তামান্না ইসলাম:
এই লেখাটা যারা নতুন বিয়ে করেছো বা বিয়ে করবে তাদের জন্য। যারা রিলেশনশিপে আছো, তারা রিলেট করতে যেও না, কারণ রিলেশনশিপ আর বিবাহিত জীবন দুটো বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই অনেক আলাদা। তবে কেউ যদি এই আচরণগুলো রিলেশনশিপেও খেয়াল করো, তারা ভেবে দেখতে পারো।
অনেকদিন ধরেই এই বিষয়টা নিয়ে লিখবো ভাবছি। এর কারণ হলো চারপাশে বিবাহিত মানুষদের বেশকিছু আচরণ দেখে আমি প্রচণ্ড হতাশ এবং বিরক্ত। মনে হয় বিয়ে তো না যেন একতরফা পরাধীনতা এবং আত্মসম্মান বিক্রির কন্ট্রাক্ট। ঘটনাগুলো হয়তো ছোট, অনেকেই কম্প্রোমাইজ বলে উড়িয়ে দেবে, কিন্তু আমার কাছে ছোট মনে হয় না। একমত হওয়া না হওয়া যার যার ব্যক্তিগত ইচ্ছে।
যদি তোমার স্বামী খুব ছোটোখাটো সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারেও নাক গলায়, বা জোর করে তার মতামত নিতে, সেটা ব্যক্তি স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপ। যদি রান্নাঘরটা তুমি সামলাও, বাসার গোছগাছও, তাহলে বাজার কী হবে, কী আইটেম রান্না হবে, ঘরের পরদার রঙ কী হবে, তোমার একটা নতুন বেডকভার বা এক জোড়া জুতো কিনতে ইচ্ছে হচ্ছে কিনা সেটাও তার পারমিশন নেওয়ার কথা না। সংসারে পর্যাপ্ত সচ্ছলতা আছে কিনা সেটা দুজনেরই জানা থাকার কথা। কোন কোন ছেলে শুধু যে টাকার জন্য ঝামেলা করে তা না, শুধুমাত্র কন্ট্রোল করতে চায় বলেই এই ধরনের আচরণ করে।
বড় ধরনের সিদ্ধান্তগুলো দুজনের মতেই হওয়া উচিত। বাচ্চা কোন স্কুলে পড়বে, কোথায় কোন বাসা ভাড়া নেবে, একটা গাড়ি কিনবে কিনা, কোন ইনভেস্টমেন্টটা ভালো এই টাইপের। অনেক ছেলে আবার স্ত্রীকে এসব ব্যাপারে পুরোপুরি অন্ধকারে রাখে এবং পাত্তাই দেয় না। এটা কোনো গ্রহণযোগ্য আচরণ না। এই সম্পর্কটা একটা ১০০% পার্টনারশিপ। সুতরাং সেভাবেই চলা দরকার।
অনেক সংসারেই শ্বশুরবাড়ি নিয়ে বেশ ঝামেলা হয়। বিশেষ করে বিয়ের প্রথমদিকে, বাঙালী ছেলেরা কেন যেন বউর পক্ষে সঠিক কিছু বলতেও সঙ্কোচ করে। এটা বিশাল এক টপিক। এই ব্যাপারে একদম অন্ধ হলে সমস্যা। সব মানুষের নিজের ব্যক্তিত্ব থাকাটাও জরুরি। নিরপেক্ষ থাকাটাও।
অনেক ছেলেকে দেখেছি এরা নিজের মা, বাবা, ভাই, বোনের সাথে বসে বসে বউকে নিয়ে হাসাহাসি করে। বউ রান্না পারে না, অগোছালো, খরচ বেশি করে ইত্যাদি ইত্যাদি। এটা একটা খুবই আপত্তিকর আচরণ।
অনেকে আবার নিজের পরিবার না, বাইরের মানুষের সামনেও বউকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করে কথা বলে। একথা ঠিক যে, সাধারণত স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কে অনেক সময় বয়সের ব্যবধানের কারণে বা ব্যক্তিত্বের পার্থক্যর জন্য হয়তো একটা আদর টাইপ সম্পর্ক থাকে, যেখানে স্বামীরা মজা করে অনেক সময় অনেক কিছু বলে, অনেক সময় স্ত্রীরাও বলে। কিন্তু সিরিয়াসলি ছোট করে কথা বলা অন্য জিনিস। এটা পরবর্তী জীবনে সন্তানদেরকেও শেখায় মাকে অসম্মান করতে।
আমরা মেয়েরা বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই স্বামীর বন্ধু, স্বামীর কলিগ, তাদের অফিসের পার্টি সব জায়গায় হাসি মুখে সেজেগুজে চলে যাই। ছেলেদের বেলায় কিন্তু এটা সব সময় দেখা যায় না। অনেক ছেলেই বউয়ের বন্ধুর বাসায় যেতে অস্বস্তিবোধ করে, অনাগ্রহ দেখায়। ধরো তুমি একটা দূরের শহরে বেড়াতে গেছো, বা অন্য জেলায়। সেখানে তোমার কিছু কাছের বন্ধু থাকে। তাদের সাথে তুমি দেখা করতে চাও। তোমার স্বামী যদি সেটায় বাধা দেয়, সেটার জন্য তোমাকে সময় বের করতে না দেয়, সেটা ঠিক না। তুমি যদি তার বন্ধুদের আড্ডায় যাও, তারও একই কাজ করা উচিত।
তোমার বাসায় শ্বশুর শাশুড়ি, ননদ, দেবর বেড়াতে আসলে তুমি তাদের সাথে হাসি মুখে কথা বলবে। রান্না করে খাওয়াবে। উপহার কিনে দেবে। তোমার বাসায় তোমার মা, বাবা, ভাই, বোন ও একইভাবে ওয়েলকাম ফিল করার অধিকার রাখে। তারা তোমার বাসায় আসলে তোমার স্বামী যদি ব্যস্ততার ভান ধরে বা কথাই বলে না (সরাসরি খারাপ ব্যবহার না, তবে আকারে ইঙ্গিতে) সেটা অন্যায়। তুমি যদি তার পরিবারের প্রতি উষ্ণ হও, তাহলে তার তো শীতল হওয়া সাজে না।
অনেক বাঙালী ছেলেই আশা করে উৎসবের দিনগুলো পুরোপুরি তার পরিবারের সাথেই কাটাবে। এটা মেয়েটার জন্য খুব কষ্টের। সে যতই শ্বশুর শাশুড়ি এবং শ্বশুরবাড়িকে ভালো বাসুক, নিজের পরিবার নিজের পরিবারই, নিজের মা-বাবা, নিজের মা-বাবাই। বিশেষ দিনগুলোতে তাদের সাথে সময় কাটাতে সবারই মন চায়। যদি স্বামী, স্ত্রী দুজনে একসাথে সারাদিন থাকতে চাও, তাহলে দিনটাকে ভাগ করে নাও। এ ব্যাপারে পুরাপুরি ছাড় দেওয়া ঠিক না। যারা অন্য জেলা বা বিদেশ থেকে মা, বাবা, শ্বশুর, শাশুড়ির সাথে দেখা করতে বা ঈদ করতে যাও তাদের ক্ষেত্রেও একই কথা।
বিবাহিত সম্পর্কে পজেসিভনেস থাকাটা খুব স্বাভাবিক, এটা বলা যায় এই সম্পর্কের একটা আঠা। আমরা জগত সংসারের সবাইকে নিয়ে পজেসিভ হই না, যাকে ভালোবাসি তাকে নিয়েই হই। কিন্তু এটা সীমা অতিক্রম করলে সমস্যা। কিছু ছেলে আছে যারা বউ অন্য কারও সাথে, অন্য কোনভাবে আনন্দ পাক এটা সহ্য করতে পারে না। কেউ কেউ সন্দেহ করে। বউ সুন্দরী বা হট হলে তো অবস্থা আরও খারাপ। কথা বার্তা, চাল চলনে বা পোশাক আশাকে স্মার্ট হলেও একই দুরবস্থা। সন্দেহ না করলেও অতিরিক্ত সোহাগের ঠেলায় ‘আমার হাতেই তোমার সকল আনন্দের চাবিকাঠি’ টাইপ মানসিকতা থাকে। এটা কিন্তু প্রেম নয়, এটা টর্চার। কোন মানুষের জীবনেই শুধু স্বামী/ স্ত্রী বা সংসার সবকিছু নয়, এটার বাইরেও সবারই একটা জীবন আছে।
এখন আসি কী করণীয় সে বিষয়ে। দোষে গুণে মানুষ। কেউ হয়তো পাঁচটা দোষ করে, দশটা ভালো করে। সবার প্রাইওরিটিও এক না। তোমার নিজের লিস্ট বানাও মনে মনে, কোনগুলো একদম ‘নো নো’, কোনগুলো মানিয়ে নেওয়া যায়। তবে খেয়াল করা দরকার, বিয়ের প্রথম সময়টা খুব জরুরি। তিনটি কারণে। এক হানিমুন পিরিয়ডের কারণে এ সময় অনেক সমস্যা চোখে পড়ে না, পড়লেও আমরা ইগ্নোর করি। পরবর্তীতে এই সমস্যাগুলো ভয়াবহ হয়ে দেখা দেয়। দুই, এসময় লজ্জা বেশি থাকে বলে আমরা মুখ ফুটে নতুন পরিবেশে অনেক কিছু বলতে পারি না। তিন নম্বরটি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। তোমার অধিকার তোমাকেই অর্জন করতে হবে, প্রতিবাদ না করলে, মুখ না খুললে অনেক কিছুই পরিবর্তন হবে না। আর এই মুখ খোলাটা শুরুতেই কার্যকর। দেরি করে ফেললে এটা অভ্যাস বা রীতি হয়ে যায়, যেটা আর পরবর্তীতে পরিবর্তন করা যায় না। বরং তিক্ততা বাড়ে। মুখ খোলা মানেই তুলকালাম ঝগড়াঝাঁটি না, নিজের অপছন্দ বা অন্যের ভুলটা জানিয়ে দেওয়া।
স্বাভাবিকভাবে প্রশ্ন জাগতে পারে, বিয়ে মানে প্রেম, ভালবাসা, বন্ধন, এর মধ্যে এমন যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব কেন?
আসলে এটা একটা পার্টনারশিপ, যে সম্পর্কে ভালবাসা, প্রেম সবই থাকে। আমরা একজন আরেকজনের জন্য বাজার করি, কেউ রান্না করি, লন্ড্রি করি, টাকা না থাকলে একজন আরেকজনের দায়িত্ব নেই, মানসিক সাপোর্ট দেই, অসুস্থ থাকলে দেখাশোনা করি, এক সাথে স্বপ্ন দেখি, বাচ্চা নেই, তাদের লালন-পালন করি, জীবনের সাফল্য, ব্যর্থতা ভাগ করে নিই, শারীরিক-মানসিক প্রেম থাকে, সবই থাকে, সেই সাথে থাকতে হবে সম্মান আর কেয়ার, দুজনেরই দুজনের প্রতি।
এটা একতরফা হলে সেখানেই সমস্যা। সত্যিকার ভালবাসা থাকলে ভালোবাসার মানুষটা কীসে কষ্ট পায়, অপমানিত হয় এগুলো তো বোঝার কথা, এগুলো অন্যায় আবদার বা দাবি না হলে সেগুলো মানতে কারও সমস্যা হওয়ার কথা না।
আরেকটা শেষ কথা, লেখাটা আমি মেয়েদের জন্য লিখলেও একই ধরনের লেখা ছেলেদের জন্যও লেখা যায়। আমরা কেউ যেন সেরকম বউ হয়ে না যাই, যাদেরকে নিয়ে এসব অভিযোগ তোলা যায়। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। এটাই জগতের নিয়ম।