ফাহমিদা খানম:
আর কয়দিন পরেই ঈদ, অথচ এখনও ঘর-বাড়ি পরিষ্কার করতে পারিনি, বয়স হইছে – এসব কাজ আর আগের মতো পারি না। ঈদের সময় সবাই দেখা করতে আসে, তাই কাজের মেয়েটাকে নিয়ে আজ বুকশেলফ ধরলাম।
এই মেয়েটাই এখন আমার সঙ্গী, একটা ডায়রি মুছতে গিয়ে টুপ করে ছবি নিচে পড়ার পর ছবি দেখে অবাক হলাম – কতোযুগ আগের ছবি এটা? ছোট মামার বিয়েতে আমাদের তিন বোনের সাথে মায়ের তোলা ছবি! আমাকে কোলে নিয়ে আছেন মা, পাশে দুই বোন।
“খালাম্মা আপনি দেখি কানতে, কানতে চোখ ফুলাইয়ালাইছেন, আমনে গোসলে যান – আমি সব করুমনে”
মেয়েটা জোর করে বাথরুমে জামাকাপড় দিয়ে গোসলে পাঠিয়ে ভালোই করলো – কিছুটা সময় একান্তে থাকার দরকার আমার।
“এবারের ঈদ আমি মায়ের সাথে করি?”
“তোমার কি মাথা খারাপ? বাড়ির বড় বৌ তুমি –ঈদের পরে সব বোনেরা, জামাইরা আসবে এসব দায়িত্ব ফেলে মায়ের কাছে ঈদ করতে যাওয়ার ইচ্ছেই আদিখ্যেতা!”
“বারে, তোমাদের বোনেরাও একটা ঈদ বাপের বাড়ি করে, আর আমি চাইলেই দোষ?”
নাহ, বড়ো বউয়ের অনেক দায়িত্ব বলে অনুমতি মেলেনি, কোথায় মেয়ে আর কোথায় বউ? সে যুগের বউরা যে যতো বেশি মুখ বুঁজে সহ্য করতো তাকেই সবাই ভালো বলতো।
সে যুগে ল্যান্ডফোন ছিলো একমাত্র ভরসা, আমি ফোন করে সময় বললে পাড়ার খালাম্মা মাকে জানাতেন – তারপর কথা হতো।
“নাতি–নাতিনের পরীক্ষার পর এবার আসবি রানু?”
“নাহ মা এবার তোমার নাতিনকে সিক্সে অন্য স্কুলে ভর্তি করাতে হবে, আসা হবে না মা”
“কতোদিন তোরে দেখি না! আগে মাকে ছাড়া কোথাও এক রাত থাকতি না – এখন বছর যায়, তাও আসিস না!”
“মা, সংসার, বাচ্চাকাচ্চা নিয়ে ব্যস্ত থাকি বুঝো না ক্যান?”
“মাকে দেখতে ইচ্ছে করে না বুঝি?”
বুক ফেটে কান্না আসতো এ কথায়—আজীবন মায়ের কাছ ঘেঁষা মেয়েটা বন্দী পাখির মতো ভেতরে ভেতরে ছটফটাতো—কেউই বুঝতো না। সবাই কেবল বউয়ের উপর দায়িত্ব চাপিয়ে দিয়েই খালাস — বউয়ের মন পড়ার এতো দায় ঠেকেনি সংসারের!
“বড় আপু দেশে আসবে, মেজো আপুও আসবে, আমি দুই আপুর সাথে কিছুদিন বাড়িতে থাকতে চাই”
“মাথা খারাপ নাকি তোমার? বোনেরা মাসব্যাপী বেড়াবে, তুমিও কি তাই চাও? মা-বাবা, সংসার কে দেখবে? সপ্তাহখানেক থেকেই চলে আসবা”
“মা যে এবার আমাদের নিয়ে নানাবাড়ি যাবেন বলেছেন, দুই দুলাভাইও থাকবে! প্লিজ তুমিও চলো না অনেক আনন্দ হবে”
“দয়া করে তোমার বড় দুলাভাইয়ের সাথে আমাকে তুলনা করবে না, তার কি কোনো পার্সোনালিটি আছে নাকি? দেশে এলে বউ বেশি থাকে তার বাপের বাড়ি, আর সে থাকে তার নিজের বাড়ি — পুরাই বউয়ের ভেড়ুয়া”
বড়ো আপু থাকতো বাহরাইন, তিন-চার বছর পর একবার দেশে আসতো, আর মেজো আপুর শ্বশুরবাড়ি ছিলো জয়পুরহাট — আমার বিয়ের আগে মা জেদ ধরে বসলেন – মেয়েকে দূরে বিয়ে দিবেন না –ছোট মেয়েকে কাছেই রাখবেন, বড়ো আদরের মেয়ে তার।
একান্নবর্তী পরিবারের বড়ো বউ হয়ে এসেছিলাম – মা বাবার কাছে কী ছিলাম সেটা ব্যাপার না, সব ভুলে নতুন জীবনে খাপ খাইয়ে নেয়াই জীবন!
শাশুড়ি মাকে পটিয়ে সেবার গেলাম বেড়াতে, বিয়ের পর আবার তিন বোন একসাথে বাড়িতে, বাবা নেই –তিন মেয়েকে কাছে পেয়ে মায়ের আনন্দের আর সীমা ছিলো না।
“আম্মা আপনি একা থাকেন –সবসময় টেনশনে থাকি, আপনি আমার সাথে থাকেন, আপনার পাসপোর্ট করিয়ে ফেলি”
“বাড়িঘর থুইয়া আমি বিদেশে থাকি ক্যামনে? আর জামাই বাড়িতে কি বেশিদিন থাকন যায়? মাইনষে কী কইবো?”
“আম্মা আমরা আপনার সন্তান – মেয়ের বাড়িতে কেনো মা থাকতে পারবে না? এসব জিনিস মাথা থেকে ঝাড়েন আপনি”
বড়ো আপুর কথাগুলো আমারও খুব বলতে ইচ্ছে করতো –সাহসে কুলাতো না। সপ্তাহ যাবার আগেই ঢাকা থেকে খবর এলো শ্বশুর এক্সিডেন্ট করেছে – আমি যেনো তক্ষুনি চলে যাই। সেদিনই মা আমাদের নিয়ে নানী বাড়িতে যাবার কথা ছিলো – আমি সব ফেলে চলে এলাম।
আসার সময় বড়ো আপু বললেন—
“আমি তো আছি, খালু সুস্থ হলে আবার আসিস বোন”
নাহ আর যাওয়া হয়নি, শ্বশুর বাবা কোমাতে থাকার পর চলে গেলেন, শাশুড়ি মাকে এভাবে রেখে যেতে পারিনি আর। দায়িত্ব আর কর্তব্যের ভিড়ে সময় চলে গেছে।
আমার যতো বিয়ের প্রস্তাব আসতো মায়ের পছন্দই হতো না, সব ফিরিয়ে দিতেন –যুক্তি একটাই মেয়েকে না দেখে থাকতে পারবেন না!
“এই ছেলেটা ভালো, তুমি অমত করো না, ছোট মেয়েটার বিয়ে দিলে আমার উপর থেকে দায়িত্ব শেষ হইতো”
“শোনেন, আপনি দুই মেয়ে দূরে বিয়া দিছেন, এইটা আমার ছোট মেয়ে, ওরে ধারে-কাছে বিয়া দিবেন – মাইয়া আমারে না দেখলে দম বন্ধ হইয়া মইরা যাইবো”
মায়ের অনড়তার কারণে বাবা কাছেই বিয়ে দিলেন — বিয়ের পর আমি ভৈরব থেকে ঢাকা এলাম সংসার করতে। আমি সবচেয়ে কাছে থেকেও সবচেয়ে দূরেই ছিলাম!
“আম্মার বয়স হইছে, আব্বাও নাই, আমি আম্মাকে কাছে এনে রাখবো সেই উপায় নাই, এবার গিয়ে কিছুদিন থাকতে চাই”
“আমি তোমার কষ্টটুকু বুঝতেছি রানু, কিন্তু তোমার মা মেয়ের বাড়ি থাকতে চান না, আম্মাও অসুস্থ, আবার বাচ্চারাও বড়ো হচ্ছে –এসব দায়িত্ব ফেলে কয়দিন নিশ্চিন্তে থাকতে পারবে তুমি?”
হ্যাঁ, মায়ের কাছে কয়েকদিনের জন্যে থাকতে গিয়েছিলাম – তখন আর কিছুই মনে রাখতেও পারেন না –পাশেই ছোট চাচার বাড়ি –তারাই দেখাশোনা করে – কতো চাইলাম কাছে আনতে – রাজি হলেন না, সে যুগের মায়েরা মেয়েদের বাড়িতে থাকতেই চাইতেন না। তিন বোন বলে কখনো আফসোস না হলেও মাকে দেখেই মনে হতো – হায় একটা ভাই যদি থাকতো!
“রানু, তুই তো কাছেই থাকিস –মাঝে-মধ্যে একটু আসতে পারিস না? সারাদিন রানু, রানু করে”
“চাচী, সামনে মেয়ে এসএসসি দিবে, শাশুড়ি মা বিছানায় –সবসময় কি আসতে পারি? তবুও এখন থেকে চেষ্টা করবো আসতে”
প্রথম মাসে দুইবার গেলেও পরে আর পারিনি –যে জীবন একবার সংসারের খাঁজে বসে যায় –তার আর মুক্তি নেই!
মেয়ের পরীক্ষার মাঝেই বাড়ি থেকে খবর এলো, ছুটে গেলাম –সব শেষ। দুই আপু এসে কবর দেখে বললো — তুই তো তাও মাকে শেষ দেখেছিস, আমরা তাও পাইনি!
মায়ের যত্নে রাখা ট্রাংক খুলে আমরা তিন বোন স্তব্ধ হয়ে গেলাম — আমাদের ছোটবেলার জামা, খেলনাপাতি আর ছবি ছাড়া অন্যকিছুই নেই, মা কি অবসরে এসবের মাঝেই আমাদের খুঁজতো?
সেই একান্নবর্তী পরিবার ভেঙ্গেছে, সব দায়িত্ব থেকে মুক্তি মিলেছে, স্বামীও আমাকে ফেলে আগেই চলে গেলো আর দুই সন্তানও দেশের বাইরে আছে – ফোনে আমার আকুলতা শুনলেই বলে –
চাকুরি, সন্তান, সংসার নিয়ে তাদের অনেক ব্যস্ততা, আর ছুটি পেলে এদিক সেদিক ঘুরতে যায়। দেশে আসার ইচ্ছে থাকলেও পারে না।
আমিও এখন মায়ের মতো প্রতীক্ষা করি –সন্তানদের জন্যে! একাকি আমিও অদৃশ্য দেয়ালে কতো কী লিখি! হয়তো এমনই হয় সবাই জীবনের প্রয়োজনেই বদলায়, জীবনের কিছু ক্ষেত্রে সবাই অসহায় সময়ের কাছে।
২৪/৫/১৯