যাড নেই। বলে কেউ কিনে না, তাই রাখি না। আমি এতো অবাক হয়েছিলাম। এতো এতো মেয়ে কাজ করে এখানে, কেউ প্যাড ব্যবহার করে না! অথচ আমার গ্রামের ছোট ফার্মেসিতেও অল্প করে হলেও ন্যাপকিনের প্যাকেট থাকে। কিন্তু গার্মেন্টস এরিয়াতে পাইনি। কারণ কী? কারণ একটাই, দাম। কতো বেতন আর যারা গার্মেন্টেসে কাজ করে?

অনেকে আবার টাকা থাকার পরও বাড়ির মেয়েদের পিরিয়ডের মতো তুচ্ছ কারণের জন্য প্যাড কিনে টাকা নষ্ট করতে চান না। অথচ দেশের মেয়েদের জরায়ু মুখ ক্যান্সারের একটা বড় কারণ এই অস্বাস্থ্যকর উপায়ে কাপড় অথবা এই জাতীয় কিছু ব্যবহার করা। অথচ এই দরকারি জিনিসটার উপর আবারও ট্যাক্স বাড়ানো হলো।

যুগান্তরের একটা প্রতিবেদনে দেখলাম আন্তর্জাতিক মানের ন্যাপকিন তৈরির যে কাঁচামাল বাইরে থেকে আনতে হয়, তার টোটাল ট্যাক্স ইনসিডেন্ট (টিটিআই) ১২৭.৮৪ শতাংশ! স্যানিটারি ন্যাপকিন কোনো বিলাসী পণ্য নয়, অত্যাবশ্যকীয় পণ্য। বাংলাদেশের মতো একটা দেশে যেখানে অধিকাংশ মেয়েই স্যানিটারি ন্যাপকিন ব্যবহারই করতে পারে না, সেখানে তার উপর ভ্যাট আরও কী করে বাড়ানো হয়, তা মাথাতেই আসে না। বরং ভ্যাট তুলে নিয়ে ভর্তুকি দেওয়া উচিত।

এমনিতেই পিরিয়ড প্যাড এসব এখনও ট্যাবু আমাদের সমাজে। একটু জোরে প্যাড চাইলে দোকানের সবাই এমনভাবে তাকায় আশেপাশের লোক এমন চোরা হাসি দিবে যেন কী একটা অনৈতিক কাজ করতে যাচ্ছি। প্যাড কিনতে গেলে লাজুক মুখে ফিসফিস করে। এইবার দেশে গেলে আমার বর আমার জন্য প্যাড এনে বলেছে যে দোকানি তারে এমন করে লুকিয়ে প্যাকেট করে দিলো যেন কোনো ক্রাইম করতে যাচ্ছে সে। আমি তারে বলেছিলাম, তাহলে বোঝো একটা মেয়ে গেলে এরা কী করে তাকায়?

পিরিয়ড কোনো গোপন রোগ না। প্রতিটা মেয়ের শরীরের স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। এরে ট্যাবু বানানোর কিছু নেই। আর প্যাড কোন বিলাসী পণ্য না, প্রতিটা মেয়ে এই স্বাস্থ্যসুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। যেহেতু বাংলাদেশ দরিদ্র দেশ, আর পরিবারের অন্যরাও অধিকাংশ ক্ষেত্রে মেয়েদের এই বিষয়টা নিয়ে তেমন ভাবে না, মেয়েরা নিজেরাও নিজেদের শরীর নিয়ে সচেতন না বা চাইলেও পারে না। তাই এইদেশে প্যাডের উপর ট্যাক্স না বাড়িয়ে বরং তারে সহজলভ্য করা উচিত। সবধরনের ট্যাক্স তুলে দেওয়া উচিত। স্কুল কলেজে ফ্রি প্যাড সরবরাহ করা উচিত। স্যানিটারি ন্যাপকিন উপর ভ্যাট বাড়ানোর প্রতিবাদ জানাই।

#Happy_bleeding

#No_Vat_For_Pads

শেয়ার করুন: