মরিয়ম সুলতানা:
আমার বয়স ২২। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছি। স্নাতক, ৩য় বর্ষে। এই ছোট্ট জীবনে আমি অনেককিছুর সাক্ষী হয়েছি, সবাই-ই হয়। তবুও সবার জীবনের গল্প যে আলাদা…।
আমার বেড়ে ওঠা এমন দু’টো বটবৃক্ষ তলে, যারা একই সাথে প্রগতিশীল এবং রক্ষণশীল। তাদের প্রগতিশীল সত্তা’র জন্য-ই আজ আমি ‘আমি’ হয়ে ওঠা’র পথে নামতে পেরেছি। সেদিন আমার কাকা কী এক প্রসঙ্গে যেন বলেছিলেন, “তুমি-ই আমাদের বংশের প্রথম মেয়ে যে কিনা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছো।”
কথা সত্য। একই কথা আমার মাতুলকূলের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য।
কিন্তু সেইসাথে তাদের রক্ষণশীল সত্তাটা আমার চতুর্দিকে লোহার গরাদ টেনে দিয়েছে। মানুষ তো জন্ম থেকেই স্বাধীন এবং আমার বাবা-মা আমায় আমার সেই প্রাপ্য স্বাধীনতার পূর্ণ ব্যবহারের সুযোগ দিয়েছেন, দিচ্ছেন। তবে আমার এক পায়ে একটা লোহা’র ভারী শেকল পরিয়ে দেয়ার পর। তারা আমার পায়ে লোহা’র ঐ ভারী শেকলখানা পরিয়ে দেয়ার পর আমায় বলেছেন, “নাও! এবার যত দূর পারো, যাও।”
আমায় তারা ঠিক-ই জীবনটাকে যেভাবে ইচ্ছা যাপন করতে দিয়েছেন, কিন্তু অনেকগুলি অব্যয়ের সমন্বয়ে। যেমন…
• পড়াশুনা করো, চাকরিও করো। কিন্তু অবশ্যই ডেস্কজব। মেয়েদের বাইরে বাইরে কাজ করা উচিত না।
• বিদেশে পড়াশুনা করতে যাওয়া? উঁহু! একদম না। ও বিয়ের পরে, যদি বর অনুমতি দেয়।
• ঘুরতে যাও, ঘুরতে গেলে মানসিক উন্নতি সাধন হয়। তবে অবশ্যই পরিবারের সাথে। অথবা বিয়ের পরে একবারে বরের সাথে যেও।
• এক্ষুনি মাথায় কাপড় দাও। লোকে কী বলবে! বিয়ের পরে বর আপত্তি না করলে দিও না, কিন্তু বিয়ের আগ অবধি আমাদের কথানুযায়ী চলো।
• আজকের রান্নাটা তুমি করো তো। বিয়ে হলে রান্না করতে হবে না? তখন রান্না না পারলে তোমার শাশুড়ি আমায় বলবে যে মেয়েকে তো দেখছি কিছুই শেখাননি!
• আর কয় সেমিস্টার আছে? আন্ডারগ্রেড শেষ না হওয়া অবধি সময়। হয় নিজে কাউকে পছন্দ করো, নয় আমাদের ওপর দায়িত্ব ছেড়ে দাও। মেয়ে হয়ে জন্মেছো, বিয়ে করতে হবে তো। একটা বয়সের পরে মেয়েদেরকে বিয়ে দেয়া বাবা-মা’র জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। তাছাড়া বয়স বাড়লে মেয়েদের চেহারায়ও এই লাবণ্যতাটা থাকে না।
• বিয়ের পর একটা বাচ্চা হলেই সব ঠিক হয়ে যাবে।
আমার তো মাঝেমধ্যে মনে হয় যে আমি বোধহয় রাজকপাল নিয়ে পৃথিবীতে এসেছি। নয়তো আমার বয়সী মেয়েরা এখন সংসার এবং বাচ্চা-কাচ্চা’র ভারে ন্যুব্জ হয়ে পড়ছে। আর সেখানে আমি এখনও বহাল তবিয়তে দাপিয়ে বেড়াতে পারছি। এখন প্রশ্ন উঠতে পারে, বাচ্চা-কাচ্চাকে কি ভারস্বরূপ গণ্য করা ঠিক হচ্ছে আমার? সেক্ষেত্রে আমার উত্তর- হ্যাঁ, হচ্ছে। কেন ঠিক হচ্ছে তার আগে বলে নিই যে-
বন্ধুদের সাথে আড্ডায় বসলে ওরা বলে…
• নারী যদি মা না হয়, তাহলে সে আবার কিসের নারী?
প্রগতিশীল প্রেমিক বলে…
• নারীর সৌন্দর্য তার মাতৃত্বে।
আমার মা বলেন…
• মেয়ে যদি মা না হয়, তবে সেই মেয়ের কোনো মূল্য নাই।
তাহলে দেখা যাচ্ছে যে পরিপার্শ্ব অনুযায়ী ‘যথার্থ মা’ হয়ে ওঠাটাই হওয়া উচিত একটা মেয়ের জীবনের পরম লক্ষ্য, স্বপ্ন, এমনকি ব্রত। তুমি যত-ই পড়াশুনা করো কিংবা প্রতিষ্ঠিত হও, মা-ই যদি না হতে পারো তবে তোমার জন্ম-ই বৃথা। আর মা হওয়ার প্রথম ধাপ হলো বিয়ে।
আমার মাঝেমধ্যে এও মনে হয় যে আমায় শিক্ষিত করে তোলা’র আদি এবং আসল উদ্দেশ্য হলো একটা বিয়ে, একটা বর এবং সন্তান। অথচ এই মা হওয়ার প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়ে যাওয়ার জন্য কতো মেয়ের স্বপ্ন, সাধ, আহ্লাদ সব নিমিষেই ধূলিসাৎ হয়ে যায়। তাদের স্বপ্নের গায়ে কালশিটে পড়ে। তারাও কেমন বড় হওয়ার আগে বুড়িয়ে যায়।
এই সমাজ উঠতে বসতে মাতৃত্ব বিষয়টাকে যেভাবে নানাবিধ মশলা দিয়ে উপস্থাপন করে, বিয়েকে একটা মেয়ের জীবনের শাশ্বত কর্তব্য রূপে পরিচয় করিয়ে দেয়; সত্যি-ই কি তার দরকার আছে? মাতৃত্ব বিষয়টা কি সত্যি-ই অত সুখের? আমার কল্পনায় এবং বিবেচনায় মা হওয়ার মুহুর্তটুকু যতটুকু সুখের, মা হওয়ার পূর্বের এবং পরের অফুরান সময়গুলি তার থেকে কয়েক সহস্র গুণ কষ্টের, দুশ্চিন্তার এবং অনিশ্চয়তার। কারণ?
আমার মা, যিনি একজম কর্মজীবী নারী। যিনি তার ঘর বাহির দু-ই সমান তালে সামলান। আমার বাবা তার সময়ের তুলনায় যথেষ্ট বেশি আধুনিক, আগেই বলেছি। নারীশিক্ষার জন্য তার ভূমিকা দেখলে তাকে আমার মাঝেমধ্যে করজোড়ে প্রণাম করতে ইচ্ছা করে। তো, তার ঐ আধুনিকতার জন্যই বোধহয় ছোটবেলা থেকে এও দেখে এসেছি যে তিনি তার অবসর সময়ে বা তার ইচ্ছে হলে বা প্রয়োজনে ঘরের কাজকর্মে আম্মুকে ‘সাহায্য’ করেন। কিন্তু, তা ঐ ‘সাহায্য’ অবধি-ই সীমাবদ্ধ। ঘরের কাজের মূল দায়িত্বটা থাকে আম্মু’র-ই। আব্বু হয়তো কোনো কোনোদিন কাপড় কাঁচেন, কোনো কোনোদিন ঘর ঝাড়ু দেন, কিংবা ঘর মোছেন, কিংবা রান্নার সময় আম্মুকে একটু হাঁড়ি পাতিল এগিয়ে দেন। কোনোদিন আবার গাছে পানি দেন। সাহায্য বলতে এতটুকুই। কিন্তু আমার মা, যার দৈনন্দিন জীবনের কর্মসূচি হলো, কেউ ঘুম থেকে উঠুক বা না উঠুক, তিনি সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সবার জন্য সকাল এবং দুপুরের খাবার বানাবেন। তারপর সারাদিনের জন্য বের হবেন। বাসায় এসে একটু বিশ্রাম নিয়ে গৃহস্থালি কাজকর্ম যা আছে, করবেন। সময় পেলে একটু ঘুমাবেন বা টিভি খুলে দেশ-বিদেশের খবরাখবর দেখবেন। এবং সন্ধ্যায় আবার তিনি যথারীতি সবার জন্য রান্না করবেন।
এটাকে জীবন বলে বুঝি? আমি জানি না। শোনা যায়, আমার মা ছিলেন মাতুলকুলের সব থেকে মেধাবীজন। তার বিয়ে হয় ১৯৯৫ সালে, যখন তিনি সদ্য ইন্টারমিডিয়েট পাশ। আমি যখন তার গর্ভে তখন তিনি স্নাতকের শিক্ষার্থী, সাল ১৯৯৬। ঐ গর্ভকালীন অবস্থায়-ই সে ক্লাস করতো, পরীক্ষা দিতো। কিন্তু তিনি তার ঐ পরীক্ষায় আশানুরূপ ফলাফল করতে পারেননি, যার আক্ষেপ তার এখনও। এজন্য আমার অবশ্য নিজেকে মাঝে-মধ্যে দোষী মনে হয়।
এই মানুষটা তার সুসজ্জিত ক্যারিয়ার, পড়াশোনা সব ছেড়ে দিয়ে বিয়ে করেছিলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত কী পেয়েছেন? তিন ছেলেমেয়ে এবং তাদের অনাগত ভবিষ্যত নিয়ে শঙ্কা? মাতৃত্বের নামে দুশ্চিন্তা এবং দায়িত্বের নামে বোঝা?
জীবনে কোনোদিন নিজের দিকে তাকানোর ফুসরত এই ভদ্রমহিলা পাননি। সংসার জীবনের শুরুতে তাকে আমার বাবা’র সুবিশাল পরিবার সামলাতে হয়েছে। আর তারপর শুরু হলো আমাদেরকে নিয়ে তার এক নিরন্তর পথচলা। আম্মুকে কখনো জিজ্ঞেস করা হয়নি, “আম্মু, শেষ কবে তুমি দুশ্চিন্তা ছাড়া রাতে ঘুমিয়েছো?” আমি হলফ করে বলতে পারি, আম্মু কোনো উত্তর দিতে পারবে না। আম্মু বেঁচে আছেন, আমাদেরকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে বলে।
তার এখনকার দুশ্চিন্তা হলো আমি, আমার ক্যারিয়ার এবং আমার বিয়ে। তবে প্রধানতম দুশ্চিন্তা, আমার বিয়ে। তাকে দুশ্চিন্তামুক্ত করার জন্য আমি যদি এখন বিয়েও করি, তবুও তার দুশ্চিন্তা বাড়বে বৈ কমবে না, এও আমি নিশ্চিত। তখন তার নতুন দুশ্চিন্তা হবে, তার মেয়ে সুখে আছে তো? অথচ আমি যে এখন ‘বিয়েতে আমি সুখ খুঁজে পাবো না, আমায় বিয়ে দেয়ার জন্য অস্থির হয়ো না’ বলে চিৎকার করছি; তারা তা কানে তুলছেন না।
আমি আমার মায়ের মতো দশভুজা নই যে পড়াশুনা, ক্যারিয়ার সব সামলে সংসারও সামলাতে পারবো। সেই ইচ্ছেও নেই। যদি দশভুজা হতাম বা হওয়ার ইচ্ছে থাকতো, তাহলে এতোদিনে নববধূবেশে সাজতে রাজি হয়ে যেতাম। মায়েরা নিজেরা এতো কঠিন অগ্নিপরীক্ষা দেয়ার পর তাদের মেয়েদেরকে কেন মা হিসেবে দেখতে চায়, এ বোধহয় সারাজীবন আমার কাছে এক রহস্যময় অধ্যায় হয়েই থেকে যাবে।
‘মাতৃত্ব সুন্দর’, এ শব্দ দু’টো কেবল ভ্রম। যুগ যুগ ধরে এ সমাজ নারীকে শুনিয়ে আসছে,’নারীর নারীত্ব ফুটে ওঠে তার মাতৃত্বে’ আর নারীরাও সরলমনে তা বিশ্বাস করে নিয়েছে। এই স্তুতিবাক্য যদি না গাইতো, তবে মেয়েরা জন্মের পর থেকে মা হওয়ার জন্য একটু একটু করে করে নিজেকে প্রস্তুত করতো না। অমানুষিক শারীরিক যন্ত্রণা ভোগের পরিবর্তে উপভোগ করতো না।
এতো বড় আত্মত্যাগ স্বীকার করে, নিজের সমস্ত সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য জলাঞ্জলি দিয়ে এভাবে মহীরুহ হয়ে উঠতে চাইতো না। মায়েরা সময়ের সবথেকে সাহসী যোদ্ধা ঠিক-ই, সেইসঙ্গে ভীষণরকম বোকা এবং আত্মভোলাও। আমি তাদেরকে দেখি, বিস্মিত হয়ে যাই, তাদের আত্মত্যাগ কল্পনা করে কেঁপে উঠি। ভয়ে কিংবা শ্রদ্ধায়। কিন্তু মা হওয়াটাই নারী জীবনের একমাত্র সার্থকতা না।
কিন্তু সব মেয়ে মা হয় না, কেউ কেউ লিলিথ হয়ে বেঁচে রয়।
পৃথিবীর সকল মায়ের জন্য ভালোবাসা।