‘আমার প্রাণের পরে চলে গেল কে’

Lata apa
লুতফুন নাহার লতা

লুতফুন নাহার লতা (উইমেন চ্যাপ্টার): সময় কি ফিনিক্সের ডানায় ভর করে উড়ে যায়। দেখতে দেখতে দুটি বছর পার হয়ে গেল ! তারেক নেই ,মিশুক নেই, অথচ বয়ে চলেছে সময়। আজ কেনো আবার সেই বেদনার আগস্ট এসে বুকের ভেতর কষ্টের একটা নিদারুণ ঝড় তুলে গেল ! আগস্ট তো বাঙ্গালীর সব হারানোর মাস। এ মাসেই নিভে গেছে বাঙ্গালীর প্রাণের প্রদীপ বঙ্গবন্ধু সপরিবারে, আর এই তো সেদিনের কথা এই মাসেই হারিয়ে গেল তারেক, মিশুক, সেই সাথে আরও কতগুলো সরল কাজ পাগল মানুষ।

আমি ওদের ঘনিষ্ট বন্ধু ছিলাম না, কিন্তু যারা ছিলেন তাদের বেদনায় আঁধার করে আসে সব। আর আমার সাথে ওদের সম্পর্কহীন সম্পর্ক তো একটা ছিলই। জগতে কিছু মানুষ আছে যাদের সাথে প্রতিদিন দেখা না হলেও, কথা না হলেও, কিম্বা খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধুত্ব না হলেও মনে হয় আপনজন। যেন যুগ যুগ ধরে আত্মা গোপনে গোপনে তাদের আত্মীয় বানিয়েছে । মূলতঃ আদর্শ ও বিশ্বাসের একতা আর দেশপ্রেম মানুষকে যত শক্ত বাধনে বাঁধতে পারে, আর কিছুই বোধ হয় তা পারেনা । পৃথিবীতে খুব কম বাঁধন আছে যা এত শক্ত হয় । দেশপ্রেম মায়ের বাঁধনকেও হার মানায় । তেমনি এক অলিখিত বাঁধন তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনিরের সাথে আমার !

তারেক মাসুদ আর মিশুক মুনির । ওদের আদর্শ আর বিশ্বাস ওদেরকে গেঁথেছিল এক সুতোয় । একসাথে ওরা পথ চলেছে, এক মতে ওরা কাজ করেছে, এক আদর্শ ও নীতি নিয়ে হাতে হাত রেখে জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত ওরা একসাথে থেকেছে । দুজনেই একটি বিশাল পরিবর্তন এনেছে স্ব স্ব কাজে । এই দুটি মানুষ শেষ দিন পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতা আর তার গৌরবময় মুক্তিযুদ্ধের উপরে কাজ করে গেছে নিরলসভাবে । তাদের জীবনের এত অল্প সময়ে , তাদের কাজ এত গভীরভাবে নাড়া দিয়ে গেল বাংলা ও বাঙ্গালীর ইতিহাস ও সংস্কৃতিকে, তা কেমন করে ভুলবে এ দেশের মানুষ।

প্রতি বছরের মতই গরমের দুই মাসের ছুটিতে, মাটির প্রতি নাড়ি ছেঁড়া টানে আমি তখন দেশে। সেদিন ভোরে ঘুম ভেঙ্গে গেলে উঠে দেখি আকাশের মুখ ভার । গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি পড়ছে বাইরে । জানালা দিয়ে চেয়ে দেখি ধানমন্ডি সাতাশ নাম্বার এর মোড় ছ্যাগ ভ্যাগ করছে কাঁদা পানিতে। স্যাঁতস্যাঁতে ভেজা বাতাস এসে গায়ে লেগে আবার ঘুমের আমেজ এনে দিলো। আপদমস্তক কাঁথা মুড়ে আবার ঘুমিয়ে গেলাম । যখন জেগে উঠলাম তখন বেশ বেলা হয়েছে, হঠাৎ টিভি খুলতেই ভয়াবহ সংবাদ ! মিডিয়াগুলো মানিকগঞ্জ থেকে এইমাত্র খবর পেয়েছে একটি ভয়ঙ্কর সড়ক দুর্ঘটনার । যে দুর্ঘটনায় তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনিরসহ আরো অনেকে জড়িত। বাকি খবরের জন্য তারা অপেক্ষা করছে । বুকের ভেতর ধক করে উঠলো, সেকি ! জানি না কখন নিজের অজান্তেই ওদের মঙ্গল কামনায় প্রার্থনা বেজে উঠল অন্তরে ।

সেদিন খুব ভোরে তারেকের নতুন ছবি ‘কাগজের ফুল’ এর স্যুটিং এর জন্য মানিকগঞ্জের ঘিওরে লোকেশন দেখতে মিশুক মুনির, ক্যাথরিন মাসুদ, তারেক মাসুদ , চিত্রশিল্পী মামুন ও তার স্ত্রী জলি , প্রডাকশান ম্যানেজারসহ আরো বেশ কয়েকজন, একটি মাইক্রোবাস ভরে প্রায় এই আট নয় জনের গ্রুপ গিয়েছিল মানিকগঞ্জে । ঘিওরে লোকেশন দেখে ওরা মানিকগঞ্জ সদরের দিকে যাবার সময় , রাস্তার বাঁকে এসে ওদের মাইক্রোবাস যখন মোড় ঘুরতে যাবে, ঠিক তখুনি আচমকা একটি দ্রুতগামী যাত্রীবাহী বাস ওদেরকে চাপা দিয়ে চলে যায়। তারেক, মিশুক , গাড়ীর ড্রাইভার, তারেকের প্রোডাকশান ম্যানেজার,ও মাটির ঘর তৈরী করতে পারে এমন একজন ঘরামী এই পাঁচজন একসাথে, মূহূর্তেই চলে গেল পৃথিবী ছেড়ে । প্রচণ্ডভাবে আহত হল শিল্পী মামুন , আর ক্যাথরিন মাসুদ। ওদের গাড়ীটা দুমড়ে মুচড়ে একটা দলা পাকান খেলনা গাড়ীর মত হয়ে গেল । ঐ গাড়ীর চেহারাই বলে দিল এক্সিডেন্টের ভয়াবহতা ।

টিভিতে সারা দিন এই সব দেখছি ! চোখের জলে ভেসে যাচ্ছে মুখ । আকাশ থেকে নেমে আসা বেদনা মথিত একটু একটু নির্যাসের মত গুড়ি গুড়ি বৃষ্টিতে ভেসে যাচ্ছে ঢাকা। আমি জানালা দিয়ে আনমনা চেয়ে আছি ধানমন্ডি সাতাশের দিকে, আমার চোখে ভাসছে নানান স্মৃতির খণ্ডচিত্র। খুলনা থেকে আমার ঢাকায় আসা ! বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গমগমে অনুষ্ঠান, সেখানে তারেক মাসুদ , আহমদ ছফা , বাংলা একাডেমীর বই মেলা, মিশুক, মঞ্জুলি, আমার বন্ধু নোটন , চারুকলা থেকে বেরুনো চিত্রল শোভাযাত্রা ! টিএসসিতে গোল হয়ে বসে বৃন্দ কবিতা আবৃত্তির অনুশীলন, এই তো সেদিনের কথা ।

১৯৮০ সালের দিকে সম্ভবত, খুলনা থেকে জয়ন্ত চট্টোপাধ্যায়, মৈত্রেয়ী চট্টোপাধ্যায় আর আমি বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে আমন্ত্রণে কবি বুদ্ধদেব বসু’র কাব্যনাট্য ‘ তপস্বী ও তরঙ্গিণী ‘ নিয়ে বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের মঞ্চে একটি অনুষ্ঠান করতে ঢাকায় আসি । সেই অনুষ্ঠানে ঢাকার সকল গুনীজনেরা উপস্থিত ছিলেন , অনুষ্ঠানের শেষে পরিচয় হল সাহিত্যিক আহমেদ ছফা আর তার খুব ঘনিষ্ঠজন তারেক মাসুদের সঙ্গে। তারেকের দিকে চেয়ে মনে হল আমার ভাই মানিকের চেহারার সাথে এর অনেক মিল ! অবাক হলাম! ছফা ভাইয়ের আমন্ত্রণে পরদিন তার বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের গলির বাসায় গেলাম আমরা তিনজন । উনি যে বাড়ীতে থাকতেন তা ছিল বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের পাশেই। সেখানে আবারো তারেকের সাথে দেখা হল। তারেক সে সময় ছফা ভাইয়ের সাথেই থাকতেন। মেধা প্রজ্ঞা আর কর্মনিষ্ঠায় উজ্জ্বল একটি মুখ । ছফা ভাইয়ের সাথে তার গভীর সম্পর্ক আর তার সুন্দর ব্যবহার এক ধরনের মুগ্ধতা বিস্তার করার মতই।

আমি বিশ্ববিদ্যালয়ে সবে ক্লাস শুরু করেছি । যা দেখি সব রঙিন ! আমি মুগ্ধ হয়েছিলাম তাকে দেখে তার সাথে কথা বলে। এর পরে আমি পড়াশুনা শেষ করে ঢাকায় এসে নিয়মিত নাটক করছি নাগরিকের মঞ্চে, বাংলাদেশ টেলিভিশনে ।

সময় গড়িয়ে গেছে অনেক, তারেক ১৯৮২ তে বিখ্যাত চিত্রশিল্পী এস এম সুলতানের জীবনের উপরে ‘আদমসুরত’ নির্মাণের পর, তার ‘মুক্তির গান’ এর ভেতর দিয়ে সারা বাংলাদেশের সামনে একটি রক্তাক্ত অতীতকে নাড়া দিয়ে সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের প্রায় ২৫ বছর পরে নিউইয়র্কের এক বেসমেন্ট থেকে তারেকের উদ্ধারকৃত, অকুতোভয় সাংবাদিক লেয়ার লেভিন এর ১৯৭১ এর মুক্তিযুদ্ধকালীন ধারণকৃত সেই ডকুমেন্টারি ভিডিও থেকে এডিট করে তৈরি করা মুক্তিযুদ্ধের প্রামাণ্য দলিল ‘মুক্তির গান’। এর পরে তারেক কাজ করে গেছেন নিরলস । মাটির ময়না, অন্তর্যাত্রা , রানওয়ে ‘মুক্তির কথা’ ‘নরসুন্দর’ ছাড়াও অসংখ্য শর্ট ফিল্ম, ডকুমেন্টারি , এনিমেশন তৈরি করেন । তাঁর অসাধারণ নির্মান তাকে এনে দেয় আন্তর্জাতিক খ্যাতি। তিনি বাংলাদেশ চলচ্চিত্র আন্দোলনের ও শর্ট ফিল্ম ফোরামের উদ্যোক্তা ও সদস্য ছিলেন সারা জীবন।

তারেকের স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদ ছিলেন তার জীবনের সকল কাজে প্রেরণার উৎস । এই এক অসাধারণ নারী। এই দেশকে ভালবেসে তার নিজের দেশ, ভাষা, সংস্কৃতি, মা-বাবা সব, সব কিছু ছেড়েছেন অনায়াসে। আর কেবল তারেককে ভালবেসে এ দেশের মাটিতে রেখেছেন তার প্রণাম। তারেকের সকল কাজে এই মহীয়সী নারীর অবদান অঙ্গে অঙ্গে জড়িয়ে আছে। জীবনের শেষ দিনেও তারেককে তিনি একা ছাড়েননি, ছিলেন ওর সাথে ওর চির বন্ধু হয়ে ! বোধ করি ওদের একমাত্র সন্তানের জন্যই তিনি বেঁচে রইলেন তারেককে ছেড়ে। সারা বাংলাদেশের আপামর জনগণের কাছে এই নারী এক অনন্য সাধারণ নারী হিসেবে সম্মান পেয়েছেন।

দেশে তারেক মাসুদ যখন একের পর এক ভাল ভাল কাজ করছেন তখন, একজন নাট্যশিল্পী হিসেবে তার সাথে কাজ করার ইচ্ছে আমাকেও প্রলুব্ধ করেছে, কিন্তু কেন জানি না তারেকের সাথে সেই নৈকট্য আর ঘটেনি কখনো । বিশেষ করে ১৯৯৬ এর পরে আমি দেশ ছাড়ায় আর তা হয়ে ওঠেনি ।

‘মাটির ময়না’ নিয়ে তারেক এসেছিল নিউইয়র্কে । তার আন্তর্জাতিক পুরস্কার পাওয়া অসাধারণ এই ছবি দেখে মুগ্ধ দর্শক তাকে জড়িয়ে ধরে বুকে। দর্শক অবাক হয়ে দেখে কেমন করে সে সাধারণ মানুষের জীবনের সুখ-দুঃখকে এতো গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছে আর সেখান থেকে একটি বেদনার গাঁথা তুলে এনে দিয়েছেন মানুষের কাছে। তারেকের সব ছবিতেই রয়েছে একটি ঐতিহাসিক পটভূমিকা, একটি সময়ের আর্তনাদ, যা মানুষের হৃদয়কে মথিত করে । তারেকের এই অকালে ঝরে যাওয়া মেনে নেয়া সহজ নয়। কত স্বপ্ন ছিল , কত নতুন কাজের পরিকল্পনা ছিল তার মাথায় , কত কিছুই সে করতে চেয়েছিল!

আশফাক মুনির মিশুক। ১৯৭১ এ পাকিস্তানের দোসর রাজাকার আলবদরদের হাতে নির্মম ভাবে নিহত পিতা শহীদ বুদ্ধিজীবী মুনির চৌধুরীর আদর্শ সন্তান। একটি শিল্পসাহিত্যের পরিমণ্ডলেই তাঁর বেড়ে ওঠা। চাচা কবির চৌধুরী , ফুপু ফেরদৌসী মজুমদার, রামেন্দু মজুমদার, ত্রপা মজুমদার যার পরিবারের সদস্য । স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে বুকে আদর্শ ও দেশের জন্য প্রত্যয় নিয়ে প্রজন্ম ৭১ এর সন্তানদের মধ্যে বেড়ে ওঠা শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজন মিশুক মুনির । তিনি ছিলেন একাধারে একজন চিত্রগ্রাহক, ব্রডকাস্ট জার্নালিস্ট, কাজ করেছেন ভিডিওগ্রাফি ও ভিডিও কমিউনিকেশন নিয়ে । ক্যামেরা ছিল তার প্রেম। বাংলাদেশে একুশে টিভি যখন শুরু হয়, সে সময় সায়মন ড্রিং এর আমন্ত্রণে এক অনবদ্য কর্মযজ্ঞের সাথে যুক্ত থাকেন হেড অব অপারেশন্স হিসেবে ১৯৯৯ থেকে ২০০২ সাল পর্যন্ত। এ ছাড়াও মিশুক ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একজন শিক্ষক। একুশে টিভি বন্ধ হয়ে যাবার পর কানাডা থেকে গ্লোবাল মিডিয়ার উপরে কাজ করার একটি ভাল সুযোগ পেয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চাকরি ছেড়ে দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের বাসভবন ছেড়ে, মা লিলি চৌধুরীকে বনানীর বাড়ীতে রেখে, কানাডায় চলে আসেন সপরিবারে ।

কাজ করেন ফ্রিল্যান্স ফটোগ্রাফার হিসেবে বিবিসিতে এছাড়াও ডব্লিউটিএন, এ আর ডি ওয়ান , চ্যানেল ফোর, সিবিসি সহ আরো অনেক মিডিয়াতে। তারপর আবারও তার দেশে ফেরা। এটিএন নিউজে জয়েন করেন বিভাগের সিইও হিসেবেই শুধু নয়, খুব অল্প সময়েই তার হাতে গড়ে ওঠে মিডিয়া সাংবাদিকতার এক নতুন দিগন্ত। তারেক মাসুদের চলচ্চিত্র রানওয়ের চীফ সিনেমাটোগ্রাফার ছিলেন তিনি। এছাড়াও তারেক মাসুদের অসংখ্য ছবির সাথে জড়িত থেকেছেন, নির্মিতব্য কাগজের ফুল ছবিতেও প্রধান চিত্রগ্রাহক হিসেবে কাজ করার কথা ছিল তার।

মিশুকের স্ত্রী মঞ্জুলি আর পুত্র সুহৃদ রয়ে গেল কানাডাতেই । আগস্টের গরমের ছুটিতে ছেলেকে নিয়ে মঞ্জুলিও ছুটল দেশে মিশুকের কাছে। দেশে গিয়ে কিছুদিন পরে ছেলে সুহৃদ অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাকে এপোলো হাসপাতালে ভর্তি করা হল। জীবনের শেষ রাতটিও এপোলো হাসপাতালে ছেলে সুহৃদের কাছেই ছিলো মিশুক। ক’দিন ধরেই দিনে মঞ্জুলি আর সারা দিনের কাজের শেষে মিশুক, এভাবে পালা করে ওরা দুজনে একমাত্র ছেলেকে সুস্থ করে তোলার চেষ্টা করতে লাগল। সে রাতে মিশুক হাসপাতালে যাবার সময় পরদিন সকালে ছেলেকে হাসপাতাল থেকে রিলিজ করে আনার জন্য টাকা দিয়ে মঞ্জুলিকে বলে যায় সকালে তাড়াতাড়ি হাসপাতালে যেতে, কারণ ভোরবেলাতেই তাকে যেতে হবে, তার কাজ আছে। বাড়ীর গেট পর্যন্ত গিয়ে আচমকা দমকা বাতাসের মত তাঁর জন্ম জন্মান্তরের বন্ধু মঞ্জুলিকে জড়িয়ে ধরে বলে “খুব ভালোবাসিরে তোকে !” সেই শেষ দেখা ! মঞ্জুলির কাছে সেই-ই তার চির অমলিন শেষ স্মৃতি !

ইতোমধ্যেই টিভিতে সব খবর এলো। তারা মুহুর্মুহু এই ভয়াবহ মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনার সংবাদ পরিবেশন করতে লাগল। জাতি স্তব্ধ হয়ে রইলো এই অকল্পনীয় ক্ষতিতে। তারা অপেক্ষমান রইল তারেক- মিশুকের ঢাকায় ফিরে আসার জন্য । রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমান, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা , বিরোধী দলীয় নেতা খালেদা জিয়া তাদের শোক বাণী জানালেন।

সারা দিনের ক্লান্তিহীন থেমে থেমে ঘ্যান ঘেনে বৃষ্টি অব্যাহত রইল। ওরা কখন এসে পৌঁছাবে, সে অপেক্ষায় রইলাম আমিও । সন্ধ্যায় গুলশান এ পূর্বনির্ধারিত একটি মিটিং ছিল অটিস্টিক বাচ্চাদের জন্য একটি স্কুল শুরু করার উদ্দেশে। অনেকের মধ্যে আমার সাথে ছিলেন প্রজ্ঞা লাবনী ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক রূপা । আমার বন্ধু আলী মোরশেদ নোটন মিশুক মঞ্জুলির দীর্ঘকালের বন্ধু। সে আমাকে ফোন করে জানাল, ‘ তুই এখুনি আয় , মিশুককে বাড়ীতে আনা হচ্ছে , নোটনের এই ফোন পেয়ে ছুটে গেলাম বনানীতে মিশুকদের বাড়ীতে। মা’কে দেখে এ বাড়ী থেকে চলে গেছে মিশুক, তার সাথে দেখা হল না । গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আমাকে দেখে বেদনার্ত দু’হাত বাড়িয়ে দিলেন মঞ্জুলির দুলাভাই পরিচালক চাষী নজরুল । লেখক, কবি, শিল্পী, সাহিত্যিক, শিক্ষাবিদ, সাংবাদিক , মন্ত্রী , আমলা , নাট্যকর্মী , বন্ধু বান্ধব, এ টি এন এর সহকর্মী এখন এ বাড়ী ভর্তি । বাড়ীর সামনে অনেকগুলো মিডিয়ার গাড়ী । মিডিয়া কর্মীদের কাঁধে ক্যামেরা । সবার মুখ থমথমে । সবাই বাকরুদ্ধ। এর মধ্যে মিশুক মুনিরের মা লিলি চৌধুরী ও তার স্ত্রী মঞ্জুলী’র সাথে দেখা করে গেলেন বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী দীপুমনি।

আমি আর প্রজ্ঞা আপা আস্তে আস্তে গিয়ে দাঁড়ালাম ভিতরে লিলি চৌধুরীর বেডরুমে । আমার বুকের ভেতর হাতুড়ির ঘা পড়ছে যেন । এমন ঢিপ ঢিপ করছে যে কারো কোন কথা আমি শুনতেও পাচ্ছি না । আমার সামনে সেই মহীয়সী নারী ! লিলি চৌধুরী । এই স্বাধীন দেশের জন্য যিনি স্বামীকে উৎসর্গ করেছেন। এক মুক্তিযুদ্ধ শেষ করেছেন, আর এই চল্লিশ বছর ধরে জীবনের মুক্তিযুদ্ধ যার আজও শেষ হয়নি ! এ যুদ্ধ তার কবে থামবে ! স্তব্ধ পাষাণ মূর্তির মতো বসে আছেন বিছানার পাশের চেয়ারে । তাকে দেখে আমার বুক ভেঙ্গে গুড়িয়ে যাচ্ছে । খাটের কোনায় বসে আছেন আসমা আব্বাসি আর সামিরা আব্বাসি । লিলি খালাম্মা আমাকে চিনতে পেরেছেন বলে মনে হল না, তবু আমার দিকে উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি মেলে জিজ্ঞেস করলেন, ‘নিয়ে গেছে? আমাকে তো মুখটা দেখতে দিলো না’ – তারপর বিড় বিড় করে কি বললেন, বোঝা গেল না । বেশ কিছুক্ষণ পরে আমার আর প্রজ্ঞা আপার হাত ধরে ধরে এসে বসলেন সামনের বসার ঘরে, যেখানে মঞ্জুলী বসে আছে সাদা কাগজের মত বাকহীন সেইখানে। মঞ্জুলীকে দুই হাতে বুকের সাথে জড়িয়ে ধরলাম, কিছু বলার শক্তি সঞ্চয় করতে পারলাম না । এইমাত্র মিশুক এসেছিল আবার সে চলেও গেছে। বনানী মসজিদে তার নামাজে জানাজা হচ্ছে।

ও বাড়ী থেকে বেরিয়ে মসজিদের সামনে এসে গাড়ী থামাতে বললাম। মিশুক বেরিয়েছে মসজিদ থেকে, তাকে সবাই মিলে নিয়ে চলেছে তার জন্য আনা বিশেষ শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত গাড়ীতে । তার কর্মস্থল হয়ে বন্ধুদের সাথে দেখা করে সে যাবে। আজ রাতে সে থাকবে তারেকের সাথে, দুই বন্ধু মিলে পিজি হাসপাতালের নীরব কক্ষে ।

বনানীর এই রাস্তা, এই সব বাড়ী, এই মসজিদ, সাত নাম্বারের কোনায় সুবর্না মোস্তফাদের বাড়ী। আমার কত চেনা। চেয়ারম্যান বাড়ী মসজিদের সামনে ১১৭ নাম্বার বাড়ীতে আমেরিকা যাবার আগ পর্যন্ত আমার জীবনের একটি দীর্ঘ সময় কেটেছে। ওই চেয়ারম্যান বাড়ীর পথ, ওই সাদা বড় গেট । গেটে দাঁড়ানো গফুর ভাই। আজ আমার সব স্মৃতিকে আচ্ছন্ন করে দিল তারেক, মিশুকের চলে যাওয়া।

থমথমে অন্ধকার রাত কেটে গেল, মনের ব্যাথার ভার গেল না । শোকাহত মানুষের সকাল হল বুকের পাষাণ ভার নামল না । সকালের আলো ফুটতেই মানুষের ঢল নামলো শহীদ মিনারে। তিল ঠাঁই নেই সেখানে। বড় শামিয়ানা টাঙিয়ে ওদের দুজনকে ফুলে ফুলে সাজিয়ে দেয়া হল সবার জন্য। বাংলাদেশের সকল শ্রেণীর মানুষ ছুটে এল শেষবারের মত ওদের কাছে এসে দাঁড়ানোর জন্য। শেষ ভালবাসা জানাতে, শ্রদ্ধা জানাতে। একযোগে সব কটি টিভি চ্যানেল সরাসরি সম্প্রচার করল ওদের এই শেষ বিদায় উৎসব।

রামেন্দু মজুমদার, হাসান ইমাম , নাসিরুদ্দিন ইউসুফ, তানভির মোকাম্মেল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বৃন্দ, সকল নাট্য কর্মী, সকল প্রগতিশীল সংগঠনের কর্মীরা, সবাই কেমন যেন অসাড় মৌনতায় ভর করে দাঁড়িয়ে আছে। কথা হচ্ছে এখানে ওখানে টুকরো টুকরো যারা এখন হাসপাতালে আছে তাদের নিয়ে। ক্যাথরিন মাসুদ হাসপাতালে, তার মাথা থেকে প্রচুর রক্তক্ষরণ হচ্ছে। শিল্পী মামুনের অবস্থা খুব একটা ভাল নয়, তাকে সিঙ্গাপুরে বা অন্য কোথাও নেয়া যায় কিনা তা নিয়েও কথাবার্তা চলছে।

যারা এসেছে শহীদ মিনারে তারা কান্না সংবরণ করে নত মুখে হাতে ফুল নিয়ে ধীরে ধীরে সবাই এগিয়ে যাচ্ছে ওদের কাছে।

দুটি কফিন লম্বালম্বি করে রাখা হয়েছে। বুঝতে পারছি না কোনটা কার। আমি সামনে এসে তারেককে খুঁজছি। কফিনের ওপাশে দাঁড়ানো, মঞ্জুলি, তার দুপাশে কত যে মানুষ ! চোখের জলে চোখ ভেসে যাচ্ছে সব কিছু ভাল করে দেখতে পারছি না। আমি জিজ্ঞাসা করলে ওপাশে দাঁড়ান সৈয়দ শামসুল হক দেখিয়ে দিলেন তারেক কোনটায়।

আমি একটি কথা ওকে বলতে চেয়েছিলাম ১৯৮০ সালে, যখন ওকে প্রথম দেখি। কিন্তু সেই তরুণ বয়সের রক্তিম সলাজ আবরণ, আর সে কথা আমাকে বলতে দেয়নি, আর তারপরে তো জীবনের নিয়মে কেটে গেছে জীবন, সে কথা আর মনেও পড়েনি কোনদিন। আজ এই অদ্ভুত সময়ে সেই কথাটিই মনে পড়ল সবার আগে। আমি যখন বলতে চাইলাম ওর কফিনের কাছে মুখ নিয়ে, আমার কণ্ঠ রোধ করে দিল চোখের জল। কফিনের উপরে অজস্র ফুলের গন্ধ, আর মাথার উপরে নীরব অনন্ত নীলাকাশ জুড়ে বেজে উঠল, ‘আমার একটি কথা বাঁশী জানে বাঁশীই জানে…’।

আর কোনদিন এই দুই প্রিয়মুখ দেখতে পাব না, সে বেদনার চেয়ে বড় হল, ওদের এই অসময়ে চলে যাওয়ায় যে ক্ষতি হয়ে গেল। তা কি পূরণ হবে কোনদিন ! ওদের কাছ থেকে কত কিছু পেতে পারতো এই দেশ। ওদের দেবার মতো মেধা ও ক্ষমতা ছিল। একটি সামাজিক পরিবর্তনের জন্য প্রয়োজনীয় বিপ্লব ছিল ওদের চেতনায়। ওদের কর্মকাণ্ডের ভেতর দিয়ে ওরা যা করতে চেয়েছিল। মুক্তিযুদ্ধকে ওরা কী গভীরভাবে লালন করেছিল হৃদয়ে আর তারেক মিশুকের দুটি হাত হয়ে উঠেছিল দুটি পতাকার সমান ঋদ্ধ । পরে জেনেছি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত স্পেশ্যাল ট্রাইবুনালের কাছে ১৯৭১ এর গণহত্যার তারা দু ‘জনেই ছিলেন মূল্যবান দুজন সাক্ষী। ১৯৭১ এর সেই কালো রাতে মিশুক নিজের চোখে দেখেছে তার বাবাকে কারা ধরে নিয়ে যাচ্ছে। তারেক মাসুদ তার মুক্তির গান নিয়ে বাংলাদেশের ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইল এলাকা জুড়ে ক্লান্তিহীন ঘুরে বেড়িয়েছেন আর সংগ্রহ করেছেন মুক্তিযুদ্ধের হাজারো তথ্য , নির্যাতিত মানুষের স্বকন্ঠে ‘মুক্তির কথা ‘। ওরা দুজনেই ছিলেন স্পেশ্যাল ট্রাইবুনাল ফর ওয়ার ক্রিমিনালস এর অডিও ভিজ্যুয়াল টিমের উপদেষ্টা । জানিনা কত যোজন মাইল পথ পেরুলে আবার একজন তারেকের বা মিশুকের জন্ম হবে তবে এই ক্ষতি দেশ কে ফেলে দিয়ে গেল এক অপার শূন্যতার মধ্যে।

বেলা বাড়তে থাকলো ,মানুষের ঢল নামছে আরো আরো বেশি ! ফুলে ফুলে ছেয়ে যাচ্ছে চারিপাশ। হাজার হাজার শোকাহত মানুষের ঢল বয়ে একসময় ওদেরকে নিয়ে যাওয়া হল । পেছনে পড়ে থাকা শূন্য শহীদ মিনারের লাল চত্বর ক্লান্ত পায়ে পার হয়ে এসে রিকশায় উঠব, এমন সময় পিছন থেকে ডাক দিলেন বাবলি আপা। তারেকের কাজিন। অনেকক্ষণ বাবলি আপার হাত ধরে দাঁড়িয়ে রইলাম। তার শ্যামলা মুখের উপর দিয়ে জল গড়িয়ে পড়ছে। আমি যেন দেখছি আমার সামনে একখানি মুর্তিমান শ্যামল বাংলাদেশ! তার দুচোখ বেয়ে বঙ্গোপসাগরের নোনা জল গড়িয়ে নামছে আর ঘুর্ণায়মান দমকা বাতাস এসে জড়িয়ে ধরছে এই প্রকৃতি । সারা আকাশ পরিব্যাপ্ত করে দূরে কোথাও অনন্তের বাঁশী বেজে চলেছে …… আমার মনে হল এ যাওয়া তো যাওয়া নয় এ যেনো আরো দূর্বার ফিরে আসা !!!

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.