মগজের আবর্জনা পরিস্কারের দায়িত্বটা কার?

লিপিকা তাপসী:

শিশুরা বড় হয় চারপাশ থেকে দেখেশুনে। যৌনতা, ধর্ষণ বিষয়ে ধারণা, নারীর প্রতি আচরণ কেমন হবে তা গড়ে উঠতে কিশোর বয়সে দেখা নাটক সিনেমাও একটা বড় ভূমিকা রাখে বৈকি। যেমন সিনেমা মানেই কিছু দৃশ্য প্রায়ই দেখা যাবে। সেগুলো এরকম:

দৃশ্য ১: নায়িকা ছোট পোষাক পরে বুকে একটা ফাইল চেপে কলেজে যাচ্ছে, যদিও বাস্তবে আদৗ কোন মেয়ে কলেজে এরকম পোশাক পরে কলেজে যায় কিনা সে প্রশ্ন থেকেই যায়। মাঝে মাঝে নায়িকার পিছনের, বুকের বিশেষ অংশ বড় করে পর্দায় ভেসে উঠছে। কিংবা নায়িকা কলেজে যাওয়ার পথে নিজেই নাচছে আর গাইছে ‘আমি কলকাতার রসগোল্লা’ তা দেখে নায়কের মনে প্রেমের ভাব হয়, শুরু হয় পেছন পেছন দৌড়াতে দৌড়াতে গান ‘সুন্দরী গো রাগ করো না, রাগলে তোমায় লাগে আরো ভালো’। এভাবে কিছুদিন যায়, কিন্তু তবু নায়িকার মন গলে না, একসময় নায়ক তার ভালবাসার মাত্রা বোঝাতে নায়িকাকে জঙ্গলে ধরে নিয়ে যায়। নির্জন জায়গায় নায়িকা দুই হাত দুই দিকে মেলে বলে, ‘এই নে শয়তান দেহ পাবি কিন্তু মন পাবি না’। নায়ক নায়িকার ‘দেহ’ পেয়েও ছুঁয়ে দেখে না। আহা নায়কের এই ‘মহত্ব’ নায়িকার মনে প্রেম জাগিয়ে তোলে। শুরু হয় তাদের অনন্ত প্রেম। দুনিয়ার কোন শক্তিই তাদেরকে আর আলাদা করতে পারে না।

দৃশ্য ২: রসগোল্লা দেখে মোটা, লম্বা চুলওয়ালা ভিলেনের জিভে লক লক করে। সেও নায়িকার প্রেমে ভাসতে থাকে, কিন্তু নায়িকার ভালবাসা না পেয়ে নায়িকাকে ধরে নিয়ে যায়। নায়িকার প্রতি ভিলেন আস্তে আস্তে এগিয়ে যায় আর বলে তোকে ‘নষ্ট’ করবো যাতে তোর দিকে আর কেউ হাত না বাড়ায়। ওদিকে নায়ক খবর পেয়ে ইটের দালানের ইট, কাঠ ভেঙ্গেচুরে অক্ষত অবস্থায় ভিলেনের সঙ্গীদেরকে এক এক করে কুপোকাত করছে। এমনকি নায়ক বন্দুকের মুখে জীবনবাজি রেখে গায়ের জোরে ঢিসুম ঢিসুম করে সববাইকে পরাজিত করে নায়িকার বুকের ছেড়া কাপড় ঢেকে দিতে নিজের জামা খুলে পরিয়ে দেয়। বাড়িতে ফিরে নায়িকা বলে, ছেলেটি তার সম্ভ্রম বাচিয়েছে।

দৃশ্য ৩: রোমান্টিক দৃশ্যে নায়ক নায়িকার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে,আর নায়িকা মুখে হাত দিয়ে আমার বুঝি লজ্জা করে না বলে বাকা হয়ে দৌড় দিয়ে চলে যাচ্ছে। অথবা ‘যাহ! তুমি একটা দুষ্টু!’ । অথবা বাসর ঘরে নায়ক রোমন্টিকভাবে এগিয়ে যাচ্ছে আর নায়িকা মুখে লজ্জার ভঙ্গি করে দুরে সরে যাচ্ছে।

এই ধরনের দৃশ্য দেখে বড় হওয়া কিশোর কিশোরীরা ধরেই নিয়ে বড় হয় নারীর মুখে ‘না’ মানে অন্তরে হ্যাঁ। নায়িকার পিছে লেগে থাকলে পরবর্তীতে একসময় হ্যাঁ হয়ে যাবে। যৌনতা মানে নারীরা লজ্জা পাবে, নারীর যৌন আকাঙ্খা প্রকাশ মানে সে ‘বেহায়া, খারাপ’। নারী হবে ‘লাজুক লতার’ মতো, ‘লজ্জাবতী লতার’ মতো। আর এক্ষেত্রে পুরুষেরই দায়িত্ব এগিয়ে যাওয়া, দরকার হলে জোর ও করা যাবে। নায়কের দায়িত্ব নায়িকাকে বাচানো, পুরুষই নারীকে রক্ষা করবে। আর নারীর সাথে ঘটা যৌন হয়রানী, ধর্ষণ হলে নারীর সম্ভ্রমহানি হয়, যৌনতা মানে নারীর জন্যে লজ্জার বিষয়, পুরুষকেই যৌন সম্পর্কের জন্যে এগিয়ে যেতে হবে, নারীরা খাদ্য, যৌনবস্তু যা দেখে লালাও ঝরতে পারে।

এখন আসি সমাজে সত্যিকারে ঘটা কিছু ঘটনা বিষয়ে। এই যে পথে ঘাটে মেয়েরা কতো না নোংরা কথা শোনে, এই যে মেয়েরা বাসে ট্রেনে উঠতে নানা রকম স্পর্শ পায়, ওড়না ছাড়া অথবা ওড়না দিয়ে ঢাকা বুকের দিকে পুরুষের বিশেষ চাহনির কজন মেয়ে এর প্রতিবাদ করে? বরং তারা অভ্যস্ত হয়ে ওঠে এগুলো হজম করে করে বড় হতে। কেউ মুখের দিকে তাকাতে গিয়ে বুকের দিকে তাকালে বলে উঠতে পারে না, ‘আমার চোখ তো বুকে নয়, কিংবা তোমার দুপায়ের মাঝখানটায় তো উঁচু হয়ে থাকে, কই আমি তো তোমার ওখানে এরকম নজর দেই না, তোমার মগজের গু পরিস্কার করে মেয়েদের সাথে কথা বলতে এসো’। বরং তারা পরখ করে নেয় বুকের কাপড়টা ঠিকঠাক আছে কিনা কিংবা সরিয়ে ভাল করে ঢেকে দেয়, মাথা নিচু করে হাটতে হাটতে সোজা পিটটাকে কুজো বানিয়ে ফেলে। কারো প্রেমে সম্মতি থাকলেও সরাসরি মুখে হা বলতে পারে না মিচকি হাসি দিয়ে বোঝোতে হয় সে রাজী। কিংবা একসাথে দু’তিনজনের সাথেই মিচকি হাসি দিয়ে চলে। কোনটাতে সে রাজী, কোনটাতে রাজী নয় জোরালোভাবে বোঝাতে পারে না।

রাস্তঘাটে কোন ঘটনা ঘটলে কোন মেয়ে যদি প্রতিবাদ করেও ফেলে আরেক পিতৃতন্ত্রের ধারক বাহক নারী হা রে রে করে ওঠেন ‘চুপ কর’, চুপ কর’ বলে এতে মেয়েটির মান সম্মান যাচ্ছে বলে। তারা মনে করেন নারীর শরীর পবিত্র আমানত তাতে তার সম্মতি অথবা অসম্মতিতে হাত দিলেই ‘পবিত্রতা’ সত্বীত্ব নস্ট হয়ে যাবে। আর এই ‘সতী’ ‘পবিত্র’ থাকতে চাওয়ার প্রতিযোগিতার দৌড়ে তাদের নিজের সাথে ঘটা ঘটনার প্রকাশ করা, প্রতিবাদ করা হয়ে ওঠে না।

সমাজের মগজের এই আবর্জনা পরিস্কার করার দায়িত্ব প্রথমত যারা এর শিকার তাদেরকেই নিতে হবে। ঘুরে দাঁড়াতে হবে, পরবর্তী প্রজন্মকে এই পথে চালিত করতে হবে। মেয়েদেরকেই নিজেকে সম্মান করা শিখতে হবে। এই যে তার প্রতি এই আচরণ, সেটা অসম্মান আর এই অসম্মানের প্রতিবাদ তাকেই করতে শিখতে হবে, কুঁজো হতে নয়, শিরদাঁড়া সোজা হয়ে চলা শিখতে হবে। নারীরও পুরুষের মতো কাম, ক্রোধ সমান। তাই এর প্রতি বিশেষ করে যৌন চাহিদা সাড়া দেওয়া কিংবা না দেওয়া ক্ষেত্রে জোরালোভাবেই ‘হ্যাঁ’ অথবা ‘না’ বলাটা শিখতে হবে। বোঝাতে পারতে হবে ‘না’ মানে ‘না’ এর মধ্যে অন্তর্নিহিত কোন হ্যাঁ নেই। নারী শরীরসর্বস্ব বস্তু নয়, মানুষ তা বোঝাতে প্রতি পদে পদে লড়াইটা তাদেরকেই চালিয়ে যেতে হবে।

সাথে সাথে পিতৃতন্ত্রের ধারক বাহক লেখক, নির্মাতাগণকে এবার একটু নতুনভাবে ভাবতে হবে। সমাজের এই ধারণাগুলোর বদল করতে নতুন করে সাহিত্য সিনেমায় কাহিনীগুলো নির্মাণ করতে হবে।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.