চাইলেই কি ‘আর্য’ বা ‘আরব’ হতে পারবেন?

adity falguli
অদিতি ফাল্গুনী

অদিতি ফাল্গুনী:

রবীন্দ্র সঙ্গীত শিল্পী মিতা হকের পক্ষে একটি স্ট্যাটাস ও সমধর্মী একটি নোট (দুই পর্বে) লেখায় যে অদ্ভুত সব ‘যুক্তি’ ও যুক্তির অভাবে নানা ধরনের গালাগালি বর্ষিত হলো, তাতে বুঝলাম সাম্প্রতিক সময়ে বাংলাদেশে একটি বিদেশী পত্রিকা বা সংস্থার জরিপে যে দেখা গেছে, এদেশের ৮২ ভাগ মানুষ যে শরিয়া আইন চায়, সেটা অমূলক নয়।

শাহবাগ আন্দোলন ১৯৭৫ সালে হারিয়ে যাওয়া বিজয় ও এদেশে ধর্মনিরপেক্ষতা বা উদারতান্ত্রিকতার পক্ষে শেষ লড়াইটা লড়তে চেয়েছিল। এখনো তার শেষ চেষ্টাটা করছে। কিন্তু শেষপর্যন্ত আমরা যে হারবো সেটা তো মোটামুটি পরিষ্কারই হয়ে উঠছে। তবে পরাজয়ে লজ্জা নেই। কারণ এই যুদ্ধটা খুব দরকার ছিল। হারতে হলেও যুদ্ধ করে হারা ভাল। তবে সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষ ‘আফগানিস্তান’ বা ‘পাকিস্তান’  হতে চাইলে সেটাই হতে দিতে হবে।

ইতিহাসের এক বিশেষ সন্ধিক্ষণে বাংলার অগণিত মানুষ ইসলাম ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন এটা ঐতিহাসিক সত্য। সবটাই তরবারির জোরে নয়। জাতিভেদ, হিন্দু ধর্মে একটা সময় নারীর অমানবিক অসম্মান সহ নানা কারণেই এই ধর্মান্তর কখনো দ্রুত, আবার কখনো ধীর গতিতে সম্পন্ন হয়।  ইসলাম ও খ্রিষ্ট ধর্মের মতো দুই সম্প্রসারণবাদী ধর্ম পৃথিবীর যেদেশেই গেছে, সেখানেই আগের সভ্যতা ও সংস্কৃতি বহুলাংশে বিলুপ্ত হয়েছে। কিন্তু একটা ছোট প্রশ্ন রয়ে যায়। ধর্মান্তরিত হওয়ার সাথে সাথে নাম বদলে যায় মানুষের সেটা ধরা যাক সমস্যা নয়। খাদ্যাভ্যাস…হ্যাঁ, ওপার বাংলাতেও সর্বভারতীয়বাদের ঠেলায় দক্ষিণ ও উত্তর ভারতীয় ডিশের প্রাবল্য।

বিশ্বায়ণের কারণে অনেক দেশে পশ্চিমা পোশাকের প্রভাব বাড়ছে। প্রতিবেশী ভারত, নেপাল বা এমনকি পাকিস্তানের বিত্তশালী মেয়েরাও পশ্চিমা পোশাক পরে। কিন্তু গতকাল ও আজ ফেসবুকে আমার প্রতি করা কটু-কাটব্যের বহর দেখে বুঝলাম, বাংলাদেশের অধিকাংশ মানুষ ‘হিজাব’ ও ‘বোরকা’ই নারীর পোশাক হিসেবে চান। মায়াটা লাগছে আপনাদের জন্য একারণে যে, এত কিছুর পরও ত’ আপনারা ‘আরব’ হতে পারবেন না। নাম না হয় ‘সালাম’ বা ‘কালাম’ রাখলেন। ঘরে মৌলভী রেখে অর্থ বুঝে বা না বুঝে হাদিস-কোরান কিছু শিখলেন। এদেশে দুম্বা এমনকি রাজস্থানের উটও হয় না। তাই গোমাংসই প্রধান খাদ্য করে নিলেন। কথায় কথায় ‘বিসমিল্লাহ/আলহামদুলিল্লাহ/মাশাল্লাহ/সুবহানাল্লাহ/ফি আমানিল্লাহ/ঝাঝাকাল্লাহ খায়রান’ বলাও শিখলেন। কিন্তু তারপরও তো অনর্গল আরবি বলতে পারেন না।

বাঙালীর বিদেশী ভাষা শিক্ষার মগজ কোন অদ্ভুত কারণে খুব খারাপ। দুইশো বছর ইংরেজের গোলামি করে, ক্লাস ওয়ান থেকে মাস্টার্স পর্যন্ত ইংরেজি পড়ে, অনেক সময় অনেকে বিদেশ থেকে পিএইচডি করে এসেও পাঁচ লাইন ইংরেজি টানা বা অনর্গল বলতে পারে না। বলার সময় তিনবার থামে। একইভাবে অধিকাংশ হিন্দু পুরোহিত সংস্কৃত মন্ত্র পাঠের নামে বাংলা হরফে লেখা সংস্কৃত দেখে যা পড়েন তা’ কাণে শোনার মত নয়। আরবির হালও তাই।

বাঙালী এমনি বাঙাল যে অন্য কোন ভাষাই কোন অদ্ভুত কারণে (ব্যতিক্রম ছাড়া) সে ভাল পারে না। কারণ হলো কিছুটা ত্রুটিপূর্ণ বিদেশী ভাষা শিক্ষা ব্যবস্থাও। তারপর? পারেন না তো অনর্গল আরবী বলতে। অনর্গল বলতে না পারলে কোন বিদেশী ভাষাই জানার গর্ব করা যায় না।

আর চেহারা? আরব তো না রে ভাই আপনি। ওই উচ্চতা কই পাবেন? ওই গাত্রবর্ণ? যেসব বাঙালী মুসলিম পরিবার আজ তিন দশকের উপর বিভিন্ন আরব রাষ্ট্রে পেশাগত কারণে সেটেলড, একটি ছেলে-মেয়েও আরব পরিবারে বৈবাহিক সূত্রে ‘আরব’ হতে পেরেছে? তারা ত’ কালো চামড়ার বাঙালী মুসলিমকে ‘মিসকিন’ বলে, তাই না?

একইভাবে বাঙালী হিন্দু বা বিশেষত: উচ্চ বর্ণের বাঙালী হিন্দু নিজেকে বহুদিন ধরে ‘আর্য’ ভেবে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছে তার গড়পরতা তামাটে রঙ, ভোঁতা নাক ও বেঁটে শরীরের নিখাদ আদি অস্ত্রাল চেহারা নিয়েই। বাঙালী সেই অদ্ভুত হীনমন্য জাতি, যে হয় ‘আর্য’ বা ‘আরব’ হবার স্বপ্ন দেখে, ‘সংস্কৃত’ বা ‘আরবি’ বলতে চেয়েছে একটা সময়, এখন বলতে চায় ‘ইংরেজি’ আর কাপড়েও কখনো ‘ইংরেজ’ আর কখনো ‘আরব’ হতে চায়। সে কখনোই ‘নিজ’ হতে চায় না।

গত রাত থেকেই অনেক মৌলবাদী আমাকে ভয়ানক সব গালিগালাজ করেছেন। আপনাদের গালিগুলো বোধ হয় অমূলক নয়। এই সকালে আমাকে এই ভাবনাই গ্রাস করছে: আমরা, বাঙালীরা, আসলেই ‘দাস’ ও ‘পতিতা’র জাতি কিনা? নয়তো পরের ভাষা, পরের খাবার ও পরের পোশাকের জন্য এই দীনতা কেন? বাঙালী হিন্দু যেমন ‘আর্য’ হতে চেয়েও পারে নাই। বিদেশী ভাষা সে অনর্গল আয়ত্ত করতে পারে নাই। একইভাবে আজ এই বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মুসলিমই আসলে আইন ব্যবস্থা, খাদ্য, পোশাক…সব কিছুতেই ‘আরব’ হইতে চায়। শুধু আল্লাহ তা’লা আরবের চেহারা আর আরবি ভাষা অনর্গল বলার ক্ষমতাটা দ্যায় নাই। তাই বাধ্য হইয়া ‘আধা বাঙালী’ আর ‘আধা আরব’ থাকতে হইতেছে। কী আর করবেন? সবই আল্লাহর ইচ্ছা!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.