উইমেন চ্যাপ্টার ডেস্ক:
৮৯ বছর বয়সেও যে স্বপ্ন শুরু করা যায় তা দেখিয়ে দিলেন লতিকা চক্রবর্ত্তী। নিজের হাতে তৈরি চমৎকার সব ‘পোটলি’ ব্যাগ নিয়ে তিনি শুরু করেছেন অনলাইন বিজনেস, ব্যাগটির নাম লতিকা’স ব্যাগ। শুধু নিজের দেশেই নয়, জার্মানি, নিউজিল্যান্ড এবং ওমান থেকেও অর্ডার পেয়েছেন। ভাবা যায়?
আসামের ধুবড়িতে জন্ম নিলেও জীবন কাটিয়েছেন ভারতের বিভিন্ন অংশে স্বামীর বদলিযোগ্য চাকরির কারণে। লতিকা চক্রবর্ত্তীর সাথে কথা বলেছেন ইন্ডিয়ান উইমেন ব্লগ নামের একটি অনলাইন পত্রিকার একজন। উইমেন চ্যাপ্টারের পাঠকদের জন্য লেখাটি ইংরেজি থেকে অনুবাদ করে দেয়া হলো:
সেই তরুণ বয়স থেকেই লতিকার আগ্রহ ছিল বিভিন্ন কাপড়ের ইউনিক অংশগুলো সংগ্রহ করার, পরবর্তিতে তিনি দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে সুন্দর সুন্দর সব শাড়ি এবং ফেব্রিক্স সংগ্রহ করা শুরু করেন।
সেই তখন থেকেই তিনি বিশ্বাস করতেন যেকোনো জিনিসের পুনর্ব্যবহারে, এবং ফেলে দিতেন না কোনকিছুই। প্রথম তিনি তার সংগ্রহ থেকে নতুন পোশাক এবং সোয়েটার বানিয়ে দিয়েছিলেন নিজের বাচ্চাদের জন্য, পরবর্তিতে তিনি এগুলো দিয়ে পোটলি ব্যাগ তৈরি করা শুরু করেন। তবে শুরুতে এসবই ছিল পরিবারের লোকজন বা বন্ধুবান্ধবের জন্য। কিন্তু এক পর্যায়ে তিনি তাঁর এই স্বভাবজাত মেধাকে বিজনেসে রূপ দেন, যার নামকরণ হয় লতিকা’স ব্যাগ। এভাবেই তিনি বিশ্বদরবারে হাজির হোন নিজের পরিচয় নিয়ে।
তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল: সবসময়ই কি সেলাইয়ের প্রতি এমন ভালো লাগা ছিল? নাকি এই দক্ষতা পরে আস্তে আস্তে অর্জন করা হয়েছে?
—” আমার শখই ছিল পুরাতন জিনিস সংগ্রহ করা যাতে করে পরে তা ব্যবহার করা যায়। আমি জিনিসপত্র ফেলে দেয়াটা পছন্দ করি না। রিসাইক্লিং পদ্ধতি এখন বেশ ফ্যাশনেবল হলেও আমার জন্য এটা জন্মগতভাবেই হয়ে এসেছে। তোমরা যাকে ‘ইউনিক’ বলো, আমাদের সময়ে এটা খুবই কমন ছিল। তরুণ বয়সে আমি প্রচুর সেলাই-ফোড়াই করতাম। আমাদের জেনারেশনটা ছিল খুবই হিসেবি। পার্টিশান, যুদ্ধ এসব আমরা দেখেছি। আমাদের সময়ে গৃহকর্ত্রীরা তাদের ছেলেমেয়েদের জামাকাপড় নিজেরাই সেলাই করতো। সোয়েটার নিজেরাই বানাতো। পরে যখন আমার তিন সন্তান বড় হয়ে গেল, আমি পুুতুল বানাতে শুরু করি। এখন থেকে ৪-৫ বছর আগে আমার এক ছেলে বউ সুমিতা আমাদের তার জামার সাথে মিলিয়ে একটি পোটলি ব্যাগ বানিয়ে দিতে বলে। তখন আমার মনে পড়ে যায় যে আমার এমন একটি মেধা ছিল ব্যাগ বানানোর। আর এভাবেই শুরু হয় সব।
আমাদের সময়ে মেয়েদের এই কাজগুলি জানতেই হতো। যেমন সেলাই, উলের কাজ। আমার স্বামীর যেহেতু বদলির চাকরি ছিল তাই আমাকে সবসময়ই তার সাথে সাথে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে। এসময় অনেক নারীর সাথে আমার পরিচয় হয়। সবারই বাচ্চাকাচ্চা ছিল, এবং কেউই খুব একটা ধনী ছিল না। আমার বাচ্চারা বড় হয়ে যাবার পরই এই সেলাইয়ের কাজটা আমার কাছে প্যাশন হয়ে উঠে।
তাহলে লতিকা’স ব্যাগ এভাবেই এলো?
—আমি যখন পোটলি ব্যাগ বানাতে শুরু করি আমার পরিবারের লোকজন, বন্ধুবান্ধব তা দেখে খুবই প্রশংসা করে। আমি তখন তাদের জন্মদিন বা অন্যান্য উৎসবে গিফট দেয়া শুরু করি। তবে ব্যবসার চিন্তাটা আসলে আসে একমাত্র নাতি জয়ের কারণেই। জার্মানি থেকে এসে ও আমাকে এই কাজটি করতে দেখে, এবং তখনই সে ভেবে নেয় যে আমার এটা দিয়ে অনলাইন বিজনেস হতে পারে। সে তখন ওয়েবসাইট তৈরি করে দেয়। পরে তার অন্য নাতি-নাতনিরা যেমন প্রিয়াংকা, সৃজিত এবং জয় মিলে টুইটার, ফেসবুক এবং ইন্সটাগ্রামে এর কথা ছড়িয়ে দেয়। আমার পুত্রবধু সুমিতা আমাদের এই কাজে হেল্প করে, আমার ছেলে বিজনেসটা দেখে আর আমার পরিবারের অন্য লোকজন সমর্থন দেয় ও উৎসাহিত করে যে যেভাবে পারে। কাজেই বলা যেতে পারে যে এটা হলো একটা ফ্যামিলি ভেনচার।
এই পর্যায়ে এসে নাতি জয়ের সাথে অমূল্য এক সম্পর্কের কথাও বর্ণনা করেন লতিকা। বলেন, জয় শুধু নাতিই নয়, পরম বন্ধুও বটে!
অসাধারণ এই ব্যাগগুলোর পিছনে নিশ্চয়ই একটা করে মজার গল্প আছে?
—যখন আমি পুরনো কোনো পোশাক দেখি তখন মনে মনে কল্পনা করি কতোটা গ্লোরি একসময় ছিল এই পোশাকটির। হয়তো এটি কেবল কোন বিয়ে বা ফেস্টিভ্যালেই পরা হয়েছিল। কাজেই প্রতিটা ব্যাগের পিছনেও এর অতীত গল্পটিও থেকে যায় এবং সেগুলো সবই ইউনিক। যখন আমি একটা পোশাক কেটে একটা পোটলি ব্যাগ বানাই, তার মানে আমি একটা নতুন জীবন দেই ওই পোশাকটির।
আপনার সংগ্রহে এমন কোনো বিশেষ শাড়ি আছে যা খুবই মূল্যবান আপনার কাছে?
—অবশ্যই আছে। সত্য বলতে কী এমন অনেক শাড়ি আছে, যেগুলো আমি কখনই হাত দেবো না, ব্যাগও বানাবো না। সেইসব শাড়ি আমার হৃদয়ের কাছাকাছি কেবলমাত্র সেগুলো সুন্দর বলেই না, সেগুলোর সাথে অনেক স্মৃতি জড়িত বলেই।
একেকটা পোটলি ব্যাগ অসাধারণ, এবং দারুণ ক্রিয়েটিভ। এগুলোর ডিজাইন কীভাবে করেন?
— ধন্যবাদ প্রশংসার জন্য। দেখো, তোমাকে বুঝতে হবে যে এটা আমি করছি আমার নিজের আনন্দের জন্য। এটা বিজনেস করার জন্য না, টাকা ইনকামের জন্যও না। আমি কাপড় দেখে এর
সম্ভাব্য ডিজাইনটি ভেবে নিই। আমি সময় নিই, তাড়া তো নেই। আমাকে তো কোনো ডেডলাইন মানতে হয় না। যখন পুরো ব্যাগটি বানানো হয়ে যায়, তখন এর ফিনিশিং দিই অন্যান্য ম্যাটেরিয়াল যোগ করে।
জানতে পেরেছি যে আপনার সেলাই মেশিনটিও আপনার পুরনো মানে ৬৪ বছরের বন্ধু। একে ঘিরে কোনো স্মৃতি নেই মনে করার মতোন?
— এই মেশিনটি আমাকে দিয়েছিল আমার স্বামী কৃষ্ণলাল চক্রবর্ত্তী। যখন মেশিনটির দিকে আমি তাকাই, আমি সেই মানুষটি ভালবাসা আর স্নেহ অনুভব করি যেন। গত ৬৪ বছর ধরেই এটি আমাকে বিশ্বস্ত বন্ধুর মতো জড়িয়ে আছে। আর আমিও তাকে সমস্ত ভালবাসা দিয়েই আগলে রেখেছি। ৩৮ বছর আগে আমি স্বামীকে হারিয়েছি। এই মেশিনটি যেন তারই প্রতিচ্ছবি।
আপনার কথা থেকেই কাজের প্রতি ভালবাসাটুকু বোঝা যাচ্ছে লতিকা। এই বয়সে এসে একজন সফল বিজনেসওম্যান হওয়ার পিছনে রেসিপিটা কী আসলে?
—আমি খুবই সাধারণ একজন নারী যে কিনা নিয়মের মাঝে থাকতে পছন্দ করে। প্রতিদিন আমি ভোর ৫টায় উঠি, নিয়ম মেনে চলি। দিনে দুই থেকে তিন ঘন্টা সেলাই এবং লেখালেখি করি। আমার জন্য এই কাজগুলোই আমার ভালবাসা। আমার এই গল্প অতি পুরনো। আমি সফলতা নিয়ে কথা বলতে চাই না। যা কিছু বানাই সবই কাছের মানুষদের দিয়ে দেই। অবাক হই যখন দেখি কেউ কেউ সেটি কিনতে চায়। তবে আমি খুশি যে তারা আমার কাজটাকে পছন্দ করছে। সফলতাকে আমি দেখি এভাবে যে তুমি যা করো তা যেন ভালবেসে করো। নয়তো তোমাকে সেই কাজটির ওজন অযথাই বয়ে বেড়াতে হবে।”