ঈহিতা জলিল:
প্রতিটা মানুষের-ই অনেক রূপ থাকে। একেকটা সম্পর্কে সে একেক রকম। নারীকূলও এর ব্যতিক্রম নয়। আজকে আমি নারীর তেমন-ই এক রূপের কথা বলবো।
নারী যখন স্বামীর বোন:
“বন্ধু পরবাসী
পরের ঘরে আসি
এতো ঘুমে ক্যানে ধরে
কোয়েলা করে ধ্বনি
পোহাইলো রজনী
না ডাকি ননদীরো ডরে”।

স্বামীর বোন সম্পর্কটি আমাদের সমাজে ননদ/ননাস নামে পরিচিত। লোক কথায় যাকে পেঁয়াজের সাথে তুলনা করা হয়। পেঁয়াজ কাটতে গেলে যেমন চোখের পানি পড়ে, তেমনি শ্বশুর বাড়ি যাবার পর নতুন বউটিকে নাকানি-চুবানি খাওয়াতে ননদের জুড়ি মেলা ভার। অধিকাংশ কেস স্টাডি করলে দেখা যায়, নতুন বউটির বিরুদ্ধে শ্বাশুড়ির কান ভারী করতে সবচাইতে বেশি ও জোরালো ভূমিকাটি রাখেন বাড়ির মেয়েটি। আসুন জেনে নেই কেনো এবং কোন পরিস্থিতিতে সাধারণত এমন ঘটনাগুলো ঘটে।
সংবিধিবদ্ধ সতর্কীকরণ বিজ্ঞপ্তি: আমি সবার কথা বলছি না। কিছু কিছু নারীর কথা বলছি।
নতুন বউটি যখন শ্বশুর বাড়িতে আসেন তখন তাঁর সবকিছু নিয়ে সবার ভীষণ রকম আগ্রহ থাকে। সে থাকে সবার আগ্রহের কেন্দ্রবিন্দুতে। যা এতোদিন ছিলো বাড়ির সবচেয়ে ছোট সদস্য এবং ছোট মেয়েটির উপর। এখান থেকে শুরু হয় মেয়েটির ইনফিরিওরিটি কমপ্লেক্স। সে ভাবতে থাকে তাঁকে পরিবারের কেউ আর গুরুত্ব দিচ্ছে না, ভালোবাসছে না। এ ধরনের সম্পর্কগুলো বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খুব একটা ভোগায় না। দেখা যায় একটা সময় পরে সেই ননদটিই হয়ে যায় ভাবীর ছায়াসঙ্গী। সেটি নির্ভর করে পরিবারের সদস্য ও নতুন বউটির ব্যবহারের উপর।
কিন্তু বিয়ের পরও যে মেয়েটি বাবার বাড়িতে থেকে যায়, সে ভীষণ রকম ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে বেশিরভাগ ঘটনায়। কারণ সে মনে করে, এখন তো বাড়িতে বউ চলে আসছে, তাঁর এই বাড়িতে থেকে যাওয়া কঠিন হবে। যে সমস্ত নারী বিশেষ প্রয়োজনে বাবার বাড়িতে থাকেন, যেমন: স্বামী দেশের বাইরে থাকেন, নিজের চাকরিস্থল বাবার বাড়ির কাছে, মায়ের কাছে সন্তান রাখার জন্য, ইত্যাদি কারণে তারা সাধারণত খুব একটা ঝামেলা করেন না। কারণ দিনশেষে তার একটা টার্গেট থাকে যে সে একদিন তার নিজের সংসারে ফিরে যাবে।
এটা হতে পারে শ্বশুর বাড়ি, হতে পারে নিজের একার সংসার, যেটাই হোক।
কিন্তু যে নারীটির স্বামীর সাথে সম্পর্ক কোন কারণে ভঙ্গুর অবস্থায় আছে, তার ভিতরের কমপ্লেক্স তাকে দিয়ে এমন অনেক কাজ করায় যখন ভাইটির সংসারে অশান্তির সূত্রপাত হয়। এমনকি কিছু ক্ষেত্রে সম্পর্কটি ডিভোর্সে গড়ায়।
কখনও ভাইটি তার স্ত্রী-সন্তান নিয়ে আলাদা বসবাস করতে বাধ্য হোন, অথচ ভাই এবং ভাইয়ের বউ উভয়েরই পূর্ণ ইচ্ছা থাকে বাবা-মাকে সাথে নিয়ে থাকার। কিন্তু বাবা-মা মেয়ের কথা চিন্তা করে যেহেতু মেয়ের স্বামীর সাথে সম্পর্ক ভালো না, তাই ছেলেকেই আলাদা হয়ে যেতে বলেন। এই পরিস্থিতিতে দুটি বিষয় হয়, এক, যেমন সমাজের অতি উৎসাহী জনতা এক লাইনে সিদ্ধান্ত দিয়ে দেন। ছেলে-ছেলের বউ খারাপ। দুই, ছেলেটিকে নিজের স্ত্রী-সন্তান ও মা-বাবা দুই পক্ষের দায়িত্ব পালন করতে যথেষ্ট সমস্যায় পড়েন। এসব ক্ষেত্রে ননদিনী/ননাস যাই বলি না কেনো, যেহেতু তার নিজের ঘর হয়নি, তাই সে অন্যের ঘরের মাহাত্ম্য বুঝতে পারেন না।
উপরে যে দুই ধরনের চরিত্রের কথা বললাম, এদের প্রতি আমার কিছু-টা সহানুভূতি আছে। কারণ যেমন-ই হোক এরা নিজেরাও পীড়িত। কিন্তু আরেকটি শ্রেণী আছে যার সম্পর্কে আমার কোন ধরনের সহানুভূতি নেই। এরা হলেন স্বামীর সংসারে আপাতদৃষ্টিতে সুখী-স্বচ্ছল এবং নিজেরাও কর্মজীবী। সমাজের বিভিন্ন পেশায় তারা নিয়োজিত। এরা যেটি করে নিজের বাড়ি থেকে বাবার বাড়ির কলকাঠি নাড়ে। এবং প্রায়শই বাবার বাড়ি যায় এবং ভাইয়ের বউ কতোটা অযোগ্য তার লিস্ট তৈরি করে। তারা এখনও বিশ্বাস করেন, সমাজে মেয়ের পরিবারের চেয়ে ছেলের পরিবারের স্থান উপরে। আর ভাইয়ের বউটি পৃথিবীর সবচেয়ে খারাপ এবং অযোগ্য মানুষ। আর যদি কোনক্রমে বউটির পরিবার অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল হোন, তাহলে তো সোনায় সোহাগা!! তাদের যত সম্পদ-ই থাক না কেনো, তারা বাবার বাড়ির সম্পত্তিতে এক চুল পরিমাণ ছাড় দিতেও রাজী নন। ভাইয়ের সম্পদ যত কম-ই থাক না কেনো!! তাদের একি অঙ্গে অনেক রূপের মতো একি মুখে বিভিন্ন কথা!
যখন সম্পত্তিতে সমান অধিকারের প্রশ্ন, তখন তারা নারীর অধিকারের অগ্রদূত। আর যখন ভাইয়ের বউকে কথা শুনানোর প্রশ্ন, তখন ভায়ের বউ কেনো বাবার বাড়িতে কিছু পাঠাবে! হোক সেটি তুচ্ছ কোন খাবার! তখন তাদের নারী অধিকারের বাণী অনেকটা বিচারের বাণী নিরবে কাঁদার মতো হয়ে যায়।
আমি মাঝে মাঝে ভাবি এই যে এই নারীকূল এরা সমাজে আসলে কী মেসেজ দিচ্ছে!!! যে সময়টায় দাঁড়িয়ে আমরা প্রতিটা পদে পদে আমাদের অধিকারের জন্য প্রচণ্ড লড়াই করে যাচ্ছি, তখন কেনো আমাদের-ই স্বজাতির এই দ্বৈত ভূমিকা!
পুরুষতন্ত্রের বিরুদ্ধে লড়াই করতে যেয়ে আমি দেখলাম আমরা নারীরাই প্রচণ্ডভাবে পুরুষতন্ত্রের ধারক এবং বাহক। কয়টা শ্বশুর-দেবর বাড়ির বউ নির্যাতন করে! এখনো এই সংখ্যা অনেক কম। আমরা-ই তো করি কখনও ছেলের বউ হয়ে, কখনও শাশুড়ি হয়ে, কখনো বা ননদ হয়ে! এই আমরা-ই স্নেহময়ী মা, আহ্লাদী কন্যা আর আদরের বোন!! কেনো সম্পর্ক বদলে গেলে আমরাও বদলে যাই!! তখনও তো আমরা নারী-ই থাকি।
সম্পর্কে উত্থান-পতন থাকে। থাকে নানান জটিলতা। সম্পর্কের এই জটিল রসায়নের একটি-ই সমাধান সূত্র, সেটি হলো নিজের দিকে তাকানো। ভাইয়ের বউকে কটু কথা বলার আগে ভাবুন তো, আপনিও তো কারো ভাইয়ের বউ। দিনশেষে আমাদের প্রত্যেকের জীবনরেখা তো একই বিন্দুতে এসে মিলেছে।
আসুন বদলে যাই, বদলে দেই। হাতে হাত রেখে গড়ি নারী বান্ধব সমাজ।
“ছেড়েছ তো অনেক কিছুই
পুরনো অভ্যােস
অসুখ বিসুখ হবার পরে
জিলিপি সন্দেশ
ছেড়েছ তো অনেক কিছুই
পুরনো বোলচাল
পুরনো ঘর, পুরনো ঘর
কুড়োনো জঞ্জাল
হাল ছেড়োনা বন্ধু বরং
কণ্ঠ ছাড়ো জোরে
দেখা হবে তোমায় আমায়
অন্য গানের ভোরে”।
১৯.০৬.১৯