‘মানুষ’ মারছো, তবুও তুমি ‘শ্রেষ্ঠ’? অন্যরা ‘অধম’?

ইমতিয়াজ মাহমুদ:

(১)
শ্রীলঙ্কার বোমা হামলায় মৃতের সংখ্যা বেড়ে ২৯০ জন দাঁড়িয়েছে। ২৯০ জন মানুষ। এদের মধ্যে শিশু-মানুষ রয়েছে, নারী-মানুষ রয়েছে, পুরুষ-মানুষ রয়েছে, নানা বয়সের মানুষ আছে। আপনি গাত্রবর্ণের ভিত্তিতে দেখতে চাইলেও দেখতে পারেন, সাদা মানুষ, কালো মানুষ, বাদামী ও হলুদ মানুষ- সবই আছে মৃতদের তালিকায়। রাষ্ট্র জাতীয়তা সংস্কৃতি এইসবের ভিত্তিতেও আদি দেখেন- সন্ত্রাসীদের বোমা সকলকেই হত্যা করেছে। ধর্ম? খৃস্টানরা তো টার্গেটই ছিল, কিন্তু নিহত মানুষের তালিকায় কেবল খৃস্টানরাই আছে সে তো নয়। মুসলমান মরেছে, হিন্দু মরেছে, বৌদ্ধ মরেছে, নিরীশ্বর লোকজনও হয়তো ছিল। কিন্তু চূড়ান্ত বিচারে এই যে প্রাণীগুলি প্রাণ দিয়েছে, এরা সকলেই তো মানুষ। মানুষই তো! নাকি?

আর যারা মেরেছে? ওরাও কি মানুষ? এইখানে আমার একটু অস্বস্তি আছে।

এই ধরনের হত্যাকাণ্ডগুলি যারা করে, ওরা ওদের মানুষ পরিচয়টাতে সেরকম গুরুত্ব দেয় না। ওরা নিজেদেরকে একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের দাস হিসাবে পরিচয় দিতেই বেশি আগ্রহী। ঐ ধর্মীয় বিশ্বাসটিই ওদেরকে দিয়ে মানুষ হত্যা করায়, ঐ ধর্মীয় বিশ্বাসটিই ওদেরকে শেখায় অন্যদেরকে ছোট করে দেখতে।

কী অবাক ব্যাপার দেখেন, পৃথিবীতে শত শত ধর্ম রয়েছে- বড় ধর্ম কয়েকটা বটে, কিন্তু অনুসারী অপেক্ষাকৃত কম এরকম অনেক ধর্ম আছে। আর বড় ধর্মগুলির মধ্যেও ভাগ আছে। এই ভাগগুলি এমনিতে একটা বড় ছাতার নিচে জমায়েত বটে, কিন্তু অনেক সময়ই একটা ভাগ আরেকটা ভাগকে বিধর্মী ও ‘ছহি নয়’ হিসাবে চিহ্নিত করে। এতোসব ধর্ম আর এতোসব বিশ্বাসের মধ্যে আপনি একটি বিশেষ বিশ্বাসী গ্রুপের অন্তর্ভুক্ত হয়ে গেছেন বলে আপনি বলবেন যে পৃথিবীর বাকি মানুষরা আপনার চেয়ে অধম! বাকিদেরকে হত্যা করা জায়েজ আছে? জায়েজ কি? কোন কোন সময় তো ওরা বলে যে হত্যা করাটাই নাকি উপাসনার অংশ।

(২)
এদেরকে মানুষ বলবেন? যদি কেউ বলে যে মাদার তেরেসার চেয়ে তার ধর্মের অনুসারী কোন চোর ডাকাতও উত্তম। কেন? মাদার তেরেসা যেহেতু তার বিশ্বাস অনুসরণ করেন না বা সেই বিশ্বাস ধারণ করেন না, সুতরাং তিনি নাকি অবশ্যই অবশ্যই নরকবাসী হবেন। তাকে আপনি কী বলবেন? মানুষ? না, মানুষ তো নয়ই। মানুষ হবার ব্যাপারে ওদের বিশেষ আগ্রহও নাই। আপনি ওদেরকে মানুষ বললে ওরা বরং আহত হবে। কেন? না, মানুষ তো সকলেই, ওরা সকলের মতো না, ওরা ঐটা- মানুষ বললে ওদেরকে নাকি ছোট করা হয়।

এরাই মানুষ মারে। আমাদের এখানেও ওরাই মানুষ হত্যা করে, ওরাই ঘৃণা ছড়ায়, ওরাই হত্যার হুমকি দেয় প্রতিদিন প্রতিনিয়ত। তরুণ বন্ধুরা, যারা কেবলমাত্র ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে নিজেকে অপরের চেয়ে শ্রেষ্ঠ মনে করে ওরা মন্দ। যারা নিজেদেরকে ধর্মীয় বিশ্বাসের ভিত্তিতে আলাদা করে ওরা মন্দ।

এক ভাই দুইটা ছবি পোস্ট করেছেন, একটা শিশুর ছবি। ফুটফুটে ছয় সাত বছরের একটা শিশুর হাসিমুখ ছবি। ছেলেটার নাম জায়ান চৌধুরী। সানবিমস স্কুলে পড়তো বাচ্চাটা। সানবিমস স্কুলে আমার দুই মেয়েও পড়েছে। এই স্কুলের ধানমন্ডি সাতাশ নম্বরের ক্যাম্পাস আর উত্তরা ক্যাম্পাস দুইই আমার পরিচিত। এই বাচ্চাটার নানা আমাদের দেশের গুরুত্বপূর্ণ একজন ব্যক্তি- শেখ সেলিম। ছেলেটির পিতা ও দাদা ওরাও আমাদের দেশের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের তালিকাতেই পড়েন। এই বাচ্চাটিকেও হত্যা করেছে ঐসব ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীরা। পিতামাতার সাথে ছুটিতে গিয়েছিল, ধর্মীয় সন্ত্রাসীরা বোমা মেরেছে ওদের হোটেল। এই শিশুটি আর নেই।

এই শিশুটির সাথে সিরিয়ার সেই শিশুটির কী পার্থক্য? ঐ যে বাচ্চাটার মৃতদেহ পড়ে ছিল সমুদ্রের পাড়ে! কিংবা ইয়েমেনের সেই বাচ্চাগুলি? অনাহারে যাদের সারা শরীরের হাড়গোড় দৃশ্যমান। অথবা সেই ছবিটি যেখানে একটি শিশু তার মৃত মায়ের স্তন চুষছিল? অথবা পাকিস্তানের সেইসব শিশুরা, যাদের স্কুলে ঢুকে সন্ত্রাসীরা গুলে করে মেরেছিল?

ইমতিয়াজ মাহমুদ

(৩)
যে বিশ্বাস মানুষকে শিশু হত্যা থেকে বিরত করতে পারে না, সে কীরকম বিশ্বাস? যে বিশ্বাস বোমা মেরে শিশু হত্যাকে জায়েজ মনে করে সেটা কীরকম বিশ্বাস? যে বিশ্বাস কেবলমাত্র ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে শিশুতে শিশুতে বিহক্তি তৈরি করে সেটা কিরকম বিশ্বাস? আপনি কি আপনার বাচ্চাকে সেই বিশ্বাস শিখাবেন? আপনার বাচ্চাকে কি আপনি সেই শিক্ষা দিবেন যে অন্য ধর্মের লোকের ওর চেয়ে অধম, ওদেরকে হত্যা করা জায়েজ? দিনে এই শিক্ষা আপনার শিশুকে?

আপনি কি চান যে আপনার রাষ্ট্র শিশুদেরকে সেই শিক্ষা দিবে? আপনার রাষ্ট্র শিশুদেরকে শেখাবে যে কেবলমাত্র একটি ধর্মীয় বিশ্বাসের কারণে সে অন্যদের চেয়ে ভালো আর ধম্রিয় বিশ্বাসের কারণে আরেকটি শিশু ওর চেয়ে খারাপ? নাকি আপনি আপনার বাচ্চাকে শেখাবেন যে মানুষে মানুষে কোন পার্থক্য নাই, ধর্মের ভিত্তিতে তো নয়ই? আপনিই বিবেচনা করেন।

আর মেহেরবানী করে একটু দেখেন। আপনার সরকার যেসব স্কুল মাদ্রাসা এইসব করেছে সেখানে কী শিক্ষা দিচ্ছে! মনে রাখবেন আপনার টাকায়ই সরকার এইসব শিক্ষা দিচ্ছে। আপনার ট্যাক্সের টাকা তো আছেই। ট্যাক্স ছাড়াও সে যদি বিদেশীদের দানের টাকাও হয় তবুও সে টাকায় আপানর অধিকার আছে। কারণ রাষ্ট্র আপনার আর ঐ দান গ্রহণের জন্যে ভিখিরিসুলভ যে গ্লানি, সেই গ্লানিতে আপনার শরিকানাও আছে।

আমার জ্ঞানী বন্ধুরা অনেকে বলেন যে সব দায়িত্ব কী সরকারের? জী জনাব। এইগুলি হচ্ছে সরকারের মৌলিক দায়িত্ব। কোনগুলি? রাষ্ট্রের মৌলিক নীতিগুলি বাস্তবায়ন করা আর মানুষের মৌলিক চাহিদাগুলি নিশ্চিত করার চেষ্টা করা। এইটা সরকারের কাজ। পরিবারের কি কোন দায়িত্ব নাই। আছে। পরিবারগুলি যার যার ইচ্ছামতো ওদের দায়িত্ব পালন করবে। কিন্তু রাষ্ট্র অনেক বড়, রাষ্ট্রের কাজ বড় আর দায়িত্বও বড়।

আমাদের সরকার কি শিক্ষা ক্ষেত্রে ঠিক কাজটি করছে? নাকি সরকারের সিলেবাসে মানুষ মানুষ ভাই ভাই এর পরিবর্তে বিশ্বাসী বিশ্বাসী ভাই ভাই শেখাচ্ছে?

(৪)
একদিন দুইদিন পর পর এতোগুলি মানুষ প্রাণ দিচ্ছে। প্রতিবার ঝগড়া করেন ওরা সহি রাস্টাফারিয়ান না। বাচ্চাদেরকে কবে শেখাবেন যে হে আমার সন্তান, তুমি হাইলে সেলাসিকে নবী মানা ঠিক আছে, কিন্তু শুধু হাইলে সেলাসিকে বিশ্বাস করো বলেই তুমি অন্যের চেয়ে শ্রেষ্ঠ না। মানুষ সকলেই সমান- মানুষের মধ্যে বিভেদ যদি কিছু থাকে সেটা শ্রেণীগত বিভেদ। তুমি যদি হাইলে সেলাসিকে নিয়ে মারামারি কাটাকাটি করতে থাকো, তাইলে আসল বৈষম্য তোমার দৃষ্ট হবে না।

শেয়ার করুন:
Copy Protected by Chetan's WP-Copyprotect.