
ইমরান আহমেদ: একটি বেসরকারি টিভি চ্যানেলে রবীন্দ্র সংগীত শিল্পী মিতা হকের দেয়া কিছু বক্তব্য নিয়ে ফেসবুক এবং বিভিন্ন সামাজিক নেটওয়ার্কে বিতর্কের ঝড় উঠেছে। আমি সেই বক্তব্যগুলো আজ একটি ভিডিও লিঙ্কে যেয়ে শুনলাম। মিতা আপাকে আমি ব্যক্তিগতভাবে চিনি। ওনার কথাগুলো শুনে আমি প্রথমত ভীষণ অবাক হয়েছি এবং হতাশ হয়েছি। এরকম চিন্তা-ভাবনা অন্তত ওনার কাছে থেকে আশা করিনি, আর দেশ যখন এরকম একটা সংকটময় সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে।
বাঙালি ভাষায়, সাহিত্যে, বিজ্ঞানে, দর্শনে, দেশপ্রেমে তার বাঙালিত্বের শ্রেষ্ঠত্বের প্রমাণ দিয়ে এসেছে তার কর্ম, নিষ্ঠা এবং সুস্থ চিন্তা শক্তির মাধ্যমে। একজন মানুষকে বাঙালি হিসেবে পরিচয় করিয়ে দিতে যেই বৈশিষ্ট্যগুলোর প্রয়োজন হয় সেই তালিকায় আদর্শ কোন পোশাকের বর্ণনা আছে কিনা আমার জানা নেই(যদি কারও কাছে যথার্থ তথ্য থেকে থাকে আমাকে দয়া করে ইন-বক্স করুন), অথবা এটা অতীব গুরুত্বপূর্ণ একটি ক্রায়েটেরিয়া বলেও আমি মনে করিনা। এমনটি ভাবার অনেক কারণ আছে। যারা ভাবছেন বাঙালিকে ধর্মের আওতার বাইরে রেখে প্রগতিশীলতার নিক্তিতে মাপবেন তারা খুব ভুল করবেন। আমি এখানে ইতিহাস টানব না, নেট ঘেঁটে পড়ে নিতে পারেন। ধর্মের প্রবল প্রভাব ছিল জন্যই একটি জাতির মধ্যে এতগুলো ধর্মের অনুসারী আমরা দেখতে পাই। বাঙালি হিন্দু, বাঙালি মুসলমান, বাঙালি খৃষ্টান, বাঙালি বৌদ্ধ। অথবা উল্টেও বলতে পারেন, হিন্দু বাঙালি, মুসলমান বাঙালি, খৃষ্টান বাঙালি, বৌদ্ধ বাঙালি। এত ধর্মের আবির্ভাব কেন হলো বা বাঙালি বিভিন্ন ধর্মের প্রতি কেন আকৃষ্ট হলো সেই বিষয়ে এখন যাবো না, শুধু এটুকু বুঝি যে বাঙালি জাতির মধ্যে ধর্মীয় সংস্কৃতি এক বিচিত্র ধারায় বয়ে চলেছে। জাতিতে আমরা বাঙালি, কথা বলছি একটি ভাষায় কিন্তু শুধুমাত্র ধর্মীয় সংস্কৃতির কারণে আমাদের মধ্যে বিচিত্রতা ব্যাপক। তাই বাঙালির একটি মডেল পোশাক বা আউট ফিট যাই বলি না কেন প্রতিষ্ঠা বা সেটল করা খুবই জটিল।
মিতা হক কিন্তু বাঙালির কোন আদর্শ পোশাকের রূপরেখা টানতে পারেন নি বা টানেননি। বরং উনি বলেছেন যারা দাড়ি রাখেন, টুপি পরিধান করেন,আলখাল্লা পরেন, ঘোমটা/হিজাব টানেন/পরেন, এমন বোরখা পরিধান করেন যে শুধু চোখ দেখা যায়, তারা আর যাই হোক বাঙালি হতে পারে না। এই কথাটাই আমার কাছে খুবই খেলো এবং অযৌক্তিক এবং অপ্রাসঙ্গিক মনে হয়েছ। এত সহজে কাউকে অবাঙালির ট্যাগ লাগিয়ে দেয়া সত্যি ধৃষ্টতার পর্যায় পড়ে যায়।
ঠিক আছে, যদি তাই হয় তবে রবীন্দ্রনাথ কি বাঙালি নন? নেটে তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি। রবি বাবুর দাড়ি ছাড়া ছবি পেয়েছি মাত্র দুটো। বাকি সব ছবিতে দাড়ি, আলখাল্লা এবং টুপিসহ রবি বাবুকে দেখেছি। মিতা হকের কথা অনুযায়ী উনি তবে বাঙালি নন।
নজরুল ইসলাম দাড়ি রেখেছেন , টুপি পরেছেন।
কবি নির্মলেন্দু গুনের লম্বা চমৎকার দাড়ি রয়েছে।
বেগম রোকেয়া মাথায় কাপড় দিতেন।
শ্রদ্ধেয়া সুফিয়া কামাল, জাহানারা ইমাম।
এই মানুষ গুলি বাঙালি নন ?
আরও অনেক উদাহরণ দেয়া যায়। আমি আর উদাহরণ টানতে চাই না।
সারাংশ এই যে, আমি কি পোশাক পরিধান করব, মাথা ঢাকব কি ঢাকব না, সেটা সম্পূর্ণ আমার ব্যাপার এবং অধিকার। আরেকজন যেমন সেটা ঠিক করে দেবার অধিকার রাখেন না কোনভাবেই এবং আমিও অন্য কাউকে বলে দিতে পারিনা যে তুমি এই পোশাক পরবে, দাড়ি রাখবে বা রাখবে না, ঘোমটা দেবে কি দেবে না। এবং পোশাক দিয়েও একজন মানুষকে সামগ্রিকভাবে জাজ করাটাও বেশ অমানবিক। ঘোমটা ফেলে দিলে, টুপি পরা বাদ দিলে, দাড়ি না রাখলেই যদি বাঙালি হওয়া যেত, তবে তো আর কোন সমস্যা ছিল না।