শীলা চক্রবর্ত্তী:
আমাদের উপমহাদেশীয় মূল্যবোধে শরীর এক বজ্জাত ভিলেন! শরীরী চাহিদা থাকলে “পাপ”, শরীরী সম্পর্ক থাকলে পাপ, অবমাননাকর গালাগালগুলোও অধিকাংশই শরীরভিত্তিক বা শরীরী মিলনকেন্দ্রিক! ভারতবর্ষ সাধু-সন্ন্যাসির দেশ ! এখানে শরীর হলো আধ্যাত্ম্য সাধনের বড়ো বাধা, ওই পাপ আরকি!
বেম্মোচারী বললেই ভক্তিতে মাথা নুয়ে আসে। তা সে বেম্মোচারী লোক ঠকিয়েই খান না কেনো, শরীরী সঙ্গ বিবর্জিত মানেই পবিত্র!
রামায়ণে রামানুজ লক্ষ্মণ চোদ্দো বছর স্ত্রীসঙ্গ বর্জিত ছিলেন বলেই মহাপবিত্র তেজের অধিকারী হয়েছিলেন, ইন্দ্রজিৎকে এজন্যেই হত্যা করতে পেরেছিলেন! অর্জুনও দীর্ঘকাল ব্রহ্মচর্য করেছিলেন ব্রত হিসেবে। মহাকাব্যে নিদান দিয়ে দেখানো হয়েছে, বড় বড় পূজা ব্রত বা যজ্ঞটজ্ঞ চলাকালীন রাজপুরুষদের শরীরী সংযমের অভ্যাস করতে হতো আরাধনার পূর্ণ ফললাভের সংকল্পে।
শরীরী উদযাপন ব্রতভঙ্গের নামান্তর! অথচ এসব মোটেও প্রাকৃতিক নয়, বৈদিক ঋষিরাও সবাই কিছু জিতেন্দ্রিয় ছিলেন না, সুন্দরী অপ্সরাদের দেখে দেব-দানব-ঋষি সবারই ধ্যানভঙ্গ হওয়া বা ইজাকুলেশান ঘটে যাওয়ার ঘটনা নিতান্ত কমসম নয়! তাতেও বড় গোপন লজ্জার গন্ধ ভাসতো, অ্যাডাম ইভের অ্যাপল হোক বা আদম হাওয়ার গন্ধম, সবেতেই যৎপরোনাস্তি নিষিদ্ধঘ্রাণ! অনার্য সুন্দরী শূর্পণখা এই শরীর উদযাপনের আহ্বান জানিয়েই নাক-কান কাটিয়েছেন “বীরচূড়ামণি” লক্ষণের হাতে এবং আসমুদ্রহিমাচলের খিল্লির পাত্রীতে পরিণত হয়েছেন । হ্যাহ্যাহ্যা , দেখ্ কেমন লাগে! বেশি ইয়ে তাই না? যেন কীয়েক্টাপরাধ করে ফেলেছেন তিনি!
সাধকগুরু বলেছেন, দু’একটি সন্তান হবার পর স্বামী স্ত্রী থাকবে ভাইবোনের মতো। অর্থাৎ স্বামী-স্ত্রীর যৌন জীবনযাপনও এখানে ধর্মগুরুর নির্দেশ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত, স্বামী-স্ত্রী কখন কতোটা কাছাকাছি আসবেন এটাও তাঁরা নিজেরা নির্ধারণ করবেন না । ওই সময়ের ভারতবর্ষে কারোর জন্মনিয়ন্ত্রণের চাড় ছিলো না, প্লিজ! আসলে শরীর পাপ, অধম্মো, অসংযম , হ্যাক ছি!! এঁরই অনুগামী বলছেন, “শৃঙ্গাররসের প্লাবনে ভাসিয়ে” পৃথিবীকে একেবারে কলুষিত করে ফেলছেন পৃথিবীর কবি …।
শৃঙ্গার রস এতোই ঘৃণ্য! হায়! সৃষ্টির আদিরসকেই ভিলেনিফাই !! শরীরকে বঞ্চিত করে, তার স্বাভাবিক চাহিদাকে গলা টিপে মেরে, তাকে কষ্ট দিয়ে, কৃচ্ছ দিয়েই এই মূল্যবোধ তাকে তথাকথিত অপার্থিবলোকে উত্তীর্ণ করে! একে উদযাপন করলেই ব্যাভিচার, অনাচার! অমুকব্রত, তমুক পুজো মানেই শরীরের সংযম উপবাস কায়ক্লেশ! শরীরই যতো নষ্টের গোড়া! যা সৃষ্টির আধার, প্রেমের আধার, তাকে মানুষ কী করে যে এতো নিকৃষ্ট পাপ-অপরাধ মনে করে ভিলেনিফাই করে কে জানে! আমাদের উপমহাদেশেই এসব সম্ভব!
আমাদের দুই প্রজন্ম আগে শুনেছি বা বইপত্তরেও পড়েছি, সমাজের অনুশাসন মতে, দিনের বেলায় স্বামী স্ত্রী কথা কওয়া বারণ ছিলো, ওটা নাকি বেহায়াপনা, কথা হবে রাত্তিরে, বন্ধ দরজার ওপাশে! ল্যাও ঠ্যালা! কথা কওয়া মানেই কি শরীরী সম্পর্ক? নাকি শরীরী সম্পর্কের বাইরে আর কিছু নেই সম্পর্কের মধ্যে যে কথাটি কইলেই দোষ! সংসারের হাজারটা দরকার থাকতে পারে, জরুরি পরামর্শ থাকতে পারে, অথচ চেপে রাখতে হবে! যেন পথেঘাটে বাহ্যি পেয়েছে, ছড়ালেই চিত্তির! হিসু, পটি আর সেক্স চেপে চেপে, আমাশা আর অম্বলের মতো অতৃপ্ত চাহিদার চোঁয়া ঢেঁকুর তুলে তুলেই আমরা হেজে হেজে মরলাম!
এই যে শরীরী ছুৎমার্গ, পাপ পাপ করে চেল্লিয়ে মেল্লিয়ে শরীর থেকে দূরে থাকার ভড়ংবাজি, এরই কারণে আমাদের জাতিটি প্রচণ্ড ফ্রাস্ট্রেটেড , যৌনহতাশাগ্রস্ত জাতি। এরা পর্ন দেখে ফ্যান্টাসাইজ করবে, লুকিয়ে অন্যের স্নান দেখবে, কিশোরী স্কুল বালিকার সামনে মাস্টারবেট করবে, শিশু ধর্ষণ করবে, তাদের বিভিন্ন উপায় খুঁজে খুঁজে মলেস্ট করবে, ট্রেন-বাস বা দুগগা পুজোর ভীড়ে মেয়ের বয়সীদের শরীর হাতাবে, মেয়েদের ইনবক্সে দু’ইঞ্চি “পৌরুষের” ছবি পাঠাবে, অপরের শোবার ঘরে উঁকি দেবে, পার্কে ময়দানে প্রেম দেখলে হেতালযষ্টি হাতে তেড়ে যাবে, মেট্রোয় চুমু খেতে দেখলে দল বেঁধে রে রে করে ঝাঁপিয়ে পড়বে, খাপ বসিয়ে প্রেমিকযুগলের মাথা ন্যাড়া করে ঘোল ঢালবে, পছন্দমতো যৌনসঙ্গী বেছে নেয়ার “অপরাধে” গণধর্ষণের নিদান দেবে, গাছে বেঁধে পিটিয়ে মারবে, পাথর ছুঁড়ে বা চাবুক মেরে রক্তাক্ত করে উল্লাসে আকাশ ফাটিয়ে ফেলবে … ! কোনোটাই তো বিচ্ছিন্ন ঘটনা নয়!
কোনো একটি ঘরোয়া অনুষ্ঠানে দুই বয়স্ক মহিলার আলোচনা শুনছিলাম , “অমুকের কীঈঈ খাই রে ভাই (এমন মুখভঙ্গি করছিলেন যেন জঘন্য কোনো অপরাধ করেছেন আলোচ্য মহিলাটি) , পিরিয়ডের মধ্যেও বরটাকে টানতে টানতে নিয়ে গেলো বাড়িতে, কিছুতেই থাকলো না” ! আমার প্রচণ্ড হাসিও পেলো, আবার দুকখুও হলো ভদ্রমহিলার কথা ভেবে, একে তো পিরিয়ড “অপবিত্র” , তার মধ্যে সেক্সের মতো জঘন্য অপরাধ, বেচারি তো ডাবল জিওপার্ডির শিকার হয়ে গেলেন!
পিরিয়ডে সেক্স, আরেকটি ট্যাবু আমাদের মূল্যবোধে, কেউ এতে স্বচ্ছন্দবোধ করলেও অপরে এমনভাবে হ্যাক ছি করবেন যেন বিশাল কোনো ক্রাইম করে ফেলেছে কাপলটি! পিরিয়ডকে ঘৃণ্য অপবিত্র মনে করাটা মানসিক অসুখ ছাড়া কিছুই নয়। কেউ যদি এই রোগ থেকে মুক্ত হোন, তিনি পিরিয়ডে সেক্স করতেই পারেন! ডাক্তাররা যখন এতে শারীরিক ক্ষতি কিছু দেখেন না, তখন আপনি কে হরিদাস পাল? পিরিয়ডের মধ্যে দুজন প্রাপ্তবয়স্ক মানুষ শরীরী মিলনে যাবেন কি যাবেন না সেটি ডিসাইড করে দেবার?
শরীরী মিলন এমনই অপবিত্র বিষয় যা ঘটবার সাথে সাথেই ঈশ্বরের আরাধনার অযোগ্য হয়ে যায় শরীর , সঙ্গমের পরে স্নান করে পবিত্র হবার নিদান দেয়া হয়েছে ধর্মে। ঠিক ঋতু শুরুর মতোই বিষয়টি, অথচ ঋতুচক্রের মতোই একটি স্বাভাবিক ও প্রয়োজনীয় বিষয়।
জীবজগতের সবাই একটা নিয়ম মেনে চলে। কুকুর পুষলে তাকে সময়মতো ব্রিড করাতে হয় । গাই-গরুকে সময়মতো পাল দেওয়াতে ( এই শব্দটা বোধ হয় ট্যাবু , কারোর অনুভূতি আহত হলে মার্জনা করবেন) নিতে হয় ষাঁড়ের কাছে, মালিকরা নিয়ে যান। নইলে এদের মাথা খারাপ হয়ে যায়। তো, মানুষেরও হবে এটাই স্বাভাবিক! হচ্ছেও তাই-ই!

প্রেমের ক্ষেত্রে তো শরীর বিরাট বিশাল ট্যাবু । প্রেমে শরীর থাকলেই সে প্রেম দুনম্বরি! শরীরবিহীন সোগগীয় প্রেমের জয়ধ্বনি সংবলিত নেকুসপুকুস পোস্টার ইত্যাদির জ্বালাতনে নেটজগতে চোখকান পাতা দায়! প্লেটোনিক লভই হলো পবিত্তির, তা ব্যতীত সকলই চিত্তির! শরীর হলো গিয়ে চায়ের ভাঁড় বা শালপাতার থালা, ইউজ হলেই থ্রো করতে হবে! রাস্তায় পেন্টু খুলে দাঁড়িয়ে হিসোলে ইজ্জতের হাইমেন ফাটে না, ফাটে ভালবেসে চুমু খেলে! চিরআবালক জাতির একখান সিনেমা দেখতে গেলেও ফুল-তুলসী হাতে সেন্সরবোর্ডের ধুতির তলা দিয়ে পূণ্যস্নান করে বেরোনো খৎনা করা ভার্শন দেখতে হয়! নৈলে প্রিম্যাচিওরড ইজাক্যুলেশানের প্রভূত সম্ভাবনা! নৈতিক চরিত্তির চুরি করলে, ঘুষ খেলে বা রেপ করলে টাল খায় না , টাল খায় শরীর ভাগ করলে, শরীরের চাহিদার কথা বললে।
এমনিই আমাদের সমাজব্যবস্থায় পুরুষ হোক বা নারী, নিজেদের শরীরের মালিক নিজেরা নয়। সমাজ রাষ্ট্র পরিবার পিতৃতন্ত্র ধর্মশাস্ত্র ইত্যাদি একক ঠিক করে দেয় কে কার সাথে শোবেন, তার ধর্ম পরিচয়, জাতি, গোত্র, লিঙ্গ, বয়স, স্টেটাস ইত্যাদি প্রভৃতি কী হবে!
এই সমাজে দেশে বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠান দিয়ে ঐতিহ্যের নামে নারীর শরীরের অধিকারকে লাগাম পরিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে, অথচ ওই একই ঐতিহ্যের নামে নারীকে দেবদাসী বানিয়ে ধর্মের নামে দিনের পর দিন বহুজনভোগ্যা হতে বাধ্য করা হয়েছে। অর্থাৎ বহুভোগ্যা তুমি নিজে হতে চাইলে তুমি নিকৃষ্ট গণিকা, আর সমাজ, ধর্ম, পিতৃতন্ত্র সেই একই ব্যবস্থা তোমার জন্য নির্দিষ্ট করলে তুমি জনপদকল্যাণী বা দেবদাসী , সম্মানীয়া!
ঘটনাটি তার সাথে একই ঘটছে, শুধু শরীরের, শুধু সিদ্ধান্ত নেবার মালিকের , অধিকারের হেরফেরে বদলে যাচ্ছে সামাজিক অবস্থান !! অহো দ্বিচারিতা !!!
অথচ এই ভারতবর্ষ শরীরী ছুৎমার্গের সংস্কৃতির ধারার বাহক নয়। এই ভারতবর্ষ খাজুরাহো কোণার্কের অজন্তা ইলোরার শরীরে শরীরী উদযাপনের ইতিহাসের বহমান ধারার সাক্ষী। এই ভারতবর্ষ ঋষি বাৎস্যায়নের ঔরসে কামসূত্র নামক মহাগ্রন্থের জননী! চার দেয়ালের বাইরে দুটো চুমু খেলেই অমনি মাম্পি চানাচুরের মতোন ঝুরঝুর করে খুলে পড়বার ঠুনকো সংস্কৃতি ভারতবর্ষের নয়!!
ভারতবর্ষ যেমন জিতেন্দ্রিয় ব্রহ্মচারীর, তেমনি চৌষট্টিকলায় পারদর্শী বসন্তসেনারও। তেমনি বৈষ্ণব পদাবলীর আকুল কবি গীতগোবিন্দসৃজী জয়দেবেরও! বর্ষার জলধারায় বাঁশির সুর শুনে সব বাধা তুচ্ছ করে দয়িতের আলিঙ্গনে সমর্পণপিয়াসিনী শ্রীমতীরও! বসন্তে কোকিলের সুর শুনে মধুদহনে পুড়ে মরে যেতে চাওয়া পদাবলীকীর্তনকার ভানুসিংহেরও …।