সুচিত্রা সরকার:
ক্ষমতাবাহী নারীরাও পুরুষের চোখে স্রেফ নারী। মহিলা। সম্মান যার নিচের সারিতে।
আজ কদিন ধরে মাথায় ঘটনাটা ঘুরছে।
ছাত্র ইউনিয়ন করা অবস্থায় এমন একটা ব্যক্তিত্ব আমি বজায় রেখেছিলাম, কোনো ছেলে এসে বেচাল কিছু বলতে পারেনি। রুক্ষ, রাগী, গম্ভীর ভাবটাই ছেলেরা দেখেছে।
সেখানেও মেয়েরা সমাজের অন্য মেয়েদের মতো জটিলতায় পড়ে। ছেলেরা ডিচ করে। আরো ইত্যাদি ইত্যাদি।

মেয়েরা গাধার মতো কাঁদে। থৈ পায় না। ছেলেরা ভাই-ব্রাদার ধরে। এবং ঝামেলা থেকে বেরিয়ে যাবার পাঁয়তারা খোঁজে।
এরকম দুটো-তিনটে ঘটনা বেশ দাগ কেটে আছে মনে। তাতে শত্রু বেড়েছে। অনেকের অপছন্দের তালিকায় পড়েছি। সম্মেলনের আগে আগে সেসব অপছন্দ কাউন্টও হয়েছে। যাক সেসব।
যা গেছে তা যাক।
তখন দু হাজার দশ সাল। আমি নগরের সভাপতি। সংগঠন চালাতে সাবেকদের কাছে আগেও যেমন অর্থসাহায্যের জন্য যেতাম, তখনও যাই।
যার কথা বলছি, তিনি বড় আর্কিটেক্ট। হিন্দু নেতা। বিরাট পয়সাওয়ালা। ঢাকা শহরের বড় দূর্গাপূজা হ্যান্ডেল করেন।
আমার আগের সভাপতি তার কাছ থেকে টাকা নিতেন সম্মেলন বা কোনো বড় প্রোগ্রাম এলে। তো, প্রাক্তন সভাপতিই তার কাছে নিয়ে গেছিলেন। পরিচয় করিয়ে দিলেন আমাকে।
ঘটনার আগে দু-তিন বার তিনি সংগঠনের জন্য দু হাজার করে টাকা দিয়েছেন। এই তার সঙ্গে যোগাযোগ।
তো, আবার কোনো একটা প্রোগ্রাম উপলক্ষে তাকে ফোন দিলাম। তিনি দিন, তারিখ বললেন। অফিসে সময়মতো গেলাম। তখনই টাকাটা দিলেন না। বসে রাজনীতি নিয়ে কিছুক্ষণ গ্যাজালেন।
তারপর বললেন, আপনার সময় আছে? একটু ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে কথা বলবো!
আমার আমতাভাব দেখে বললেন, এখন তো দুপুর! চাঁদা তুলতে কোথায় আর যাবেন! লাঞ্চটাইম! চলুন লাঞ্চ করতে করতে কথা বলা যাক!
পল্টনের কস্তুরী রেস্টুরেন্ট। তখন ছাত্র বয়সে টিউশনির টাকায় চলা আমার কাছে নোয়াখালী হোটেলে পঞ্চাশ টাকায় লাঞ্চই খাসা!
খেতে খেতে তিনি তার অদ্ভুত সমস্যার কথা বললেন।
তার ভাইয়ের ছেলে এক মুসলিম মেয়ের সঙ্গে প্রেম করে। তারা বিয়েও করবে। কিন্তু তাতে করে পরিবারের মান সম্মান ধূলায়। সুতরাং তাকে ওই মেয়ের কাছ থেকে বের করে আনতে হবে। আর সেটা পারবে আরেকটা হিন্দু মেয়ে।
মেয়েটা তেমন কিছু করবে না। জাস্ট ফোনে কথা বলবে। ফোনে প্রেম করবে। ফোনকল বাবদ যত টাকা মেয়েটার খরচ হবে, তিনিই দেবেন।
তারপর যখন দেখা যাবে ভাতিজা মুসলিম মেয়েটার থেকে বেরিয়ে এসেছে, তখন ফোন করাও বন্ধ করে দিতে হবে।
তাৎক্ষণিক বুদ্ধি আমার ভয়ংকর খারাপ। মুখের উপর কিছু কাউকেই এ জীবনে বলতে পারি না। কথা যোগায় না।
বললাম, তারপর মেয়েটা কী করবে?
তার সাবলীল উত্তর, সে আবার কী করবে? সে তো অভিনয় করবে। সে তো আর প্রেমে পড়বে না। আর ভাতিজাকে তখন নতুন প্রেম থেকে বের করে আনা যাবে, কারণ মেয়েটা তো অভিনয় করবে। মেয়েটা বলে দিলেই হবে যে সে আর ভালবাসে না।
আর এটা যে প্ল্যান, বুঝতে দেয়া যাবে না ভাতিজাকে।
এবার সরাসরি প্রশ্ন তাকে- এমন শর্তে হিন্দু মেয়ে কই পাবো?
তিনি এবার যেন আরও আলাভোলা- কেন ইডেন কলেজে আপনাদের সংগঠন আছে না? সেখানকার কাউকে দিয়ে!
ভাবটা এমন ইডেনে পড়া মেয়েরা কেপ্ট একেকজন! চাইলেই পাওয়া যায়। তারা প্রক্সি দেয়ার জন্য বসেই থাকে!
তাকে সরাসরি বললাম, এমন কোনো মেয়ে নেই, যে এইরকম প্রক্সি দেবে।
তিনি বেশ নাখোশ। চাঁদা দিলেন এবার এক হাজার। সাতশ টাকা খাবার বিল এসেছিল।
গা জ্বলছিল অনেকদিন ধরে। আমার কাছেই হিন্দু প্রক্সিগার্ল খুঁজতে হলো! গাধা না হলে বোঝার কথা তার মনের কথা।
তিনি কি অন্য কোনো সভাপতিকে এরকম প্রস্তাব দিতে পারতেন? লিঙ্গে যে সভাপতি পুরুষ? পারতেন না।
মেয়েদেরকে আন্ডার এস্টিমেট করা এদের ধর্ম।
এই ছাগলগুলা ভাবে, মেয়ে যতোই ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকুক, মেয়েটার যতোই ক্ষমতায়ন হোক, মেয়েটা জাস্ট একটা মেয়েছেলে। মেয়েছেলের কাছে পুরুষের দাম নষ্ট হয় না, বাজে প্রস্তাব দিলেও না।
এখন রাগ হলে মনে মনে কষে তাকে লাথি মারি, জায়গামতো।
এবং লক্ষ্য করবেন বয়সে বড় হলেও তাকে চন্দ্রবিন্দু সহযোগে ডাকতে আমার আপত্তি।
ঘটনাটা কদিন ধরে বেশ ভাবছি।